একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। পাত্রপাত্রিদের অনুমতি ছাড়াই বলছি, কারণ এটা পাবলিক পরিসরে ঘটা ঘটনা। ২০১১ সাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর আর তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ডেভিড বার্গম্যান। তাদের অবমাননার পক্ষে বিপক্ষে শুনানীর দিন ধার্য হয়েছে। নির্ধারিত দিনে এজলাসে দুইপক্ষের আইনজীবী, বন্ধু, সাংবাদিকরা উপস্থিত আছেন। বন্ধু ও সহযোদ্ধা হিসেবে উপস্থিত অনেকের মধ্যে লেখক ও কলামিস্ট রেহনুমা আহমেদ ছিলেন। শুনানী শেষে বের হয়ে এসে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। একজন সাংবাদিক রেহনুমা আহমেদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন আপনি কি বার্গম্যানের মা? রেহনুমা আহমেদ তখন অন্যদের সাথে কথা বলছিলেন। উনি শুধু উত্তরে বললেন– না। তারপর সেই সাংবাদিকের প্রশ্ন, ও তাহলে বোন? রেহনুমা বললেন, আমাকে আমার
পরিচয় জিজ্ঞেস করেন আপনি। মা বোন বানায়ে দিলে তো মুশকিল। সেই সাংবাদিক বললেন, ও আপনি মা বা বোন না। আমি ভেবেছিলাম মা বা বোন হবেন হয়তো। তাহলে কেন এসেছেন? যাক মা বোনইতো বলেছি, সমস্যা নাই। রেহনুমা বললেন, না সমস্যাতো আছে। পরিচয়ে কন্যা জায়া জননীর বাইরে যেতে পারতে হবেতো। সমস্যা নাই বললে হবে? সেই সাংবাদিক এসব কথায় কোন রকমের আগ্রহ না দেখিয়ে, আর কোন কথা না বলে চলে গেলেন।
এই ঘটনা হুট করে মনে পড়ে গেলো সহকর্মী নাদিয়া শারমিনের ওপর আক্রমনের পর। নারীর পেশা, নারীর পরিচয় কেমন করে পাল্টে যায়, সেটাই ভাবছি। আমার যাবতীয় অফিসিয়াল কাগজপত্রে আমার পেশা সাংবাদিকতা লেখা আছে। আমার কর্মক্ষেত্রের পরিচয়পত্রে সিনিয়র রিপোর্টার লেখা আছে। কিন্তু সেটা কিভাবে সিনিয়র নারী রিপোর্টার হয়ে যায় সে প্রশ্ন নিয়েই বর্তমানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছি। আশা করি নাদিয়া নিজে কর্মস্থলে ফিরে এসেও এ প্রশ্ন উত্থাপন করবে।
এই লেখার শিরোনামে ’নারী হতে আপত্তি নেই’ কেন বলছি সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমি কখনোই ’পুরুষ’ হওয়ার আশা ব্যক্ত করি না। বা নারীত্বকে অবমাননা করি না। বা পুরুষের মতো করে নারী হয়ে উঠতেও চাই না। একজন নারীর নারী হতে পারার যে শক্তি তা আমাকে বরাবরই আলোড়িত কওে, গর্বিত করে। অর্থাৎ সোজা কথায় আমার নারী হওয়া নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাই। কিন্তু আমার পেশাগত জায়গাকে নারী পুরুষের ভেদরেখা দিয়ে বন্দি করতে আমি রাজি না।
নাদিয়াকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আক্রমণ করা হয়েছে, বিভৎস আক্রমণ। কতগুলো ভীষণরকমের ’পুরুষ’ রাস্তায় তাকে ধাওয়া কওে পিটালো। কেন? লোকমুখে (কারণ হেফাজতে ইসলাম অস্বীকার করেছ ঘটনা) জানা গেলো তাদের যুক্তি– পুরুষের সমাবেশস্থলে নারী কেন? আচ্ছা বেশ। কিস্তু সেই ধারণাকে আমরা পুনরুৎপাদন করি যখন বলি– নারী সাংবাদিকের ওপর হামলা। আমরা এই অবস্থান কেন নিতে পারলাম না যে– একজন সাংবাদিকের ওপর হামলা। তারপর বিস্তারিত আলাপে– নামে ছবিতেতো বুঝাই যেতো যে নাদিয়ে শারমীন একজন নারী। তারা নাদিয়াকে পিটালো নারী হয়েও সেখানে উপস্থিত হওয়ার খোড়া অভিযোগে আর আমরা সেই একইভাবে তাকে ’নারী সাংবাদিকের’ গন্ডিতেই বেধে রাখলাম।
এটাও ঠিক, সেইদিন একইধরনের লোকজন অনেক ’পুরুষ সাংবাদিক’ এর পোশাক টেনে সেদিন ছিড়ে ফেলেছে। একজনকে ধাওয়া করা হয়েছে কেবলমাত্র সে একটা ’প্রগতিশীল’ চ্যানেলে কাজ কওে বলে। এটিএন নিউজ এর রিপোর্টার ও ক্যামেরা পারসনকে আক্রমণ করেছে। অনেকে পরেরদিন গল্প করেছেন কিভাবে পরিচয়পত্র লুকিয়ে, বুম ফেলে কোনমতে আত্মরক্ষা করেছেন। আমার সহকর্মী সেদিন তার সাথে পরিচয়পত্র রাখেনি। এটা কেবল নারী পুরুষ, মাথায় ওড়না থাকা না–থাকা এসবের ভিতর দিয়ে বুঝলে আখেরে খারাবি আছে। এটা সাংবাদিকতা পেশার ওপর আক্রমণ। সেইদিক বিবেচনা করছি না বলেই কিন্তু বারবার আঘাত করার সাহস পাচ্ছে প্রতিপক্ষ।
এখানে দুটো বিষয় আছে। নারীর ক্ষেত্রে অধিকার ও সমতার প্রশ্ন এবং আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। এদুটোর পার্থক্য জানা থাকে না বলেই সাংবাদিককে দুইভাগে ভাগ করে বলা হয়। এক. সাংবাদিক, দুই. নারী সাংবাদিক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অধস্তন করে রাখার যে প্রক্রিয়া চলে এসেছে, সেই জায়গায় নারী পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে, বর্তমান সময়ে নারীকে একটু বাড়তি সুবিধার ভিতর দিয়ে নিতে হবে। এই ‘বাড়তি সুবিধা’, ’সংরক্ষিত সুবিধা’ দেয়া আর তার আত্মপরিচয়কে গিলে খাওয়া এক বিষয় না। আমার প্রশ্ন দ্বিতীয় অংশ নিয়ে–আত্মপরিচয়।
পেশাগত জায়গায় এই অপর বানিয়ে দেওয়া কাজের কথা না। সাংবাদিকের বিপরীতে আমার পরিচয় যখন হয় নারী সাংবাদিক তখন অপরের অনুভুতি চাঙ্গা হতে বাধ্য। আরেকটা ঘটনা বলি। একবার ছাত্রশিবির বামপন্থী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালালো অতর্কিতে। আক্রান্ত হয়েছিলো অনেক কর্মী। পরের দিন পত্রিকায় বিবৃতি গেলো নারী কর্মীদের ওপর আক্রমণ কেন সেই প্রতিবাদে। আরে ভাই, নিজ চোখে দেখলাম ’পুরুষ কর্মীরা’ও আক্রান্ত হয়েছে। অথচ কেবল নারী কর্মীদের গায়ে আচড় লাগা নিয়ে আপত্তি। নারী কে পুজি করে সহানভূতি আহ্বান? নারীরা আন্দোলনে নামবে কিন্তু তাদের দেখেশুনে রাখতে হবে, তাদের আক্রান্ত হওয়া যাবে না এমন দায়িত্ব ’পুরুষ যোদ্ধাদের’ কে দিয়েছে?
লেখা তৈরী হচ্ছে। শেষ হলে আরেকটা পোস্ট দিব..
*লেখক পরিচয়– একজন নারী। যিনি সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারার বাসনায় গত ৯ বছর সাংবাদিকতা করছেন
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply