ঋতুপর্ণ স্মরণে: ‘শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না।’

আলোকচিত্র:ইন্ডিয়া টুডে

আলোকচিত্র:ইন্ডিয়া টুডে

বন্যা মির্জা, অতিথি ব্লগার*

চিত্রাঙ্গদা করবার ভাবনাতে নানাকিছু কাজ করছিল ঋতুপর্ণের মাথায়। প্রথম দৃশ্য কী হবে তা নিয়ে নানাভাবে ভেবেছিল। একটা থালায় গুণটা নিয়ে মদনের কাছে গেছে চিত্রাঙ্গদা, ছিলাটাকে ছাড়িয়ে নিতে। বোঝাতে চেয়েছে ‘আমি আমার পৌরুষ দিলাম, এর বিনিময়ে আমায় রূপ-লাবণ্য দাও।’ যেভাবে শুরুতে ভাবছিল সেভাবে আর হয়ে ওঠেনি। এখানে যে একটা জেন্ডার ইস্যু লুকিয়ে ছিল তা নাকি নিজেই বোঝেনি! আসলে কি তাই? না মনে হয়। ও ‘হয়তো’ চেয়েছিল আরও স্পষ্ট করে সেই কথাটি ছবির ভিতর দিয়ে বলতে। নিজেই হয়তো স্পষ্টতায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আমার মনে হয় তার জায়গাতে ঋতুপর্ণ প্রখরভাবে সুস্পষ্ট ছিল।

একজন নারীকে সকল কিছুতে পুরুষের সমকক্ষ হতে হবে? অথচ নারী তার নিজস্ব সত্তায় থেকে নারী হিসেবে যে বাঁচতে পারবে সেই সুযোগ তো সমাজ তাকে দেয় না। অন্যদিকে, পুরুষতান্ত্রিকতার সুবিধাটাও নেয়া ঠিক মনে করেনি ঋতুপর্ণ। ঋতুপর্ণ কখনো আলাদা করে শাড়ি বা আলাদা করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরেনি। পরেছে এমন কিছু যা কিনা মাঝামাঝি। যে কেউ পরতে পারেন। কোনো একটি লিঙ্গ বিশেষের পোশাক নয়, বরং এমন একটা পোশাক যা এই সীমারেখাকে ছাপিয়ে যায়। এসব উদ্যাপনে ঋতুপর্ণ’র ছিল এক নির্লিঙ্গ অবস্থান। সেটা প্রকাশে ও ছিল সাহসী, দ্বিধাহীন এবং অহংকারী।

ওর ছবিতেও তাই মানবিক সম্পর্কের জায়গা খুব পরিষ্কার, খুব স্পষ্ট উপস্থাপনে। ছিল সমকামিতার প্রকাশে বা নারী-পুরুষ সম্পর্কেরও। নিজের জন্য গয়না বা কাজল-কালো চোখ অথবা তার পোশাক সকল কিছুতেই পষ্টাপষ্টি ট্রান্স-জেন্ডার আইডেন্টিটিকেই প্রকাশ করেছে। কলকাতার বাংলা সিনেমায় সে-ই প্রথম হোমোসেক্সুয়্যালিটিকে দেখিয়েছে সুস্পষ্ট আঙ্গিকে। আর তাই মনে হয় দর্শকের সাথে ঋতুপর্ণ’র সম্পর্ক ছিল দ্বিধাবিভক্ত। দর্শকরা কখনো ঋতুপর্ণর ছবি দেখে খুব ভাল বোধ করেছেন, আবার কখনো হয়েছেন অপ্রস্তুত। নানান ধরনের প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে প্রতিনিয়তÑতার মেয়েলিপনা নিয়ে।

নিজের চরিত্রে অভিনয় যে ততটা সহজ কাজ নয় তা ঋতুপর্ণ বুঝেছিল। যা নিজের সত্তায় জাগ্রত তা নিজস্ব। অভিনয় আলাদা বিষয়। তবুও দর্শকের প্রশ্ন কখনো তাকে অস্বস্তিতে ফেলেনি। খুব অনায়াসে নিজের অবস্থানকে আইডেন্টিফাই করতে পারত সে। বলতে পারত “আমাদের মতো মানুষ, যারা কিনা আলাদা, এক অর্থে বিশেষ।” আর এই অনুভূতিটা বোঝার সাথে সাথে এই জীবনটাকে সে সেলিব্রেটও করেছিল অনায়াসে। অনেক সমকামীদের তিরস্কারও শুনতে হয়েছে তাকে। কারণ অন্যরা যা পারেননি, তা সে উদ্যাপন করছিল সহজে। এই জোরটা সে পেয়েছিল বাবা-মা’র কাছ থেকে। তার বাবা-মা তাকে বলেছিল ‘শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না।’ একজন মানুষ নিজেকে নিউট্র্যাল রাখতে চেয়েছিল, পেরেছিলও। না নারী, না পুরুষ। নিজের এই অবস্থানটাকে ঋতুপর্ণ দেখেছে এ্যাক্টিভিজম হিসেবে।

ঋতুপর্ণ চলে গেল, পরশুদিন। ফেসবুকের অসংখ্য স্ট্যাটাস চোখের সামনে, বারবার মন ভারী হয়ে যাচ্ছিল। কাজে মন বসানো যাচ্ছিল না কিছুতেই। ৪৯ বছরের একটা লোক এভাবে চলে যাবে? যেতেই পারে! ঋতুপর্ণ’র ছবি আমি মিস করব না। আমি ঋতুপর্ণ’র সিনেমার ভক্তও ছিলাম না, অভক্তও ছিলাম না। কিন্তু ঋতুপর্ণ যেভাবে নিজের সত্তা হাজির করত দৃঢ়ভাবে, স্পষ্টভাবেÑছবিতে, ইন্টারভ্যুতে, লেখায়Ñএত স্পষ্ট, এত স্বতন্ত্র, এত তীক্ষè, এত নিজস্ব আবার এত সর্বজনীন সঙ্কট নিয়ে, আমি তা খুব মিস করব। ঋতুপর্ণ একটা যাত্রা শুরু করেছিল তার মাথায়, সেই যাত্রা হয়তো তার শেষ হয়েছিল। কিন্তু তার যাত্রার একাংশ ছিল অনেকের যাত্রাপথ বানানোর। কেবল মস্তিষ্ক দিয়েই একটা সত্তা তৈরি হয়, যৌনসত্তাও। ঋতুপর্ণ সেটা প্রমাণ করেছিল।

* বন্যা মির্জা, নাট্যশিল্পী



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

3 replies

  1. ঋতুপর্ণ: ১টা বর্ণময় চরিত্র। লেখা দিয়ে বা কথায় ওকে বাঁধা যাবে না।

  2. আমার মন্তব্য বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করে দিলাম। আমি এখনো ইউনিকোডে লিখতে স্বচ্ছন্দ নই বলে প্রথম বারেই এই কাজটি করতে পারি নাই বলে ক্ষমাপ্রার্থী:

    ‘বনমালী গো তুমি পরজনমে হইও রাধা’ – এই আকুতি ও দোদুল্যমানতা ঋতুপর্ণের শেষ দুটি ফিল্মে ভীষণভাবেই উচ্চকিত। তার লিঙ্গীয় সংবেদনশীলতা – যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘লিবেরাল’ ও ’আরবান’ পটভূমির উপমা ও উৎপ্রেক্ষা দিয়ে সীমায়িত – প্রায় সব ফিল্মেই আছে। পরিচালক হিসাবে তিনি তার ফিল্মের অভিনেত্রীদের জন্য অসম্ভব ভালো শিক্ষক ছিলেন। শেষ দুটো ফিল্ম বাদেও নারীর বয়ান অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে নির্মাণে আর তার মত করে প্রতিবাদের অভিব্যক্তি তৈরি করতে তিনি কলকাতার ফিল্মে অপর্ণা সেনের পাশেই থাকবেন। তার অসাধারণ থ্রিলার ‘শুভ মহরত’ – এ নারীরা (নন্দিতা দাশ, শর্মিলা ঠাকুর, রাখী গুলজার) নারীর আত্ম-অবয়বের তিন ধরনের সঙ্কটকে সামনে নিয়ে আসে। দহন – এ ধর্ষিতার চরিত্রে অভিনয় করা ঋতুপর্ণা, কিংবা ‘বাড়ীওয়ালীর’ কিরণ বেদী, অথবা ‘অন্তরমহল’ – এর রূপা গাঙ্গুলী ও সোহা আলী খান, ‘আবহমান’ – অনন্যা নারীর অধস্তনতা, লড়াই ও আত্মসমর্পনের ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ও মাত্রাকে রেপ্রিজেন্ট করেছে।

    তার রেপ্রিজেন্টেশনের সঙ্গে আমরা সবসময় একমত নাও হতে পারি। তবে আমার মনে হয়, ঋতুপর্ণ নারীর প্রতি ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সংবেদনশীলতায় বাংলা ফিল্মের ইতিহাসে অনন্য। অপর্ণা সেন, তপন সিনহা সহ হালের অনেক পরিচালকের কথা মাথায় রেখেই কথাটা বললাম। তার ফিল্ম আমার পছন্দ। এর একটা কারণ হলো, তার ফিল্মের নারীরা আমার খুব পরিচিত – আমার মা, দিদিমা, মাসি, পিসি, খালাম্মা, ভাবি, আপা, দিদি, বা বৌদি। কলকাতার হালের অনেক ফিল্মেই নারীর যৌনতাকে, নারীর বাসনাকে, কামনাতে পর্নোগ্রাফিক উপস্থাপন করেছে। লিঙ্গীয় রাজনীতি সম্পর্কে সমস্যাজনক অবস্থান ও অনুশীলনের অভাব এর একটা কারণ হতে পারে। কলকাতায় নারীবাদী বয়ান ও অনুশীলনে সেক্যুলার ও লিবেরাল মতাদর্শের দাপটও একটা কারণ হতে পারে।

    তবে নিজে নারী ও পুরুষ – এর লিঙ্গীয় সীমানা মানতেন না বলেই, হয়ত, ঋতুপর্ণ, বিশেষকরে, নাগরিক পরিপ্রেক্ষিতের নারীদের রেপ্রিজেন্টেশনে বেহুদা রাজনৈতিক ও হন হন নাই, পর্নোগ্রাফিকও হন নাই।

    বন্যা মির্জার লেখাটি খুবই জরুরি কাজ। সম্ভবত, পশ্চিম বাংলায়ও ঋতুপর্ণের ফিল্মে ‘নারী’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ ও ‘লিঙ্গ-অতিক্রমনতা’ নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না; যতটা চোখে পড়ে, যেমন, ঋতুপর্ণের ফিল্মে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা। তিনি যৌনতাকে, অধিপতিশীল যৌনসম্পর্ককে, আন যৌনতার সঙ্গে আত্ম-পরিচয়ের সম্পর্ককে ভিন্নভাবে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করেছেন তার ফিল্মে। তাই তার সব ধরনের ফিল্মই আমি নিবিষ্টভাবে ও সিরিয়াসভাবে দেখার চেষ্টা করি। বন্যা মির্জাকে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ ও সালাম জানাই। আমার এই মন্তব্য সংযুক্তি মাত্র।

  3. Banomali go tumi, parojanome hoio radha…ei akuti o dodulyamatona Rituparner sesh duiti film e bhisan bhabei uchchakita. Taar lingiyo sangbedanshilata, jadio kono kono khetre ‘leberal’ o ‘urban’ patobhumir upama o utprekhha diye, simayito, prai sab film ei aachhe. Parichalak hisabe tini tar film er abhinetrider jonno asambhab bhalo shikhak chhilen. Sesh duto film badeo narir bayan atyanto sangbedanshilatar sange nirmane, aar tar mato kore probad er abhibyakti toiri korte tini Bangla cinemai Aparna Sen er pashei thakben. Tar asadharan thriller ‘Shubha Mahorat’ e narira (Nandita Das, Sharmila Thakur o Rakhi Gulzer) narir atma-abayaber tin dharaner sankat k samne nie ase. Dahan e dharshitar charitre Abhinay kara Rituparna, kinga Bariowalir Kiran Bedi, Abahaman er Anannya-ra ek ek bhabe narike represent korechhe. Tar representation er sange amra sabsomai ekmat hote nao pari. Tabe amar mone hoi, Rituparna narir proti o tritiya linger proti sangbedanshilatai ananya, bangla cinemai. Tapan Sinha, Aparna Sen saho samratik annoder katha mathai rekhei bolchhi. Amar tar film pachhondo. Er ekta karon holo, karon tar film er narira amar khub parichita…amar ma, mashi, pishi, ba boudi. Sampratik Kolkatar film e jounatak bibhinnabhabe represent kara hochhe. Anek film i narir jounatak, narir basonak, kamonak pornographic bhabe upasthapan korechhe. Lingiya rajniti samparak samasyajanak obosthan o anushilaner abhab i er karon hote pare. Kolkatai secular o liberal matadarsher dapat o ekta karon hote pare. Tabe nije nari o purush er lingiya simana manten na bolei, hoito Rituparno, bishesh kore, nagarik narider representation e behuda rajnaitik aar pornographic hoe othen nai (antarmahol er katha baad die bolchhi). Bonna Mirzar note ta khub i jaruri note. Sambhabato Paschim Banglai o Rituparner film e “nari’, ‘tritya linga’ o linga-atikramanata nie kono serious alochana amader chokhe pare na, jatota chokhe pare, jemon, Rituparner film e rabindranath prashango. Tini jounatak, adhipatishishil jouna samparkake, aar jounata sange atmaparichoy er samparko k bhinnabhabe mokabela korte chesta korechhen tar film e. Tai tar film aami seriously dekhte pachhondo kori. Bonna Mirza k prashangoti utthapan karar jonno dhanyabad o salam janai. Amar mantyabati sanjukti matro.

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: