উম্মে রায়হানা, অতিথি ব্লগার*
খালেদা জিয়ার বক্তব্যে মেজাজ ঠিক রাখা মুশকিল – তাই বলে তাঁর পোশাকের রঙ নিয়ে সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলা ঠিক না – এই বক্তব্য দেওয়ার কারণে আমি ফিমেল শভিনিসট আখ্যা পেয়েছি। এ ধরণের আখ্যা আমার জন্য নতুন নয়। উগ্র নারীবাদী না বলে আমাকে ‘নারীবাদী পুরুষতান্ত্রিক’ও বলেন আমার অনেক বন্ধু । তাঁরা খেয়ালও করেননা উগ্রতার প্রতিশব্দ হিসেবে তাঁরা ‘পুরুষ’ শব্দের ব্যবহার করছেন । অসচেতনভাবেই ‘নারী’র বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে ‘পুরুষে’র বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন স্বয়ং পুরুষ ।
বন্ধুদের নারীবাদী সচেতনতার বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য লিখতে বসি নাই। আমার বন্ধুরা আমার পরিবারের মতই প্রিয় । আমার লেখার বিষয় আপাতত খালেদা জিয়ার গোলাপি লিপস্টিক ও তাকে নিয়ে অরুচিকর প্রচারণাগুলো ।
ব্যক্তি খালেদা জিয়া যে নারীর প্রতিভূ নন – সেটা বোঝার জন্য খুব বেশী বুদ্ধিশুদ্ধি থাকার দরকার পড়ে না। খালেদা জিয়া একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন যে দলটির নারী প্রশ্নে কোন রকম সচেতনতা নাই । নারী সদস্যদের ব্যবহার করা হয় অস্ত্র হিসেবে । নারী সদস্যরা গ্রেফতার হলে সেই ছবি পত্রপত্রিকায় দিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে দোষারোপ করা হয় । সেই সদস্যদের নারী অধিকার বিষয়ে কোন রকম চর্চা করতে দেখা যায় না । যদি দেখা যায়ও সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে – বিচ্ছিন্নভাবে । দলের কোন নীতিমালা নয় ।
খালেদা জিয়া যে সমস্ত বক্তব্য দেন তা ও তাঁর দলের হয়ে দেন । তাহলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার কারণ কি ? সেই প্রশ্নে যাবার আগে একটু দেখি আমি যাকে ‘ আক্রমণ’ বলছি সেগুলি কি রকম এবং যারা এগুলো করছেন তাঁরা এগুলোকে কী বলছেন ।
ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম – ঠিকঠাক উদ্ধৃত করতে পারছিনা বলে দুঃখিত । পোস্টের বক্তব্য হোল – খালেদা জিয়া ও সাইদী বেহেশতের ভিসা দিচ্ছেন । খালেদা জিয়া মুসলমানের সার্টিফিকেট দেবেন । নতুন করে সবাইকে মুসলমানি করাতে হবে। সবাই লুঙ্গি তুলে তাঁর সামনে দাঁড়ান । এই কার্টুনে খালেদা জিয়াকে গোলাপি ম্যডাম বা এরকম কিছু বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য এটা একটা স্যটায়ার । এই পোস্ট দেখে রেগে আগুন হয়ে যাওয়ার অর্থ লোকের কাছে দুইটা হতে পারে –
এক। আমি খালেদা জিয়াকে পছন্দ করি
দুই। আমি একজন নারীবাদী পুরুষতান্ত্রিক বা ফিমেল শভিনিসট
দুইটা ধারণাই সর্বৈব ভুল । খালেদা জিয়াকে পছন্দ করার কোন কারণ নাই । নারীবাদী সচেতনতা ‘শভিনিজম’ নয়, এক রকমের সচেতনতাই। সেটা কারো নাই থাকতে পারে কিন্তু সে আমাকে গালাগাল করতে পারে না। আমি মেল শভিনিজম এর দোষে বন্ধুদের খারিজ করি না । বরং তাদের প্রত্যেকটা আচরনের পেছনে সামাজিকতা, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি বিচার করেই নিজের পয়েন্ট তৈরি করতে চাই।
সে যা-ই হোক । কথা হচ্ছিল খালেদা জিয়াকে নিয়ে । তিনি কি রঙের লিপস্টিক পরলেন, কি ভাবে চুল বাঁধলেন , কি রকম শাড়ী পরলেন – তা নিয়ে কথা বলা যাবে না কেন ? তিনি নারী বলে ? আমার উত্তর হচ্ছে – হ্যাঁ , তিনি নারী বলে। দ্বিতীয় প্রশ্ন আসতে পারে – তিনি তো নারীর প্রতিভূ নন (এটা একটু আগে আমি নিজেই দাবী করেছি) তাহলে তাকে নারী বলে সম্মান জানাতে হবে কেন ? আমার উত্তর হচ্ছে- তিনি ব্যক্তি নারী বলে ।
আমি উত্তরগুলো দিয়েছি – এবার যুক্তিগুলো দেই –
সাইদীর দাড়িতে মেহেদির রঙ নিয়ে কোন কথা বলা হয়না ।
তার কারণ প্রথমত , দাড়িতে মেহেদি লাগানো নবীর সুন্নত বলে এবং দ্বিতীয়ত – তিনি পুরুষ বলে । ধর্ম ও লৈঙ্গিক পরিচয়কে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে সাইদী তার সাজসজ্জা বিষয়ে সমালোচনা থেকে বেঁচে গেছেন ।
বিপরীতক্রমে, খালেদা জিয়া অনেক রঙের শাড়ীই পড়েন । বলা ভালো পৃথিবীতে এমন রঙ খুব কম আছে যে রঙয়ের শাড়ী তিনি পড়েননা । কিন্তু বলার সময় সবাই গোলাপিকে প্রাধান্য দিচ্ছে ।
এর কারণ প্রথমত – গোলাপি রঙয়ের পশ্চিমা ব্যখ্যা । পুঁজিবাদী শক্তিগুলো নারীর ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের রঙয়ে গোলাপির আধিক্য দিয়ে গোলাপির এই কনোটেশন প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে। এই ব্যখ্যা অনুযায়ী – গোলাপি নারীত্বের প্রতীক, ফেয়ার এন্ড লাভ্লীর রঙ যেমন। যারা গোলাপি রঙ পছন্দ করেন তাঁরাও খালেদা জিয়ার গোলাপি রঙকে সমালোচনা করছেন।
দ্বিতীয়ত এবং প্রধানত তিনি নারী বলে। সামাজিকীকরণ থেকে আমরা শিখি একজন নারীর সৌন্দর্য তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মূলধন। সে এর চর্চা করে বা করতে বাধ্য হয় । ফলে একজন নারীর এই মূলধন নিয়ে কথা বলাই যেতে পারে । তিনি যদি স্মার্টলি শাড়ী না পড়তেন তাহলে এঁরাই আবার তাকে ‘গ্রাম্য’ ‘খ্যাত’ ইত্যাদি বলে গালাগাল করতেন। মোট কথা কোন রকম ভাবেই সাজসজ্জা করে তিনি সমালোচনা থেকে বাঁচতে পারতেন না।
শুনেছি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ‘শুয়োরের বাচ্চা গদি ছাড়, গদি কি তোর বাপ দাদার’? – এরকম শ্লোগানও দেওয়া হয়েছে । কিন্তু তাঁর পোশাক আশাক নিয়ে কোন কথা বলা হয়েছিল কি ? আমার জানা নেই ।
*উম্মে রায়হানা : স্নাতকোত্তর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply