আমার নাম প্রিয়বালা চাকমা। আমার বয়স এখন ৬৫ বছরের উপরে। ১৯৫৮ সালে ১৭ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার নিজের গ্রাম থেকে আমি চলে আসি আমার শ্বশুর বাড়ি রাংগামাটি শহরের কাছে একটা গ্রামে। গ্রামটির নাম বুড়িঘাট । কাপ্তাই বাঁধের কারণে আমি জানি, শুধু মাত্র এই বাঁধের কারণে আমাদের পরিবার চিরতরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে ডুবুরীর মতন জীবন আমাদের। আমরা ভাই বোনেরা পরস্পর থেকে চিরজনমের মতো বিচ্ছিন্ন হয়েছি। বাঁধের পানিতে ভেসে গিয়েছি আমরা, ডুব সাতার দিয়ে একেকজন উঠেছি একেক দেশে। শুধু আমাদের পরিবার কেন? গ্রামে ৭০ টি পরিবারসহ হাজারো পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্বচ্ছল পরিবার জায়গা জমি হারিয়ে ভিকিরিতে পরিনত হয়েছে। হঠাৎ করে আজন্ম চেনা জায়গা থেকে অচেনা, অজানা কোন দূর জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেসব মানুষদের মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা ছিল, যেন মৃত্যুর আগে একবার নিজ “দেশে” যেতে পারে, নিজের জন্মস্থান দেখতে পারে। এই কাপ্তাই বাঁধ, এই কাপ্তাই লেক হাজারো মানুষের কান্নার চোখের জল। আমার ছেলে মেয়েরা, এখন নাতি-নাতনিরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে কেমন দেখতে ছিল আমাদের গ্রাম? গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাবে আমরা কি জানতাম ? আমাদের কে কিছু জানানো হয়েছিল ? যখন একটি গ্রাম ডুবে যাচ্ছে তখন আমাদের অনুভুতি কেমন ছিল? হারিয়ে যাওয়া ভাই বোনদের সাথে ৪৫ বছর বাদে দেখা হওয়াটা কেমন অনুভুতি? বা এত্তবছর দেখা না হওয়াটার অনুভূতিটাই বা কেমন? কাপ্তাই বাঁধের পানি দেখার পরের অনুভূতিটাই বা কেমন? একবারও কি ডুবে যাওয়া জন্মভূমি দেখতে গিয়েছিলাম? এরকম হাজারো প্রশ্ন আমার চারপাশে। এতসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ, না কি কঠিন তাও আমি জানিনা। কিন্তু এইটা নিশ্চিত জানি, যতই মুখে বা লিখে আমার অনুভূতিগুলো বুঝানোর চেষ্টা করি সেটি ঠিকঠাক কেউ বুঝবেনা। একমাত্র সেই বুঝবে, যে এই ইতিহাসের ভুক্তভোগী। যারা জীবনে অন্তত একবার ঘর-বাড়ি-জমি সব হারিয়েছেন, যাদের পরিবার ভেঙ্গে গেছে চিরতরে। তাদের জন্য আমার এই শিরোনামহীন নির্মম ঘটনাবলী। জীবনের সব মধুর স্মৃতি যে জায়গা দুটোকে ঘিরে সেই জায়গাগুলো, স্মৃতি গুলো, বাঁধের কারণে পানিতে তলিয়ে যাবার আগে এবং পরের সব দু:খের স্মৃতিগুলোও এতদিন লুকিয়ে রেখেছি নিজের মনের ভেতর। সেগুলো এভাবে এই বয়সে এসে বলতে বসবো ভাবিনি কোনদিন। হয়তো এটি মন্দের ভালো কারণ, আমাদের এই প্রজন্মের পর আর কেউ বলতে পারবেনা পানিতে তলিয়ে যাবার আগের মানুষের মর্মবেদনাগুলো। কত স্মৃতি কত ঘটনা, কোনটা ফেলে কোনটা বলি—-
বিশাল বিশাল তিনটা আমগাছ জড়াজড়ি করে দাড়িয়ে আছে ঠিক আমাদের গ্রামে ঢোকার মুখে। তার পাশে আরো কত গাছ, বড় ছোট। সবুজ, আর সবুজ চারিদিকে। দুপুরে যখন গরম তেতে উঠে তখন নারী পুরুষ শিশু সবাই এই আমগাছের তলায় চলে আসে ঠান্ডায় জিরোবে বলে। কী ঠাান্ডা এই গাছ তলা। কেউ শুয়ে ঘুমায়, কেউ কড়ি খেলে, কেউ গল্প করে মেয়েরা পরস্পরের মাথার উকুন খুঁজতে ব্যস্ত থাকে। আমরা এক গ্রুপ সবসময় ব্যাস্ত থাকি “থুম্বুক ” খেলা খেলতে। মোট কথা, আমাদের গ্রামের এই গাছতলা হচ্ছে গ্রামের প্রাণ। আমাদের গ্রামের কাছাকাছি আর কোনও গ্রাম নেই। বেশ দূরে আরেকটা গ্রাম। তারপর তার থেকে আরো দূরে আরও একটা। তাই গ্রামে সকলের জীবন একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে জড়ানো। গ্রামের অনেক দূরে বিশাল ঘন সবুজ বন। সবাই বলে সে বনে এত্তো বড়ো বড়ো গাছ যে সাত জন মিলে যদি হাতে হাত ধরে ঐ গাছকে জড়িয়ে ধরতে যায় তবু গাছে ফাক থেকে যাবে। এমন ঘন বন যে সূর্যের আলো কখনও মাটিতে পড়েনা। এই ঘন বনে এমন বড় বড় গাছে ভরা। কত রহস্য, কত ঘটনা, কত গল্প এই বনকে ঘিরে। সন্ধ্যা বেলা মাচাং-এ বসে এই গল্প শুনতে শুনতে ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। ছোটদের মানে, আমাদের আর রাতের বেলা একা বাইরে যাবার সাহস থাকেনা।আমাদের এই শান্ত আর নিরিবিলি গ্রামের নাম উগলছড়ি। বগাছদা মৌজা, লংগদু, রাংগামাটি। এই গ্রামে আমার জন্ম। ৩ ভাই ও ৩ বোন নিয়ে আমাদের ভরপুর সুখের সংসার। আমাদের বাড়ি ছিল “আলকঘর ”। গ্রামের সব পরিবার চাকমা জাতির “বংশা গজার” বংশধর। চাকমারা অনেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। বংশা গোষ্ঠী এরই একটি। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে কাজালং নদী আপন গতিতে বহমান। প্রতি বছর ঘোর বর্ষায় কাজালং নদী ফুলে ফেপে উঠে, চারিদিক ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেই সংগে পলি মাটিও দিয়ে যায়। এই কারণে এই নদীর তীর ঘেষে জমি গুলো খুবই উর্বর। ফসলের সময় সে এক দেখার মতন দৃশ্য। সোনালী, আর সোনালী ধান ক্ষেত। আমাদের গ্রামটা কাজালং থেকে দূরে ছিল, তাই ঘোর বর্ষার মৌসুমে আমাদের আবাদী জমিগুলো পানিতে ডুবে যাবার ভয় ছিল না। উর্বর জমি হবার কারণে গ্রামের সব পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে খুবই স্বচ্ছল। আমাদের গ্রামের আবাদি জমি গুলোর ফসল যখন সোনালী হয়ে উঠে সেসব ফসল কাটার জন্য প্রত্যেক বছর গ্রামের মুরুব্বীরা সকলে মিলে গ্রামের বাইরে থেকে কামলা ভাড়া করে আনে। সেসব কামলারা সকলেই বাংগালী। অনেক দূর কোন এক জায়গা থেকে তারা ফসলি ধান গুলো ঘরে তুলে দিতে গ্রামে আসে আর তা শেষ হবার সাথে সাথে আবার চলে যায়। বছরে এই একবারই আমরা “বাংগালী” বলে ভিন্ন চেহারার, ভিন্ন ধর্মেও, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে এমন কাউকে দেখি। আমাদের ছোটদের কাছে এরা ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। এই ভিনদেশিদের কাজ হচ্ছে শুধু ধান কাটা, আর সেসব ঘরে তুলে দেওয়া। আমাদের গ্রামে ছোট বাচ্চাদের পড়াশুনার জন্য একটি প্রাইমারি স্কুল ছিল। কিন্তু মাধ্যামিকে পড়ার জন্য দূরে স্কুলে যেতে হত-। সে অনেক দূর। তাইতো মেয়েদের হাই স্কুলের পড়াশুনার সুযোগ খুবই কম জুটে। এই জন্য আমার পড়াশুনার দৌড় শুধুমাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত।
গ্রামে একটি বৌদ্ধ মন্দির আছে। আমাদের বাড়ীর কাছেই। সকাল বিকাল দাদীকে দেখতাম ফুল আর পানি এবং সান্ধ্য বাতি দিতে মন্দিরে যেতে, প্রার্থনার সুর শুনতে ভালোই লাগত আমার। বিকেল হলেই সুর করে যখন সান্ধ্য বাতি বুদ্ধের উদ্দেশ্যে জ্বালানো হত, আর প্রার্থনা সংগীত গাওয়া হত, তখন একট মধুর আবহ তৈরী হত। প্রত্যেক দিন বিকেল হবার আগে আমাদের ছোটদের দায়িত্ব ছিল মাটির কলসি নিয়ে মন্দিরে পানি দেয়া। বিনিময়ে ভান্তে আমাদের এক টুকরো আখ বা অন্য কিছু খাবার দিত। সেই একটুকরো আখ আমাদের কাছে ছিল ভীষণ লোভনীয়।
আমাদের গ্রাম একটু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। আমাদের জমি গুলো ঠিক পাহাড়ের নীচে। আমার ১৭ বছর বা তার কাছাকাছি বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সেটি ১৯৫৮ সাল। কাপ্তাই বাঁধ তারও বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বানানো শুরু হয়েছে। বেশ অনেক দিন ধরে আমার বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। মা, বাবা, আজু ও নানু সবাই এই নিয়ে ফিসফাস করছে। আমি ভাবতাম শুধু আমার বিয়ের জন্য এইরকম কথাবার্তা হচ্ছে। আমার বিয়ে কোথায় হবে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু না, শুধু বিয়ের না একই সাথে নানা ধরণের ফিসফাসও কানে আসছে। গ্রামের মুরুব্বীরাও ব্যস্ত আলোচনায়। উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে এই ধরনের কথা হচ্ছে। একধরণের চাঁপা আতঙ্কে কথা বলাবলি হচ্ছে সবার মধ্যে। সেদিন কাকে যেন বলতে শুনলাম “আমাদের গ্রামের এই সব চাষাবাদি জমি সব ডুবে যাবে। শুধু পাহাড়ের জমি গুলো থাকবে এবং সেগুলো পানির কল দিয়ে পানি তুলে চাষবাষ করতে হবে।” ”হয়তো আমাদেরকে এই গ্রাম এই জায়গা ছেড়ে দূরে যেতে হবে। ” আমি কিছুই বুঝিনি। কেন ডুবে যাবে, কে ডুবাবে, বর্ষাকালে কখনোতো আমাদের জমি কাজালং নদীর পানিতে ডুবতে দেখিনি। তাহলে জমি ডুবার কথা আসছে কেন?? এসব নানা প্রশ্ন, নানা ভাবনা আমাকে ঘিরে ধরে। একদিন বাবাকে জীজ্ঞেস করে জানলাম এই সব কথার মানে কি?
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন, অনেক দূরে রাংগামাটির শহর থেকেও দূরে,“বড়গাং মু, ” মানে কণফুলি মুখে একট ”গদা” মানে বাঁধ নির্মান করেছে সরকার। এই বাঁধে শুধু গেট লাগানো বাকি। আর গেট লাগানো হলে কর্ণফুলির পানি আর বের হতে পারবেনা, ফলে পাহাড়ের সকল নদীতে পানি বেড়ে যাবে, তেমনি কাজালং-এর পানি জমতে জমতে কর্ণফুলির নদী থেকে হাজার মাইল দূরে আমাদের এই গ্রামের নীচু ধান্য জমিগুলোও ডুবে যাবে, আমাদের জীবন রক্ষাকারী জমি গুলো পানিতে তলিয়ে যাবে। সব কিছু পানি গ্রাস করে নিবে। আমাদের জীবন এখন হুমকির সম্মুখীন। জীবন কিভাবে চলবে সে চিন্তায় আমরা সবাই অস্থির হয়ে গেছি। বাবা আবার বললেন, কেউ কেউ বলছে আমাদের এইসব জায়গা পানিতে তলিয়ে যাবার সাথে সাথে আমাদেরও এই পাহাড়, এই গ্রাম, এই বাড়ি সব ছেড়ে দুরে চলে যেতে হবে। হয়তো পাশের দেশে চলে যেতে হবে। সেই দূর কোথায় আমার জানা নেই। বাবা বলেন, তবে আমি ভেবে রেখেছি আমি দেশ ছাড়তে চাইনা। আমি সবাইকে নিয়ে মাতামহুরী যেতে চাই ওখানে নতুন বসতি গড়তে চাই। আমাদের গ্রামে আমার অনেক জ্ঞাতি ভাই পাশে রির্জাভ ফরেষ্টে চলে যাবে বলে ঠিক করেছে। আবার অনেকে খাগড়াছড়ি চলে যাবে। যে যেখানে পারবে সেখানে যাবার চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন করে সব ঠিক করা সহজ নয়। তাই গ্রামের লোকজন দিশাহারা হয়ে আছে। আবার অনেকে কিছুতেই বিশ্বাস করছেনা সেই বাধের পানি হাজারো মাইল দূরে এসে আমাদের এই গ্রামকে গ্রাস করবে। যদিও অন্য জায়গায় জমি নেবার জন্য কিছু ফরম দেয়া হয়েছিল । এরপর,আমারও আর কিছুই ভালো লাগে না। আমাদের জমি পানিতে তলিয়ে যাবে! জন্ম থেকে চেনা পাহাড় , সবুজ গ্রাম, বড় বড় কত গাছ , আমার স্কুল, আমাদের প্রার্থণার মন্দির, সব সব ছেড়ে যেতে হবে! আমাদের অনেক বড় যৌথ পরিবার, ভাইবোন সবাই কোথায় কোথায় চলে যাবো ভাবতেই কান্না শুরু হলো।
এই আতঙ্কের মধ্যে দিন কেটে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। বিয়ের পরেই আমি চলে এলাম রাঙগামাটি শহরের কাছের একটা গ্রামে। এটা ১৯৫৮ সালের শেষের দিকের কথা। বিয়ের পর আমি একবারই গিয়েছিলাম আমার নিজের গ্রামে। দেখলাম মোটামুটি সবাই বুঝে নিয়েছে পানি সত্যি সত্যি তাদের জমি গ্রাম কেড়ে নেবে। তখন সবাই গ্রাম ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। গরু ছাগল মুরগী পানির দামে বিক্রি করছে। খাগড়াছড়ি তখন প্রত্যন্ত অঞ্চল। অনেক দূরের পথ। কেউ সেখানে গিয়ে জায়গা কিনে নেবার চেষ্টা করছে। কেউ ভারতে যাবে বলে মনস্থির করেছে। আমার বাবা মনস্থির করেছে সে চলে যাবে মাতামহুরী। কিন্তু মাতামহুরীতে আগে কখনো সে যায়নি। ভেবে পাচ্ছেনা, সেখানে কিভাবে যাবে। আর যারা এখনো বিশ্বাস করছেনা যে পানিতে এতো বড়ো উচু পাহাড় তলিয়ে যাবে তারা বেশ দ্বিধা-দ্বন্দে আছে।অদ্ভুত কঠিন আর কষ্টকর পরিস্থিতি। সেই আমার নিজের বাড়িতে সব ভাইবোন মিলে একত্র থাকা। এরপরের জীবন আরও কষ্টকর,কঠিন।
বুড়ীঘাট, আমার শশুর বাড়ি, আমার নতুন ঠিকানা। নান্যাচরের নীচে, রাংগামাটির উপরে। এই বাড়ি গুদামঘরের বিশাল বাড়ি। এখানে যৌথ পরিবার। জ্বা-শ্বাশুরি-দেবর-ননদ নিয়ে বিশাল পরিবার। রেবতি দেওয়ান আদাম। হুলি দেবানর আদাম। এখানেও এসে দেখি একই আতংক সবার মধ্যে। সবারই একই আলোচনা। কবে নাগাদ গেট বন্ধ করবে? আর গেট বন্ধ করলে সত্যিই কি আমাদের এই গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাবে ? তখন কি হবে আমাদের ? – এই নিয়ে আলোচনা। মনে হচ্ছে, সকলের সব কাজ শেষ শুধু এই আলোচনাটুকু ছাড়া। আর অপেক্ষা। অপেক্ষা। কবে গেট বন্ধ করবে? তারপর কতদিনের মধ্যে গ্রাম পানিতে তলিয়ে যেতে পারে? হাতে কত কাজ বাকি! নতুন জায়গা বন্দোবস্ত করা, হঠাৎ করে পানি চলে এলে বাঁচার জন্য নৌকা ঠিক করে রাখা, গবাদি পশুর ব্যবস্থা করা, কত কি কাজ। কিন্তু আসলেই কি এতো পানি হবে যে পাহাড়ের উপর অবস্থিত গ্রামও তলিয়ে যাবে? বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না কারোর।এরই মধ্যে আমাদের পুরাতন শশুর বাড়ি পরিবর্তন করা হলো এই কারণে যে যাতে পানিতে তলিয়ে না যায়। সেই বিশাল গুদাম ঘরকে নীচে রেখে আমরা একটা উঁচু পাহাড়ে নতুন ঘর তৈরী করলাম। আমরা সকলে এই নতুন ঘরকে সহজে মেনে নিতে পারলেও আমার শাশুড়ী পারলেন না। উনি প্রতিদিন সকালে পাহাড়ের নীচে চলে যেতেন পুরাতন বাড়ীতে। সারাদিন থেকে সন্ধ্যার একটু আগে ফিরে আসতেন। এই ঘটনা তার জন্য ছিল ভয়ানক পীড়াদায়ক। এই পুরাতন বাড়ী নিয়ে তার কতো স¥ৃতি। এখানেই তিনি বৌ হয়ে এসেছিলেন, কত বাড়ন্ত সংসার ছিল তার। আমার শশুর এই বাড়ীটাতেই মারা যান। তাই হাজারো স্মৃতি নিয়ে দাড়িয়ে থাকা এই বাড়িটি ছেড়ে থাকা তার পক্ষে কতটা কষ্টকর সেটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয়। সবারই মুখে মুখে রটে গেল যে ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে পানি আসবে। তখন আমার চাচাত ভাসুর, জীবনী বাপরা খাগড়াছড়ি চলে আসে। এটা বিজুর আগে। আমার স্বামী তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, সত্যি সত্যি পানি আসবে আর সবকিছু তলিয়ে দেবে। তাই আমার স্বামী আমাদের ধান্য জমিতে ধান রোপন করেছেন। তার এক কথা পানিতে তলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি কোথাও যাবেন না ।
এটা ১৯৬০ সালের কথা। ঘোর আষাঢ় মাস শুরু হলো। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সারাদিন রাত বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে লাগলো। প্রচন্ড ঝড়ে এক রাতেই সবকিছু পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। সকালে উঠেই দেখালাম চারিদিকে পানি আর পানি। এবং সেই সংগে প্রচন্ড বৃষ্টি। সবাই বুঝে নিল সেই দিন উপস্থিত। এবারেই সব তলিয়ে যাবে। সবাই এখন প্রাণ হাতে নিয়ে, অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোয় ব্যস্ত হয়ে গেল। হাতে সময় নেই একটুও। এইতো পানি দোড় গোরায় এসে গেল বলে। বিদায় বলারও কারোর সময় নেই। পানি কাউকে সময় দিতে চায়না। ভাগ্যিস আগে থাকতে নৌকা ভাড়া করা ছিল। রাতে পানি বেড়ে গেলে আমরা সকালে নৌকায় চেপে আমাদের বাড়ি জমি সংসার সব ফেলে চলে আসি। শুধু স্মৃতি গুলোকে সম্বল করে। এটি বিজুর পরের কথা। আমরা খাগড়াছড়ি চলে আসি। খাগড়াছড়িতে আমার চাচাত ভাসুররা আগেই চলে এসেছিল, তাই আমরা একটু সুবিধা পেলাম। তাদের খুঁজতে খুঁজতে আমরাও একসময় পৌছে গেলাম খাগড়াছড়ি লারমা পাড়ায়। এটি আমাদের বতর্মান আবাস। কিন্তু তখনও আমরা জানতাম না আরো ৩০/৩৫ বছর পরে আরও একবার গ্রাম ছাড়া হতে হবে আমাদের।
এতকিছুর পরে নিরাপদে আমরা একটা জায়গায় তো থিতু হলাম, অন্যদিকে আমার বাবা মা ভাইবোন ওদের কি অবস্থা ভেবে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। এতদূর থেকে এত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের খবর নেওয়া বা পাওয়া খুুবই কঠিন। তখনতো সব হাটা পথ। অনেকদিন পরে খবর মিললো আামার পরিবারের। তারা রির্জাভ ফরেষ্টে আশ্রয় নিয়েছে। বাবা মাতামহুরী যাবার আর সময় পায়নি। তাই অগ্যতা জীবন বাচাঁতে আশ্রয় নিতে হলো রির্জাভ ফরেষ্টে। এরপর আর আমি কিছুই জানিনা। মাঝে মাঝে খবর আসে বাবারা সবাই দেমাগ্রী পার হয়ে ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু ভারতে কোথায়, কোন জায়গায় সেটা আমার জানা নেই। উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে খাগড়াছড়িতে নতুন করে সংসার গোছানো। ভাগ্যই বলতে হবে যে আমার স্বামী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি খাগড়াছড়িতে নতুন চাকুরী শুরু করলেন। কিন্তু আমার বাবা ভাই বোন আজ কোথায়???
অনেক বছর পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানলাম বাবা, ৩ ভাই ও ১ বোন সবাই অরুণাচলে চলে গেছে। এখন সেখানে কঠিন জীবন সংগ্রাম করছে। আমার বড়ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে আমার দীর্ঘ ৩০ বছর পর। অরুণাচল থেকে এসেছে আমার স্বামী নাম খুঁজতে খুঁজতে। এক সন্ধ্যা বেলায় ৫/৬ জনের মেহমান যখন আমার নাম ধরে খোঁজ নিচ্ছে, তখন আমি বাড়ীর ভেতর বসে ভাবছিলাম বোধহয় শান্তিবাহিনী এসেছে। বাইরে বের হয়ে অনেক্ষকণ পরে চিনতে পারলাম, আমার ছোট ভাই অমিয় রঞ্জন চাকমা! তখন সেকি এক হাহাকার অনুভূতি। তার কাছ থেকেই শুনলাম গ্রাম ছাড়ার পর তাদেরকে অনেক বছর রির্জাভ ফরেষ্টে থাকতে হয়েছিল। একেবারে যাযাবরের মতো। পরে বাবা দেমাগ্রী হয়ে ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে যাবার পথে বাবা মারা যান। এর পরে অনেক বছর পরে আমার বড় ভাই প্রিয়রঞ্জন চাকমা আমার বাড়িতে আসেন। এবারে দাদা এসেছে “দেশে ” শ্রমণ হবার জন্য। সে শুনেছে “দেশে ” একজন বনভান্তে নামে ধর্মীয় গুরু আছেন, সেখানে তিনি প্রবজ্যা গ্রহণ করবেন। ভাগ্যের কি নির্মম লেখনী, দাদা প্রবজ্যা শেষ করে অরুণাচল ফিরে যাবার পরপরই সেখানে মারা যান। আমার বাকী দুই ভাই বোনের সংগে দেখা হলো দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ভারতের অরুনাচলে। আমাদের সবচেয়ে ছোট বোন ১৯৬০ সালে যার বয়স ছিল ১০ কি ১১ সে এখন মধ্যবয়সী এক নারী। রাস্ত’ায় যদি কখনও দেখা হতো আমি বা সে কখনো পরস্পরকে চিনতেই পারতাম না। এই দেখা হওয়ার কাহিনী আর তাদের ভারতে অরুণাচলে চলে যাওয়ার কাহিনী সব বাস্তবতা আর গল্প উপন্যাসকেও হার মানায়। সেকথা অন্য কোনও একদিন।
কিন্তু ১৯৬০ সালের পর আমার আর আমাদের ডুবে যাওয়া গ্রাম, জমি , খেলার মাঠ, আমার জন্ম থেকে দেখা বেড়ে উঠা জায়গাার দেখা পাইনি। অনেকবার যেতে চেয়েছি কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। পরে শুনেছি গ্রামের কার্বারী থেকে আমাদের গ্রাম-পাহাড় পুরোপুরি ডুবে যায়নি। এখন সেসব পাহাড় সব বাংগালীদের দখলে। যে গ্রাম সব চাকমাদের ছিল, সেসব এখন পুরোপুরি বাংগালীদের দখলে। সেসব ফিরে পাবার আর সেখানে একবার হলেও ফিরে যাবার আমাদের আর কোন সুযোগ নেই। এই আমাদের বাস্তবতা। রাংগামাটি শহর এখন বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন শহর। বাঁধের পানিকে ঘিরে এই শহর এখন পর্যটন নগরীতে পরিণত হয়েছে। জলবিহারের জন্য মানুষ এখন কোথায় যায়? এই রাংগামাটিতে। এই শহরে কদাচিৎ যাওয়া হয় আমার। না লেকের অপরূপ সৌর্ন্দয্য উপভোগ করতে বা জলবিহারে মগ্ন হতে আমি যাইনা, যেতে হয় ধর্মীয় কারণে, কারণ এখানে বৌদ্ধদের একজন ধর্মীয় গুরু আছেন। তাকে বন্দনা করতে। যখনই সকাল বেলা উঠে ঘরের বাইরে বের হয়ে শুধু পানি চোখে পড়ে তখনই আমার তলিয়ে যাওয়া গ্রাম, স্মৃতি ঝুপ করে চোখের সামনে হাজির হয়। এই লেক তো শুধু লেক নয় এটি যে আমার, আমাদের সকলের চোখের জল। ফোটা ফোটা চোখের জল, যেগুলো জমতে জমতে আজ এত বড় লেকে পরিনত হয়েছে। চোখের জল কি কখনো বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে ? মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের ভাসমান জীবনের কথা। বাঁধের পানির সাথে সাথে আমাদের জীবন, শৈশব, ইতিহাস ভেসে গেছে। ডুবে গেছে। সেই থেকে ডুব সাঁতার কেটে চলছে জীবন। কখনও ডাঙ্গার মাছ, কখনও পানির তলে ডুবুরী।
*সমারী চাকমা অাইনজীবী। পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রায় দুই দশক ধরে যুক্ত। ছাত্রীজীবনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংগঠক ছিলেন। বর্তমানে আইন পড়ছেন। কাপ্তাই বাঁধ ও পাহাড়ী নারীদের জীবন নিয়ে একটি কথ্য ইতিহাস সংগ্রহ ও রচনার কাজ করছেন।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, যাপিত জীবন
I hope someday we will have enough strength and courage to ask for forgiveness to the hill people of Bangladesh. Thank you for your hard work Samari.
Reblogged this on .