সায়দিয়া গুলরুখ
তৃতীয় দৃশ্য।
ঢাকা শহরের জনদরদী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কল্পস্কোপি পরীক্ষাকক্ষকে দৃশ্যায়ন করা হবে। এই দৃশ্যে আছে চারটি চরিত্র। চারজনই নারী। একজন ডাক্তার। একজন নার্স। একজন আয়া। এবং একজন রোগী। ডাক্তারের পরনে গোলাপী সালোয়ার কামিজ। মাথায় ওড়না। চোখে প্রচন্ড বিরক্তি। চশমা না থাকলে যে কেউ বিরক্তির আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে। হাতে বেশ কটা সোনার আংটি। নার্সটির পরনে হাসপাতালের ইউনিফর্ম। আকাশী নীল রঙের সালোয়ার কামিজ। রোগীকে অভ্যার্থনা কক্ষ থেকে কল্পস্কোপির রুমে আনার দায়িত্ব নার্সের। আয়ার পরনে গাড় নীল রঙের ইউনিফর্ম। রোগীর পরনেও ডাক্তারের মতন সালোয়ার কামিজ। নার্স ও আয়াকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা ঠিক জানেন না, তাদের কি করণীয়। কল্পস্কোপির রুমটা ছোট্ট। সাথে লাগোয়া বাথরুম। এক পাশে টেবিলের উপর পুরানো মডেলের ডেস্কটপ। টেবিলে বেশ কিছু ফাইল। আর অন্যদিকে রোগীর জন্য একটা উঁচু টেবিলের মতন দেখতে বিছানা রাখা। টেবিলটির পায়ের কাছে বড় একটা যন্ত্র। যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা সায়েন্স ফিকশন মুভির বামুন সাইজ রোবটোর মতন। উপরের অংশের কম্পিউটার স্ক্রীনটা হল রোবটের মাথা। চারটা পা। একটা হাত, একটাই আঙ্গুল। আঙুলের নখ একটা ম্যাগনিফায়িং লেন্সসহ ক্যামেরা। ডাক্তার নারীর যোনীতে এই ক্যামেরাটি ঢুকিয়ে সাধারণত সার্ভিক্স, ভালভার ম্যাগনিফাইড ইমেজ উৎপাদন করে।
মঞ্চে একটা লাইট। লাইটটা রোগীর জন্য পাতা খালি বিছানায় ফোকাস করা। বৃত্তাকার আলোর প্রান্তে কালো চেয়ারে বসা ডাক্তারের বিরক্ত মুখ দেখা যাচ্ছে। অস্থির, পা দুলাচ্ছেন। নার্স রোগীর ফাইল ও রোগীসহ মঞ্চে প্রবেশ করে। ত্রিশ সেকেন্ড পরে আয়া এসে ঘরে ঢোকে। রোগীর চোখে-মুখে স্পষ্ট বিপন্নতার ছায়া। মঞ্চ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায়। ত্রিশ সেকেন্ডের অস্বস্তিকর নীরব-অন্ধকারাচ্ছন্নতা। আয়ার উপর আলো জ্বলে ওঠে।
ঃ পায়জামা খোলেন
ঃ আহ্হা! প্যাণ্টিও খোলেন
মুহূর্তেই আয়ার উপর আলোটি নিভে যায়। পরক্ষণেই নার্সের উপর আলো পড়ে।
ঃ বিছানায় গিয়ে শোন।
ঃ না, চাদর দিতে পারবো না।
ঃ আরো নীচে যান, হ্যা পা ফাঁক করেন, বেশি করে ফাঁক করেন না।
ঃ আহ্হা! আরেকটু নীচে যান।
নার্সের উপর আলোটি নিভে যায়। পরক্ষণেই ডাক্তারের টেবিলের আলোটি জ্বলে ওঠে। ডাক্তার আয়ার এগিয়ে দেয়া প্লাস্টিকের গ্লাভস পড়ে নেয়। হেটে রুমের অন্য প্রান্তে রোগীর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আলো ডাক্তারের সাথে সাথে চলে। আয়া একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। আধানগ্ন রোগীর যোনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ারে বসেন তিনি। নার্স এবং আয়া পাশে দাঁড়ানো। রোগির যোনীতে ক্যামেরা ঢুকিয়ে ডাক্তার রোগীর সাথে কথা বলছেন। কম্পিউটার ¯œীনে যোনীদেশ ও ডিম্বাশয়ের ছবি প্রজেক্টরের মাধ্যমে মঞ্চের দেয়াল জুড়ে ভেসে ওঠা। প্রজেক্টরের আলো ছাড়া সব আলো নিভে যায়। দেয়াল জুড়ে, এমাথা-ওমাথা ছড়ানো, একটি নারীর যোনিদেশের ছবি। একটা গুহা মুখ। গোলাপী মাংস। পিঁপড়ার মতন কালো কালো বাল। আর সরু সরু লাল শিরা-উপশিরা। আধা মিনিট পরে মঞ্চ আবার আলোকিত হয়। ডাক্তারের মুখ আর রোগিনীর অনাবৃত ফাঁক করা পা দেখা যায়।
ঃ পরীক্ষা করতে এসেছে!
ঃ চুল ফেলে আসবেন না? পরিষ্কার করেনি, দ্যাখো কান্ড!
বাসর রাতে অপরিষ্কার যোনি দেখে স্বামী যেমন চমকে ওঠে, নিরাশ হয়, ডাক্তারের চেহারাও ঠিক তাই। অপমান সত্ত্বেও ফিক করে হেসে ফেলে রোগী। মঞ্চের বাইরে থেকে রোগীর মনের ভাবনাগুলো একটি নারীকণ্ঠ ফিসফিস ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য দেয়ার মতন করে বলে যায়। রোগী যখন মনে মনে কথা বলে, তখন মঞ্চের অভিনেত্রীরা নীরবে কাজ করে। ডাক্তার ক্যামেরা নাড়া-চাড়া করে। যন্ত্রের চোখ যোনিদেশে ঘোরা-ফেরা করে। পিতৃতন্ত্র কণ্ঠ পায়।
ঃ কি, বাচ্চা হয় না?
ঃ সার্ভিসাইটিস আছে?
ঃ হুমম..সাদা সাদা লাগছে
ঃ আপনার বায়োপসি করতে হবে
ঃ মর্জিনা, ওনার সাথে কে এসেছেন? তাকে আরও এক হাজার টাকার রিসিট কাটতে বল।
ঃ কি? একা এসেছেন!
ঃ আরেকটু পা ফাঁক করুন!
ঃ রিপ্রোডাক্টিভ অর্গানের কাজ হচ্ছে সন্তানের জন্ম দেয়া
ঃ আপনিতো কোনও সহযোগীতা করছেন না! ব্যাথাতো পাবেনই।
ক্যামেরার যোনিদেশে নড়াচড়ার সাথে সাথে প্রজেক্টরের ছবিও মঞ্চের দেয়ালে নড়াচড়া করে। রোগীর মুখে উষ্মা ও ব্যাথার ছাপ। অযতেœর হাতে ডাক্তার তার যোনীর ভিতর ক্যামেরার তার ঘোরায়। রোগী উফফ্ করে ওঠে। ডাক্তার ভ্রক্ষেপ করে না। নির্বিকার, যন্ত্রের চক্ষু দিয়ে রোগীর সার্ভিক্সের ছবি দেখে। স্ক্রীণে ভেসে ওঠে টকটকে লাল-গোলাপী শিরায় মোড়ানো সার্ভিক্সের ছবি।
ঃ বুঝলেন, জরায়ু ব্যাবহার না করে ফেলে রাখলে আজকে ক্যান্সারের দুশ্চিন্তা
কালকে সিস্ট
পরশু ফাইব্রয়েড
ঃ আহ্হা! পাটা ফাঁক করুন! রিল্যাক্স করুন। কাঠের পুতুলের মতন পড়ে আছেন, ব্যাথাতো পাবেনই।
ডাক্তারের টেবিলে শুয়ে শুয়ে রোগীর ডেট রেপের (ফধঃব ৎধঢ়ব) কথা মনে হয়। অন্তরঙ্গ মুুহুর্তে যদি পরিচিত পুরুষ বেপরোয়া হয়ে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করে তাকে অনেক সময় সম্মতির সম্পর্কে ধর্ষণ বলা হয়। কল্পস্কোপির টেবিলে শুয়ে রোগীর ডেট রেপের কথাই মনে হয় বারবার। অসুস্থতার কারণে সে নিজে পয়সা দিয়ে ডাক্তারের টেবিলে শুয়েছে, এই কল্পস্কোপি পরীক্ষাতে সম্মত হয়েছে। শরীরের উপর যন্ত্রের হাত-চোখের রূঢ় চলা ফেরা, অপমানের উত্থাল-পাত্থাল, চেনা-জানা পরিসরে এভাবেই বুঝি চলে অনাচার। অপমানে “উফফ্” করে ওঠে।
আয়া রশিদটি নিয়ে মঞ্চে পুর্নপ্রবেশ করে। ডাক্তার মুখ ঘুরিয়ে রশিদটি দেখে নেয়।
ঃ আপনার সিস্টের অপারেশনটা কবে হয়েছিল?
ঃ কোন হাসপাতালে করলেন?
ঃ আচ্ছা, ডা. তায়েবা এখন সিস্টেকটমিও করেন!
রোগী ডাক্তারের প্রশ্নের অন্যমনস্ক জবাব দেয়। নিজের ভাবনার জগতেই ডুবে থাকার চেষ্টা করে। ভাবে, নরড়ষড়মু বইগুলো সব সেকেলে হয়ে গিয়েছে। প্রযুক্তির এই জমানায় পুরুষাঙ্গের কত রকমফের! ছোটবেলার বিজ্ঞান বইয়ের কথা মনে পড়ে। টেক্সটবুক বোর্ডের ভাষায় মনের কলমে বই লিখতে শুরু করে। ভুলে যেতে চায়, সে অর্ধনগ্ন শুয়ে আছে ডাক্তারের টেবিলে। মঞ্চের বাইরের নারীকণ্ঠ এই অংশটি আনুষ্ঠানিক, খানিকটা খবর পড়ার ঢং-য়ে পাঠ করে। “বর্তমান যুগে পুরুষাঙ্গ প্রধাণত দুইপ্রকার: জৈবিক ও যান্ত্রিক। যান্ত্রিক পুরুষাঙ্গ আবার কয়েক প্রকার হয়। কোনটা নারীর যৌন আনন্দের জন্য বাজারজাত করা হয়। যেমন ধরা যাক কৃত্রিম পুরুষাঙ্গ, ডিলডো বা ভাইব্রেটরের কথা। এগুলোর অবশ্য বাংলাদেশে তেমন চল নাই। অনেক পুরুষাঙ্গ আবার নারীর দেহকে বশে আনার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে, যেমন কল্পক্সোপি, আল্ট্রাসাউন্ড ম্যাশিনের গায়ে ঝোলানো ক্যামেরা সম্বলিত পুরুষাঙ্গ। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য, ভার্জিনিয়াতে নারীরা এমনই একটা যান্ত্রিক পুরুষাঙ্গের স্বরূপ উন্মোচন করেন। সেখানে গর্ভপাতে আগ্রহী নারীর জন্য ভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসাউন্ড (যোনিপথে ক্যামেরা ঢুকিয়ে ভ্রƒণের ইমেজ উৎপাদন করা হয়) বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।” এখানে ধারাভাস্বকারের স্বর বদলে যায়, রোগীর মনের খেদ ঝরে পড়ে। আইনটির একটি প্রাথমিক খসড়াতে নাকি ক্যামেরার স্ত্রীণটি কোথায়, কোনদিকে রাখা হবে সেটিও উল্লেখিত ছিল। প্রস্তাব করা হয়েছিল, স্ক্রীণটি নারীর চোখের সামনে এমনভাবে রাখা হবে যাতে গর্ভপাতে ইচ্ছুক “মা” প্রাণবন্ত ভ্রƒণের ছবিটি স্পষ্ট দেখতে পায়। সম্ভব হলে, ভ্রƒণের হার্টবিটকে লাউডস্পিকারে বাজিয়ে শুনাতো! আইনপ্রণেতারা বোধহয় ভেবেছিলেন, কোনও মা কি নিজ ভ্রণের হৃদস্পন্দন শুনেও না শোনার ভাণ করে থাকতে পারে! বিতশ্রদ্ধ রোগী ভাবে, কিন্তু ভ্রƒণের ছবি আর হৃদস্পন্দন শুনেও যদি নারীর মনে “মাতৃভাব” জাগরিত না হয়। তখন? তখন কি হবে? তখন কি নারীর অনুভুতিকে বশে আনার জন্য আর কি নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে? এইসব বিতর্কের কথা ভেবে রোগী রাগে-দূঃখে “উহ্” করে ওঠে। মঞ্চের বাইরে ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে ক্রোধ ঝড়ে পড়ে। অনেকেই এ আইনটিকে রাষ্ট্র অনুমোদিত ধর্ষণ (state sanctioned rape) বলছেন।
এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে রোগী একটি র্দীঘ নিশ্বাস ফেলে। হঠাৎ বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চলে যায়। যোনিপথে ক্যামেরার তার ঝুলে থাকে। ডাক্তার হাত গুটিয়ে নেয়। অন্ধকার মঞ্চ জেনারেটরের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। আধুনিক জীবনে নারীদের দুর্ভোগের চেহারা অন্য। ভেবেই গায়ে কাঁটা লাগে। আসলে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছায়ায়, নাকি আগুনে, আগুনই হবে নারীর দেহ পোড়ে। একেক দেশে, একেক অঞ্চলে সেই আগুনের রঙ ভিন্ন। ডাক্তারের অসতর্ক হাতের নড়াচড়ায় রোগীর চিন্তায় ছন্দপতন ঘটে। আয়া, ডাক্তারের ব্যাগ গোছাতে উদ্যত। নার্সটি রিপোর্ট কার্ড এগিয়ে দেয়।
ঃ একটু সাদা সাদা দেখতে পাচ্ছি
ঃ আমি রিপোর্টে লিখে দিয়েছি
আপনার ডাক্তারকে দেখান
ঃ এখন যান, আমার বাসায় যাওয়ার এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে…
সালোয়ার, প্যান্টি পরে রিপোর্ট হাতে, খানিকটা বিভ্রান্ত চিত্তে রোগী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মঞ্চ নাটকের তৃতীয় দৃশ্যটি এখানেই শেষ হয়। মঞ্চের আলো নিভে যায়। প্রজেক্টরে এতক্ষণ যোনিদেশের যে জীবন্ত ছবিটা ছিল তা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আবছা আলোয় মঞ্চসহকারীদের ছায়ার নড়াচড়া দেখতে পাওয়া যায়। পরের দৃশ্যের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করছে তারা। একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চ এনে মঞ্চে রাখে। ঢাকার অদূরে একটি গ্রামে চাঁদের হাসি ক্লিনিকের বারান্দারূপে মঞ্চ সাজানো হচ্ছে। দেয়ালে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রাণালয়ের পোস্টার। অন্ধকারেই ৫ জন নারী মঞ্চে এসে বসে। দুজন অন্তসত্ত্বা। ডাক্তার আপা এখনও আসেননি।…
[একটি মঞ্চ নাটকের অসমাপ্ত পা-ুলিপি, কয়েকটি ছেঁড়া পাতা]
Categories: যাপিত জীবন
Leave a Reply