সায়দিয়া গুলরুখ*
দশম রোজা। ইফতারের ঘণ্টাখানেক পরে আজিজ সুপার মার্কেট থেকে রিকশায় বাসায় ফিরছি। রাস্তাঘাট তখনও ফাঁকা। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ক্রসিং দিয়ে রিকশাচালক মিরপুররোড ক্রস করলেন। রাস্তা খালি ছিল। ধানম-ীতে না ঢুকে মিরপুর রোডেই রিকশা টানলেন। হঠাৎ বাতাস ফুঁড়ে এক ট্রাফিক পুলিশের উদয়। এক হাতে ব্যাটম্যানের সেই রঙ্গীন লাঠি, অন্য হাতে লম্বা মোটা স্ক্রুড্রাইভার। স্ক্রড্রাইভারটি সাধারণ নয়। হাতলে লাগানো আছে ধারালো সূচঁ। ট্রাফিক পুলিশকে দেখে রিকশাচালক আরও জোরে চাকা ঘুরালো। আমি ভাবলাম বুঝি পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। দুই মুহূর্ত পরেই রিকশাচালক চলস্ত রিকাশা থেকে উড়ে তিন হাত দুরে গিয়ে পড়ল। পেছন থেকে অদৃশ্য হাত রিকশা টেনে ধরেছে। মনে হবে রজনীকান্তের কোনও তামিল ছবির দৃশ্য। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমি ঝপাত করে মাটিতে পড়লাম। চোখের কোণে দেখতে পেলাম রিকশাচালক তখনও দৌড়াচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ আমাকে কিছু বলার আগেই আমি রিকশায় উঠে বসলাম।
ঃ রিকশাচালকের ভুল হয়েছে ভাই, আমি অন্যমনস্ক ছিলাম খেয়াল করিনি। মাপ করে দেন।
আমার কথায় ভ্রƒক্ষেপ না করে, ট্রাফিক পুলিশ উদ্যত হল চাকা পাংচার করতে। ইতিমধ্যে রিকশাচালক ঘুরে এসেছেন। দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আবারও বললাম,
ঃ রিকশাচালকের ভুল হয়েছে, এবারের মতন মাপ করে দেন।
ট্রাফিক পুলিশ আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপল, চোখ টকটকে লাল, অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে।
ঃ আপনি রিকশা থেকে নামেন, অন্য রিকশায় যান। এটা অবৈধ রিকশা।
ঃ আপনি জানলেন কি করে, কাগজতো দেখতে চাননি। বলছিতো ভাই, ভুল হয়ে গিয়েছে, এইবার মাপ করে দেন।
ঃ আমি জানি, আপনি খামাখা বার্গেন করেন না। নামেন।
ট্রাফিক পুলিশ আবারও উদ্যত হল চাকা পাংচার করতে।
ঃ ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি, শুধু আমাকে বলেন চাকা পাংচার করার কথা কোন ট্রাফিক আইনে লেখা আছে?
ঃ আপনাকে আমার আইন শিখাতে হবে!! আমার আইন আমি জানি।
ঃ আমিতো আইন না শুনে রিকশা থেকে নামবো না।
ঃ তাহলে চলেন থানায় চলেন।
এই পর্র্যায়ে রিকশাওয়ালা রিকশার কাছে আসলেন। রিকশা টানতে শুরু করলেন।
ঃ আপনি খামোখা বার্গেন করছেন।
ধানম-ী থানায় এনে রিকশা ঢুকানো হল। থানার সামনে সাদা পোশাকের পুলিশ, ডিবি, ইনফরমার মিলে আরও গোটা তিরিশজনের জটলা। সকলেই পুরুষ। রিকশাওয়ালা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সাদা পোশাকের একজন পুলিশ ওয়াকি-টোয়াকি হাতে এগিয়ে আসল। আমি রিকশাতে গ্যাট হয়ে বসে আছি।
ঃ আপনি আগে আপনাদের অফিসারের বয়ান শুনে নেন, তারপর আমি আমার যা বলার বলব।
ট্রাফিক পুলিশটি আমি রিকশা থেকে পড়ে যাওয়া বাদে আদ্যপান্ত সব ঘটনা বলল। আমি হাসিমুখে শুনলাম। একজোড়া লোভী রক্তচক্ষুর বদলে এখন গোটা তিরিশেক চোখ আমার উপর নিবিষ্ট। সাদা পোশাকের পুলিশটি ঘটনা সামাল দেয়ার দায়িত্ব নিলেন।
ঃ কি ঘটেছে সেটার বিস্তারিত বর্ণনায় আমি যেতে চাই না। আপনাদের অফিসার রিকশাচালককে নাগালে পেলে মারধর করতেন এবং আমার সামনে তিনি চাকা পাংচার করতে উদ্যত হয়েছেন, আমি ওনার কাছেও জানতে চেয়েছি, আপনার কাছেও জানতে চাই, কোন ট্রাফিক আইনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে চাকা পাংচার করার কথা বলা আছে সেটা আমাকে বলেন, আমি চলে যাই।
ঃ আপা, রিকশাইতো অবৈধ, অন্য আইন দিয়ে কি করবেন?
ঃ আপনার অফিসার কাগজ দেখতে চায়নি, আপনিও চাননি, কিভাবে জানলেন অবৈধ?
ঃ আপা আসেন, চা খান। ভেতরে গিয়ে বসেন, আলাপ-আপ্যায়ন করি। ঢাকা শহরে মাত্র ৮৬ হাজার রিকশার পারমিট আছে, রাস্তায় চলে ১৪ লক্ষ্য রিকশা। আমাদের কাগজ দেখা লাগে না।
ঃ ৮৬ হাজার বৈধ রিকশার বিপরীতে ১৪ লাখ রিকশা চলে, আপনাদের ট্রাফিক কণ্ট্রোল ব্যাবস্থারতো দেখছি বেশ দুর্গতি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি চা খাব না, ১৪ লাখ অবৈধ রিকশার হিসাব আপনার কাছেই রাখেন, আমাকে শুধু রিকশাচালককে পেটানো আর চাকা পাংচারের আইনের হিসাবটা বুঝিয়ে দিন। আমি চলে যাই।
আমি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি আমাকে রিকশা থেকে নামানোই ওদের পরিকল্পনা। আমি রিকশা থেকে নামবো না বুঝে, নতুন তরিকায় এগুবার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। একজন স্মার্ট লুকিং পুলিশ এবার ভিড় ঠেলে সামনে আসলেন।
: May I know your name and address please?
: Give me a piece of paper, I will write it down for you.
May I know your profession please.
I am a researcher, writer.
I hope.. you know that you have also broken a law.
আপনি রিকশাওয়ালাকে মিরপুর রোডে চলতে দিলেন কেন। আপনারতো বলা উচিত ছিল।
এইবার আমি হাসলাম। হেসে ভিড়ের পেছন থেকে যে ট্রাফিক পুলিশ আমাদের থানা পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, তাকে বললাম,
ঃ ভাইজান, আপনি কি দয়া করে বলবেন, আমি আপনার কাছে কতবার বিনীত ভাবে ক্ষমা চেয়েছি। যাই হোক, এখন বলুন, আমি এবং আমাকে বহনকারী রিকশাচালক কি কি আইন ভঙ্গ করেছি ও আমাদের প্রাপ্য সাজা কি? আপনাদেরও সময় নাই, আমারও সময় নাই। পরবর্তী করণীয় কি?
আবার আগের সাদা পোশাকের পুলিস অফিসার এগিয়ে আসলেন।
ঃ আরে আপা, শুধু আইন দিয়ে কি চলে। আপনিও জানেন। আমিও জানি। এই ধরেন, রাস্তার ধারে যে পেসাব করে এটারতো আইন আছে। আমরা কি তাই বলে, এই আইন প্রয়োগ করতে যাই?
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, এমন পরিস্থিতিতে মুখ ফসকানো এক্কেবারেই ঠিক না।
ঃ কেন আইন প্রয়োগ করেন না? চাকা পাংচার করার যন্ত্র দিয়ে পাছার মধ্যে মারেন না কেন? পুরুষ বলে? নাকি আপনারা নিজেরাও এই আইন ভঙ্গ করেন বলে! যাকগে, এখন আমাদের কোন আইনে কি কি শাস্তি/ জরিমানা বলেন, আপনার নিশ্চয় আরও বড় অপরাধ মীমাংসা করার ব্যাপার আছে।
আমার মুখ ফসকানো কথাতে উপস্থিত পুরুষ দর্শকের কেউ কেউ হঠাৎ হেসে উঠল। পরক্ষণেই বুঝল, এই বেমক্কা হাসি ঠিক হয়নি। নিজেদের embarrassment ঠ্যাকানোর জন্য বা আমাকে অন্য রাস্তায় কাবু করার জন্য সেই স্মার্ট লুকিং পুলিশকে বলতে শুনলাম,
ঃ মেয়েমানুষ দর্শক পেয়ে নাটক আর বন্ধ করে না। ফালতু।
ঃ সেই তখন থেকে আইন আইন করে যাচ্ছেন, আইন কেউ মানে না। তাই অন্য রাস্তা বের করতে হয়।
জটলার পেছনের স্মার্ট লুকিং পুলিশের কথাটা তীরের মতন গায়ে বিধলেও, গায়ে না মাখার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঃ ঠিকই বলেছেন। কথা শুনে না, তাই ক্রসফায়ার করে দেন। কথা শুনে না, তাই চাকা পাংচার করে দেন। তো, রিকশার চাকা পাংচার করার কোনও আইন যখন নাই, এখন আমাদেরকে কি করতে হবে বলেন।
ঃ আইন না থাকলেও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। আপনার সাথে বেহুদা কথা বলতে চাই না। আপনার honor-এ ছেড়ে দিলাম রিকশাওয়ালাকে।
ভীড়ের একজনকে রিকশার নম্বর, রিকশাচালকের নাম ঠিকানা লিখে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি সরে দাঁড়ালেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ইচ্ছা করে আস্তে আস্তে করে খাতায় তথ্য লিখে নিতে শুরু করল। এই ফাঁকে তিরিশ জোড়া চোখ আবার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপতে থাকল। আমি ব্যাগের ভিতর থেকে অরুন্ধতী রায়ের An Ordinary Persons Guide to Empire বের করে পড়তে শুরু করলাম। আজকাল যে দুটা বই পড়ছি, তার মধ্যে অরুন্ধতীর এই বইটা, আর অন্যটা খালেদ হোসেইনির The Kite Runner। ভাগ্যিস, আজকে অরুন্ধতীর বইটাই ছিল ব্যাগের মধ্যে। পুরুষের চোখ মোকাবিলায় ঢাল হিসেবে খুবই কার্যকর। অরুন্ধতীর লেখার অক্ষর, শব্দ, বাক্যগুলি নেচে নেচে আমাকে আত্মবিশ্বাস যোগান দিল। দশ মিনিট পর রিকশাচালককে ছাড়া হল। আমরা থানা থেকে বেরিয়ে আসলাম। রিকশাচালক এত জোরে জোরে প্যাডেল করছিল মনে হল, এইবার নির্ঘাত একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। পেছনে শুনতে পাচ্ছিলাম পুরুষতন্ত্রের গান…”মেয়েলোক, হাতাকাটা জামা, মুখের কি ভাষা…ছেনালী কোথাকার…বড়লোকের মেয়ে…”
পরদিন।
আমার গবেষণার কাজে ধানম-ী থেকে বারিধারা যাবার পথে গাড়িতে বসে এই নোটটা লিখছি। সাতাশ নাম্বারের সিগন্যালে গাড়ি থেমেছে। হঠাৎ আমাদের গাড়ীচালক আমাকে বললেন, আপা দ্যাখেন, দ্যাখেন, ট্রাফিক সার্জেণ্ট কি করছে? আমি চোখ তুলে দেখলাম, পুলিশ বাক্সের জানালা দিয়ে একটা ইউনিফর্ম পরা হাত সিগন্যালে দাড়ানো ছোট পিকআপ/ভ্যান ধরণের গাড়ির পিছন থেকে মাম কোম্পানির পানির বোতল তুলে নিচ্ছে Ñ একটা, দুইটা, তিনটা…।
*সায়দিয়া গুলরুখ পিএইচডি গবেষক। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের এ্যাক্টিভিস্ট।
Categories: যাপিত জীবন
Leave a Reply