গা-সহা পিতৃতন্ত্র এবং আরও একটি অপ্রকাশিত সংবাদ

soniar chokh 1সবুজ শহীদুল*

সোনিয়া আক্তার। তার বয়স ১৪। এ বছরের (২০১২) জানুয়ারী মাসে তার বিয়ে হয়েছে । শুক্কুর আলীর সাথে তার প্রেম ছিল। বান্ধবী মোমেনার মধ্যস্থতায় শুক্কুর আলীকে বিয়ে করে পালিয়ে যায়। কিন্তু, একমাস যেতেই শুক্কুর আলী সোনিয়াকে তার মায়ের কাছ থেকে ব্যবসা করার টাকা এনে দিতে বলে। টাকা না দিতে পারায় শুক্কুর আলী সোনিয়াকে মার-ধর শুরু করে।

সোনিয়ার মার নাম কাজল বেগম (৩৫)। কাজল বেগমের একমাত্র সন্তান সোনিয়া।  প্রায় ষোল বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল চাঁদপুরের মতলব থানার এখলাছপুরের মনা মিয়ার সাথে। বিয়ের দুই  বছরের মাথায়, ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয় সোনিয়া। আনুমানিক ৬/৭ বছর আগে মনা মিয়া স্ত্রী ও কন্যাকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ে করে। তখন থেকেই দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেই বসবাস করছে। কাজল ও সোনিয়া, মা-মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াই সেই থেকেই চলছে। মা পেটের দায়ে কিশোরী সোনিয়াকে গার্মেন্টসে কাজে পাঠাতে বাধ্য হন। সোনিয়াই হয়ে উঠে কাজল বেগমের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ।

তাই বিয়ের পর পালিয়ে যাওয়া সোনিয়াকে হন্নে হয়ে খুঁজতে থাকেন তার মা। অনেক খোঁজাখুজির পর কাজল বেগম সোনিয়া ও তার স্বামীকে পান ডেমরার কোনাপাড়ায়। কাজল বেগমকে শুক্কুরের পাতানো মা ও বাবা যার-পর-নাই অপদস্থ করে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কাজল বেগম মেয়ে ও জামাইকে তার কাছাকাছি মান্ডা থানার সাত ভাইয়ের বস্তিতে বাসা ভাড়া যোগাড় করে দেন। নতুন বাড়িতে এসে মার-ধর লেগেই থাকে। প্রায় প্রতিদিনই শুক্কুর ৫০ হাজার টাকা ও ঘর সাজানোর আসবাবপত্র এনে দেওয়ার জন্য সোনিয়ার উপর চাপ দিতে শুরু করে। সোনিয়া সবসময়ই বলে, তার মা বাসা-বাড়িতে কাজ করে, এত্ত টাকা কোথা থেকে দেবে। উত্তরে চলে মারের পর মার।

এই রুটিন চুড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই মাসের ১৭ তারিখ। সেদিন সকাল এগারোটার দিকে সোনিয়া আবারও বলে, সে বা তার মা যৌতুক দিতে পারবে না। শুক্কুর আলী সোনিয়ার উপর চড়াও হয়, নখ দিয়ে খামচে তার চোখ তুলে ফেলতে চেষ্টা করে। সোনিয়ার ডান চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসে। ডান চোখ ও কান থেকে মারাত্মক রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সোনিয়ার আর্ত চিৎকার আর প্রচন্ড রক্তক্ষরণে শুক্কুর ও তার মা রওশন আরা বেগম একটু আতংকিত হয়ে পরে। সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মা-ছেলে চোখের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা সোনিয়াকে দুটি চোখই তুলে ফেলে জীবনে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এবং ডাক্তারের কাছে মিথ্যে বলতে চাপ সৃষ্টি করে। শুক্কুর ও তার মা সোনিয়াকে বলে ডাক্তারকে বলবি, ”পরে গিয়ে চোখে ব্যাথা পেয়েছিস। আমরাই ডাক্তারকে বলব তুই পরে গিয়ে চোখে ব্যাথা পেয়েছিস।” এদিকে মা সঙ্গে নেই, ভীতসন্ত্রস্ত সোনিয়া ভয়ে ডাক্তারের কাছে স্বামী ও শাশুড়ীর উপস্থিতিতে তাদের শিখানো কথাই বলে।

soniar chokh 2বেলা ১১ টার ঘটনা কাজল বেগম জানতে পারেন রাত ১০টায়। সারাদিন রাজধানীর মধ্যবৃত্তের বাসায় ঠিকা ঝিয়ের কাজ, সন্ধ্যায় সবজি বিক্রি করে রাত ১০ টায় বাসায় ফিরে কাজল বেগম প্রতিবেশী ভাড়াটিয়াসহ অন্যদের কাছে জানতে পারেন, তার আদরের একমাত্র কন্যা সোনিয়ার চোখ তার স্বামী তুলে দিয়েছে। কাজল বেগম ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সোনিয়াকে মেডিকেলের চক্ষু বিভাগে (৩০২ নং ওয়ার্ডে, ১৩ নং বেড) চোখে ব্যান্ডিস করা অবস্থায় খুঁজে পায়। কাজল বেগম চিৎকার করে বলতে থাকেন, ”শুক্কুর ও তার মা আমার মেয়ের চোখ তুলে দিয়েছে। আমি এর বিচার চাই।” ইতিমধ্যে সোনিয়ার মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে শুক্কুর আলী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। শুক্কুরের মা রওশন আরা কাজল বেগমকে ধমকাতে থাকেন। নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে সেও হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়।

রাতভর যন্ত্রণাকাতর সোনিয়ার পাশে থেকে সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে কাজল বেগম ডাক্তারদের পরামর্শে মান্ডা থানায় যান মামলা করতে। কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে তিনি সোনিয়ার উপরে পাশবিক নির্যাতনের কথা জানিয়ে মামলা গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। কর্তব্যরত কর্মকর্তা কাজল বেগমের মামলা  না নিয়ে, তার কোন কথা না শুনে তাকে থানা থেকে তাড়িয়ে দেন। বলেন, “সকাল বেলা একটু নামাজ কালাম পড়ব, আল্লাহ খোদার নাম নিব তা রেখে তুমি আসছ মেয়ের উপর নির্যাতনের কাহিনী শুনাইতে। স্বামী তো স্ত্রীকে মারতেই পারে। তাই বলে থানায় মামলা করতে হবে? স্বামী মারলে বেহেস্তে যাওয়া যায়। সেটাও জাননা”? কাজল বেগম কান্না কাটি করতে করতে বলেন, ”স্বামী মারতে পারবে বলে কি চোখ তুলে ফেলবে?” কর্মকর্তা আরো ক্ষীপ্ত হয়ে কাজল বেগমকে থানা থেকে তাড়িয়ে দেন, বলেন আগে মেয়ের চিকিৎসা করাও।

থানা থেকে কাজল বেগম স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য বাদশা মেম্বারের বাসায় যান। বাদশা মেম্বারের স্ত্রী তাকে দেখেই জানতে চান গতকাল যে মেয়ের স্বামী তার স্ত্রীর চোখ তুলে ফেলেছে, তিনিই সেই মেয়ের মা কিনা। কাজল বেগম হ্যা সূচক জবাব দিতেই তিনি বলেন তুমি এখনি থানায় যাও, এটা থানা পুলিশের কাজ। কাজল বেগম জানান তিনি থানায় গিয়ে ছিলেন। কিন্তু থানা মামলা নেয়নি। কাজল বেগম ঐদিন এর ওর কাছে ঘুরেও থানায় মামলা করতে পারেন না। ১৯ জুলাই সোনিয়ার চোখের অবস্থার অবনতি হলে তাকে ওসিসিতে স্থানান্তর করা হয়। রাতে কাজল বেগম ওসিসির ডাক্তারদের জানান মেয়ের স্বামী চোখ তুলে দিয়েছে। কিন্তু থানায় মামলা নিচ্ছে না। ওসিসির ডাক্তাররা তখন থানায় ফোন করেন এবং কাজল বেগমকে থানায় পাঠান। হামলার তিন দিন পরে, রাত ৮.৪৫ মিনিটে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০০০ (সংশোধন)/০৩ এর ১১(ক)/৩০ ধারার থানা মামলা গ্রহন করে (মামলা নং-৪৫)।

মামলা নেয় ঠিকই, কিন্তু শুরু হয় নতুন টালবাহানা, ঢিলেমী। ঠিকে-ঝির মেয়ে, গার্মেন্টস কর্মীর চোখ তুলে নিয়েছে, তাতে কার কি এসে যায়? আসামী ধরতে হলে পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়। কাজলের সেই ঘুষের টাকা কোথায়? থানা পুলিশ শুক্কুর আলীকে গ্রেফÍারের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখায় না। সোনিয়া গার্মেন্টসের কর্মী ছিল, তাই সাহায্যের জন্য তার মা গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশুর কাছে যান। ঘটনার শোনার পর তিনি নিজে থানায় গিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সাথে দেখা করে মামলার অগ্রগতি জানতে চেষ্টা করেন। তার প্রশ্নের জবাবে থানার কর্মকর্তারা বলেন, ”আপনারা বলেন ছেলে কোথায় আছে, আমরা ধরে নিয়ে আসব।” তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আসামীকে খুঁজে বের করা, গ্রেফতার করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব যে তাদেরই এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই সাইফুল বলেন, ”আমি তো তাকে চিনে রাখিনি। আপনারা ধরিয়ে দিন।” মামলার ধারা, গুরুত্ব ও সোনিয়ার দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরা হলে সাইফুল সাহেব বলেন, ”এর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলাও অনেক সময় আমরা কিছুই করতে পারিনা।” আরও মাসখানেক পরে মামলার খোঁজ নিতে থানায় গেলে, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও.সি), শেখ আবু সালেহ মাসুদ করিম একই সুরে কথা বলেন, মামলার বাদীকেই ধরিয়ে দিতে হবে আসামীকে!

দীর্ঘ দেড় মাসেরও অধিক সময় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা শেষে রিলিজ পায় সোনিয়া। কিন্তু তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়নি। কোটর থেকে বেরিয়ে পরা চোখটিকে ভিতরে ঢুকানো হয়েছে। ডান চোখটি এখন বাঁকা হয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল থেকে তাকে রেফার্ড করা হয়েছে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউটে। সোনিয়ার চোখে স্কুইপ অপারেশন করতে হবে। সে এখন একটি বস্তুকে দুটি হিসেবে দেখতে পায়। অক্টোবরের দুই তারিখে সোনিয়া চক্ষু বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউটে যায়। সেখানে ডাক্তাররা জানায় অপারেশনের পূর্বে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এদিকে ঢাকা মেডিকেল থেকে রিলিজ দেওয়ার সময় তাকে যে ঔষধ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে তা কেনার আর্থিক সামর্থই তার নেই, নতুন পরীক্ষা করাতো দূরের কথা।

অন্যদিকে, শুক্কুর আলী মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়, আরও নির্যাতনের ভয় দেখায়। সোনিয়ার তখন মায়ের সাথে থাকাই দায় হয়ে ওঠে। ১০ই অক্টোবর শুক্কুরের মা ও দুই বোন কাজল বেগমকে মান্ডা কাঁচা বাজারের সামনে মারাত্মক মারধর করে। কাজল বেগম তার উপরে এই নির্যাতনের বিচার চেয়ে থানায় মামলা করতে গেলে, থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরীতে অন্তর্ভূক্ত করেন (নং- ৪৬২ তারিখ: ১০/১০/১২)। সোনিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজল তাকে সাভারে তার এক দুসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। শুক্কুর আলীর পরিবার সদম্ভে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ বড় অপরাধের আসামীর খোঁজে ব্যাস্ত। আর, কাজল ও সোনিয়ার জীবনের নেই কোনও নিরাপত্তা।

কাজল ও সোনিয়ার ক্রদ্ধ চাহনী দেখে মনে হয়, যে বেহেশতের প্রবেশদ্বার একমাত্র স্বামীর চোখ উপড়ে ফেলার ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেই খোলে, সে বেহেশত চাই না, এমন বেহেশতের দরজা বন্ধ থাকাই ভালো!!!

*সবুজ শহিদুল একজন মুক্ত গবেষক । গত কয়েক বৎসর গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রাম চিত্র ডক্যুমেন্ট করার কাজ করছেন।



Categories: যাপিত জীবন

Tags: , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: