সুস্মিতা চক্রবর্তী, অতিথি ব্লগার**
বাংলা কবিতায় নারী-প্রতিমূর্ত্তি নির্মাণ এ মর্মে যখন একটা লেখা করার প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তা এক সহকর্মীর সাথে আলাপ করছি তখন আমার সেই সহকর্মী বলছিলেন কবিতার আবার নারী পুরুষ কি? শিল্প শিল্পইÑ এর কোনো নারী-পুরুষ নাই। শিল্প সম্পর্কে তার এই মনোভঙ্গীটি যে সত্যিকার অর্থেই খুব সরল-সাদামাটা উক্তি নয় তা বোঝাতে আমার সেদিন আমাদের অসম সমাজ-সংস্কৃতি-নারী-পুরুষ-অধিপতি সম্পর্ক বনাম অধঃস্তন সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করলেও পরিবেশ-পরিস্থিতিগত কারণে বেশ সংযত হয়ে আমি আমার লেখার উদ্দেশ্য ও উপযোগিতা নিয়ে অতি সংক্ষেপে বিষয়টা সেরে ফেলতে চাইছিলাম। মনে পড়ছিলো আরো দু’তিন বছর আগে আমরা যখন একটি নারী বিষয়ক পত্রিকার কাজ করছিলাম এবং সেই সূত্রেই একজন নারী-গল্পকারের কাছে লেখা চাইতে গিয়ে আমাদের পত্রিকার কথা বলছিলাম তখন তিনিও বলছিলেন পত্রিকায় নারী-পুরুষ আলাদা করো না প্লীজ …. এটা ঠিক না, এ নিয়ে কিঞ্চিৎ পরামর্শও দিয়েছিলেন। উনার বাচন-ভঙ্গী এবং নারী বিষয়ক পত্রিকার প্রতি তার দিক থেকে যৌক্তিক অনাগ্রহ দেখে আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা নারী-পুরুষ আলাদা করছি নাÑ কেবল নারী বিষয়ক একটি পত্রিকা সবাই মিলে করতে চাচ্ছি।
প্রজাতি হিসেবে নারী-পুরুষ আলাদা তাদের শারীর-বৃত্তিয় বৈশিষ্ট্যের নিরীখে এ কথা আমরা সকলেই জানি, বিশ্বাসও করি। কিন্তু আধিপত্যশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী-পুরুষের স্বাভাবিক পৃথক সত্ত্বাকে যখন কর্তৃত্বের রাজনীতিতে ফেলে দেশ-কাল-সমাজ ভেদে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলে তখন নারী-পুরুষ নির্মিত হয় প্রচলিত সমাজের কাঙ্খিত মূল্যবোধের আদলে এবং সমাজ-কর্র্তৃত্বের কেন্দ্রে পুরুষের অবস্থান হওয়ায় এই নির্মাণ প্রক্রিয়াটিতে নারীর ‘প্রান্তিক’ চেহারা নির্মিত হয় এবং এই নির্মাণ অব্যাহত থাকে সমাজ-সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আর তাকে নানাভাবে পরিশীলনের মাধ্যমে বিকশিত করে নারী-পুরুষের এই সামাজিক কিন্তু একপেশে নির্মাণকে বৈধতা দেয়া হয়ে থাকে। এই বৈধতা দেয় রাষ্ট্র-সমাজ-শিক্ষা-ধর্ম-সংস্কৃতি-সাহিত্য ইত্যাদি-প্রভৃতি নামক অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান-মাধ্যমগুলো। নারী-পুরুষের এই অসম নির্মাণকে স্বাভাবিক করে তোলা হয় রাষ্ট্রের যাবতীয় অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী প্রোপাগা-া চালিয়ে। এই সেই প্রোপাগা-া যার জন্য নারী বিষয়ক পত্রিকার কথা উঠলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত অধ্যাপক-নারীলেখক যেমন এ ব্যাপারে নেতিবাচক ধ্যানধারণা পোষণ করেন তেমনি শিক্ষিত অধ্যাপক-পুরুষ কবিও কবিতায় নারীর নির্মাণ নিয়ে আলাদা করে কোনো আগ্রহ বোধ তো করেনই না বরঞ্চ এই বিষয়গুলোকে স্রেফ ‘নারীবাদী প্রকল্পের’ (অবশ্যই তার দৃষ্টিতে) ছাপ্পা মেরে এর প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখেন।
দীর্ঘদিনের লালন-পালন ও চর্চার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের স্টিরিওটাইপ চেহারা সমাজে দাপটের সাথে টিকে থাকে আমাদের সংস্কৃতির অধিকাংশ এলাকা জুড়ে। ফলে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে নারী-পুরুষের যে স্বাভাবিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আদল পরিলক্ষিত হয়ে থাকে তাকে যেমন কোণঠাসা করে রাখা হয় আবার আধিপত্যশীল-মতাদর্শের প্রপাগা-ায় সেগুলো অদৃশ্য করে রাখার সুকৌশল জারি থাকে সমাজের পরতে পরতে। আর নারী-পুরুষের সাংস্কৃতিক নির্মাণে অধিকাংশ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে নির্মাণ করে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শে জর্জরিত করে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোতে পুরুষই যেহেতু প্রধান বা কর্তা হিসাবে সর্বত্র বিবেচিত হয়ে থাকে তাই এই কর্তার চোখ দিয়ে নারীর নির্মাণ ঘটে যেখানে নারী থাকে প্রায় সর্বত্রই ‘অবজেক্ট’ হিসাবে। বাস্তব জগতের এই ‘অবজেক্ট’ নারীই তখন হাজির হয় আমাদের সাহিত্যে-শিল্পে-সঙ্গীতে-গণমাধ্যমে। এই সকল মাধ্যমগুলি যেহেতু সমাজ-মানসে গভীর প্রভাব ফেলে ফলে নারীর এই নির্মাণ-পুণর্নির্মাণ অনবরত ঘটতেই থাকে। যদিও আজকের সমাজ-বাস্তবতা, নারীদের অবস্থান আর তাদের নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম, নারীবাদীদের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা-সমালোচনা নারীদের এই পুরুষতান্ত্রিক অবস্থানকে অনেকখানি নাড়া দিতে পেরেছে সারা পৃথিবী জুড়েই। পাশ্চাত্যের মত আমাদের দেশেও নারবাদী জ্ঞানকাঠামো ক্রমে ক্রমে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরূদ্ধে অল্প মাত্রায় হলেও কলম ধরেছে। ফলে সঙ্গত কারণেই আমাদের প্রচলিত সমাজ-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলি আগের মত নিষ্কন্টক তথা বিনা বাধায় সর্বদা সুবিধা করতে পারছে না। ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে নারী প্রসঙ্গটি অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়ে চলেছে। কবিতার সাথে নারীর সম্পর্কটিও সমাজ-সংস্কৃতির অন্য অনেক বিষয়ের মত প্রচলিত সমাজের কর্তৃত্ববাদী ধ্যানধারণাগুলির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। এ নিয়ে কিছু সঙ্গত অথচ বিশেষ করে আমাদের দেশের সাহিত্য-ঘরানায় অপ্রচলিত কিছু কথাবার্তা সহজ করে তুলে ধরার প্রাথমিক প্রয়াসই বর্তমান লেখাটির আকাঙ্খাগত বৈশিষ্ট্য।
শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য কোনো ‘অনড়’ বা ‘স্থির’ বিষয় নয়। সমাজ-কাঠামোর কালিক পরিবর্তনের ঢেউ অনিবার্যভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রের মত আমাদের শিল্পে-সাহিত্যেও স্বাভাবিক নিয়মেই এসে আছড়ে পড়ে।। ফলে, প্রতিনিয়ত শিল্প-সাহিত্য তার ধরনধারণে নানাবিধ প্রকরণগত-বয়ানগত পরিবর্তনের চিহ্ন চাপিয়ে নির্মিত হয়ে চলে। প্রাচীন কালে শিল্প-সাহিত্যে পুরুষের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। নারীরা ছিল পুরুষ-লেখকদের লেখার বিষয়বস্তু বা আরো কৌতুক করে বলতে গেলে তাদের লেখার অনুপ্রেরণা। ফলে শিল্পে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে পুরুষের দেখা বা স্পষ্ট করে বলতে গেলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-আদর্শের মানদ-েই অধিকাংশ সৃষ্টিকর্ম নির্মিত হতো। নারীকে দেখার এই পুরুষতান্ত্রিক চোখ নারীর জন্য সমাজ-আরোপিত বা সমাজ-নির্ধারিত কিছু অলঙ্কার-পদ বরাদ্দ করেছিলো আমাদের শিল্পে-সাহিত্যে। ফলে এর বাইরে নারীর নির্মাণ আমাদের প্রচলিত শিল্প-সাহিত্যে খুব কমই ঘটেছে। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-বলয়ের মধ্যে আজন্ম লালিত-পালিত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলো অতিক্রম করা খুব সহজ নয় যদি না আলাদা করে এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা-সতর্কতা সর্বোপরি এর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার আন্তরিক আকাঙ্খা থাকে। নারী বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীলতা আর নারীর সাথে যুক্ত প্রচলিত লিঙ্গীয় রাজনীতির কর্র্তৃত্ববাদী ধ্যানধারণাগুলি অনুভব বা উপলব্ধি না করলে কোনো শিল্পীর পক্ষেই বোধ হয় পুরুষতান্ত্রিক-সমাজ-মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়ার সহজাত-প্রবৃত্তি জাগ্রত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। আর সেজন্যই শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত কবিতার মধ্যেও সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের পুণঃ পূণঃ নির্মাণ সেই পুরোনো কালের মত আজকের দিনে এসেও আমাদের সামনে হাজির হয়।
আধিপত্যশীল-পুরুষতন্ত্র শিল্প-সংস্কৃতিতে নারীকে যুক্ত করে বিনোদনের একেবারে সস্তা বা সহজলভ্য বস্তু হিসাবে যেখানে নারী স্রেফ দেহসর্বস্ব যৌনতার প্রতিমূুর্ত্তি, অন্য কিছু নয়। এভাবে পুরুষতন্ত্র নারীর স্বাভাবিক মনুষ্য-সত্ত্বাকে আড়াল করতে করতে একবারে অদৃশ্য করে ফেলতে চায়। বাংলা কবিতাতেও নারীর এই আসন অলঙ্কৃত হয় কবিদের লেখনীতে। একেবারে পুরোনো দিনের কবিতায় নারী-নির্মাণে না হয় নাইবা গেলাম আমাদের ‘আধুনিক’ কবিদেরই বয়ানে অহরহ এই প্রচলিত নারী-নির্মাণ প্রক্রিয়া সমাজ-শিল্পের বৃহৎ পাটাতনে পুনরুৎপাদিত হতে থাকে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের হাত ধরে।
কবিতায় নারী-বন্দনা যেমন খুবই সাধারণ একটা প্রবণতা হিসাবে চোখে পড়ে আবার নারীকে ঘৃণা করার মতন প্রবণতাও কম লক্ষনীয় নয়। আধিপত্যশীল সমাজ-সংস্কৃতির মানদ-ে যে সমস্ত গুণাবলী নারীর জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে কবিতায়ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সমস্ত গুণাবলী সমৃদ্ধ নারীদেরই স্তু‘তি চোখে পড়ে। এ ছাড়া, নারীর চিত্ররূপ তুলে ধরতে কবিরা প্রায়শই যে ধরনের উপমা ব্যবহার করেন সেগুলোর মধ্য দিয়েও কবির পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। সবচেয়ে খারাপ লাগে তখনই যখন দেখা যায় নারীর প্রতি চরম বলপ্রয়োগের মত যৌন-নিপীড়নের পুরুষতান্ত্রিক ‘প্রত্যয়টি’ও অবলীলাক্রমে ‘আধুনিক’ কবির কবিতায় কুৎসিতভাবে উঁকি মারেÑ ‘আধুনিক’ যুগের একজন কবির ‘ধর্ষণ’ শিরোনামধারী কবিতায় কবি যখন গড়গড় করে বলে যান কিভাবে কাকে কখন কোথায় তিনি ‘ধর্ষণ’ করবেন তখন এই ধরনের কবিতায় পুরুষ-কবির অতৃপ্ত যৌনবাসনা যা প্রবলভবে পুরুষতন্ত্রের, বলপ্রয়োগের তীব্র আপত্তিজনক ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তখন এখানে কবিতা নামক শিল্পটির আর কীইবা অবশিষ্ট থাকে! ‘ধর্ষণ’ কবিতাটিতে ‘আধুনিক’ কবির পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার উন্মোচন ঘটান কবি এভাবেই:
“মা, পৌষ-চাঁদ-ও কুয়াশা জড়ানো সন্ধ্যারাত্রে, শাদা-দুধ সোনা-চাল
মিশিয়ে দু-মুখো চুলোয় রান্না করছিলেন পায়েশ; চুলোর ভেতরে
আমকাঠের টুকরো লাল মাণিক্যের মুখের মতন জ্বলছিলো।
সেই আমার প্রথম রঙিন ক্ষুধার উদগমÑ
মায়ের পাশেই ব’সে
সারাসন্ধ্যা ধর্ষণ করলাম একটা লাল আগুনের টুকরোকে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সাত দিন পর দেখলাম পদ্মার পশ্চিম পারে নারকেল
গাছের আড়ালে সূর্যাস্ত খুলছে তার রঙিন কাতান।
সূর্যাস্ত, আমার মেরিলিন, আমাকে জাগালো আমাকেÑ
টেনে এনে তাকে নারকেল গাছের আড়ালে আসন্ধ্যা ধর্ষণ করলাম,
পদ্মার পশ্চিম প্রান্ত রক্তে ভেসে গেলো।
অনার্স পড়ার কালে কলাভবনের সম্মুখ থেকে আমার অধরা বাল্যপ্রেমিকার
মতো ছুটে-যাওয়া একটা হলদে গাড়িকে ষাট মাইল বেগে ছুটে
পাঁচ মাইলব্যাপী ধর্ষণ করলাম।
একাত্তরের পাকিস্তান নামী এক নষ্ট তরুণী আমাকে দেখালো তার
বাইশ বছরের তাজা দেহ, পাকা ফল, মারাত্মক জংঘাÑ
চৌরাস্তায় রিকশা থেকে টেনে প্রকাশ্যেই ধর্ষণ করলাম;
বিকট চিৎকারে তার দেহ রক্তাক্ত ও দুই টুকরো হ’য়ে গেলো।” (হুমায়ুন আজাদ, ১৯৯৮: ৮৫)
নারীর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গকে (বিশেষভাবে নারীর যৌনতার সাথে সংশ্লিষ্ট) কবিরা হর- হামেশাই বিভিন্ন বস্তুর সাথে তুলনা করে যেমন তাদের কবিতায় ব্যবহার করেন আবার কোনো দৃশ্যকল্পের সাথে সম্পর্কিত কোনো বস্তুকেও নারী-দেহের সাথে তুলনা করে তাকে তুলে ধরেন। কবিতায়, যে কোনো বস্তুর সাথে (সে চাঁদই হোক আর গাছই হোক) অবলীলাক্রমে নারীরÑ [নারীর শরীর, তার যৌনতা, নারীর জীবনের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো অনুষঙ্গ এমন কি শুধুমাত্র নারীর ব্যবহার্য পোষাক-আশাকগুলো পর্যন্ত] তুলনা করার প্রবণতার মধ্য দিয়ে নারীকে সহজলভ্য নিছক একটা বস্তু (প্রাণহীন) হিসাবে আকছার ব্যবহার করার প্রচলিত চিত্র ফুটে ওঠে। কবির কল্পনায় চাঁদ হয়ে উঠে নারী, চাঁদের পরণে থাকে ব্রা পেটিকোট-শাড়ি কিংবা নারীর বুক-পাছা-স্তন-জংঙ্ঘা কি কি ফলের মতো হলে কবির ভাল লাগবে তার বয়ান কবিতায় নির্মিত হয়। অনেক সময় নারী-সংশ্লিষ্ট বিষয় কবিতায় স্রেফ জুড়ে দেয়া হয়ে থাকে পাঠকদের সামনেÑ অর্থের হানি ঘটলো কিনা সেটা না ভেবে। কবিদের এ প্রবণতাগুলির স্বপক্ষে অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের আধুনিক বাংলা কবিতা থেকে দেখানো সম্ভব। আধুনিক কবিতায় আলোচ্য পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতাগুলি শণাক্ত করার নিমিত্তে আলোচনার ন্যায্যতা প্রমাণে আমাদের দেশে আধুনিক কালে রচিত কিছু কবিতার চরণ নীচে হাজির করা হলো:
(ক)
…
“তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ?
প্রতিটি দিন যায় আহত, নিষ্ফলÑ
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল,Ñ
আমার ডানহাতে রাখো রে গৌরব;
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ। (আল মাহমুদ, ২০০০: ১০৯)
(খ)
….
“কদলী বৃক্ষের মতো উরু
সুমসৃণ যেন বা রেশম
কালো শেকড়ের মতো ভুরু’
নারী যদি হতো এরকম!
বিল্ব ফলের মতো স্তন,
বাহু দুটি সুপক্ক শশা,
গুরুভার পশস্ত জঘন
ঘিরে আছে নিরত তমসা।
(‘সুসজ্জিতা’, ওমর আলী; উদ্ধৃত ইসমাইল হোসেন কনক, ২০০৭: ১৪৭)
(গ)
…..
প্রখর পিঠের যারা, সেই সব উগ্র কমলারা
কাঁচুলি পরে না জানি, বব্চুল, ঝগড়ায় পাকা
আসে কাছে তাড়াতাড়ি; কিন্তু যায় বিদ্যুতের মতো।
মাঝারি শরীরে ঢালে একরাশ পারীর সুগন্ধীÑ
যুক্তি আর তর্ক করে। এইভাবে সুখী হ’তে চায়।
(সিকদার আমিনুল হক, ২০০১: ১৩০)
(ঘ)
বিবস্ত্র হচ্ছে চাঁদ খুলে ফেলছে ব্রা পেটিকোট
গা থেকে পিছলে পড়ছে সৌরভ জোৎøা যার প্রচলিত নাম
………
(হুমায়ুন আজাদ, ১৯৯৮: ৫১)
(ঙ)
…….
ক্ষেত ফিরে যাচ্ছে ফলন্ত তরঙ্গরাশি শ্রোণিভারে দোলাতে দোলাতে;
নৌকো, তন্বীস্তনের মত পাল কাঁপে মৌশুমি বাতাসে;
সবাই ফিরছে ঘরে সুখী তৃপ্ত সুন্দর মায়াবী।
………..
(হুমায়ুন আজাদ, ১৯৯৮: ৭৫)
(চ)
বায়ুস্পর্ষে পর্ণমোচীর পাতায় হলদে শিহরণ;
নন্দিনীর কোমরে হাত রেখে দেখিÑ নদী নেই
পার্কের খালে ঘুরে মরে স্রোতেলা অস্তিত্ব
হয়তো বা মৌসুমও এসে যায় মেনোপজে!
……..
(আমিনুল ইসলাম, ২০০৮: ৬৪)
সাধারণভাবে পুরুষ-কবিদের কবিতায় নারী-সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ের অবতারণা ঘটলেই সেখানে নারীর যে প্রতিমূুর্ত্তি নির্মিত হয়ে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিতার সেই নারী-মানুষটি কবিতায় অত্যন্ত প্যাসিভ অবস্থায় হাজির থাকে। নারীর অন্য রূপের কথা না হয় নাইবা তুললাম সচরাচর কবিরা ‘সৌন্দর্য্যরে’ সাথে যুক্ত করে, ‘যৌনতার’ সাথে যুক্ত করে যে নারীদের কবিতায় তুলে ধরেন সেখানে নারী কেবল ‘বস্তু’ হয়ে পড়ে থাকেÑ কোনো ‘অ্যাক্টিভ’ ভূমিকা সেখানেও তার নেই। মনে হয় যৌনতার মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে নারীর কিছুই করণীয় নেই কেবল যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমেত তার শরীরী সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে দৃশ্যকাব্যে উপস্থিত হওয়া ছাড়া। এখানেই কবিতার নারীর সঙ্গে বাস্তবের নারীর ঘোরতর অমিল ঘটে। কেননা জীবন-বাস্তবতায় একজন পুরুষের মত নারীরাও অন্তত আজকের সময়ে নানামুখি কর্মে ব্যাপৃত রাখেন নিজেদেরকেÑ কি ঘরে কি বাইরে প্রায় সর্বত্র। আবার সমাজের শ্রেনী-বিশেষে একই নারীর কর্ম-শ্রম কত কত আলাদা হয়ে থাকে। এমনকি নারী-পুরুষের যৌন জীবনে পুরুষের পাশাপশি নারীও ভূমিকা রাখেন। যদিও আমাদের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর যৌনতায়ও তার ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে স্থান দিতে চায় না। তাই কবিতায় নারী-শরীর বা যৌনতার সাথে সম্পর্কিত নারীর অগণিত চিত্রায়ণ ঘটলেও সেখানেও নারীর নির্মাণ হয়ে পড়ে একপেশে। আর বাস্তব জীবনের শ্রম-ঘামে সংগ্রামে প্রতিনিয়ত যে নারীরা সমাজে কষ্টে-শিষ্টে বেঁচে থাকে তাদের স্বর আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অন্য অনেক আঙ্গিকের মত কবিতাতেও খুব বেশি নির্মিত হয় না।
কবিরা তাদের কল্পনার, অনুভূতির আর উপলব্ধির সারবেত্তা তাঁদের কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন। সেখানে তিনি স্বাধীনÑ তিনি স্রষ্ঠা বা শিল্পী। কিন্তু তাঁর এই শিল্প-সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ যদি অপর মানুষের মনুষ্য-সত্ত্বাকে মর্যাদাহীন করে তোলে সেটা শিল্পের জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা বোধগম্য না হলেও একজন নারী-পাঠক হিসেবে, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে এই সমস্ত কবিতার ‘ডিসকোর্স’ নিয়ে খুব সঙ্গত কারণেই শুধুমাত্র ‘বিশুদ্ধ শিল্প’-এর দোহাই পেড়ে এগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে দূরে রাখা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে কোনো কবিকে খাটো করা কোনোভাবেই এই লেখাটির চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বরং আধুনিক বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার একটি বিশেষ প্রবণতাকে শণাক্ত করতে কিছু কথা এখানে প্রাথমিক ভাবে তোলা হল এবং এর যৎকিঞ্চিৎ নমুনা এখানে হাজির করা হলো মাত্র।
আমাদের সমাজ-ইতিহাসের যে কাল-পর্ব থেকে নারী বন্দী হয়েছে আধিপত্যশীল পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খলে সেদিন থেকে নারী হারিয়েছে তার স্বাধীন অস্তিত্ব তথা তার মনুষ্যত্ব। ফলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাস্তব জীবনের শৃঙ্খলিত নারীর অবয়বই নির্মিত হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরুষতান্ত্রিক আবহে। আর নির্মাণ করেছে সমাজের আধিপত্যশীল পুরুষ-সত্ত্বা যে তার সমাজ অনুমোদিত মতাদর্শকেই নারী-নির্মাণে সব চাইতে বেশি করে আশ্রয় করেছে। ফলে একজন মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা খুব বেশি স্থান পায় নি আমাদের শিল্প-সাহিত্যে যত না আধিপত্যশীল পক্ষের কল্পনা-ফ্যন্টাসি-নির্ভর নারী-মূর্ত্তি চিত্রিত হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যতিক্রম যে নেই বা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে যে নারীর চিত্রায়ণ কবিতায় একেবারে ঘটে নি বা বর্তমান সময়ে ঘটছে না তা নয়। এগুলো নিয়ে এমনকি, খোদ নারী কবিতায় কিভাবে নিজেদের নির্মাণ-বিনির্মাণ করেন এ সমস্ত কিছু নিয়ে বরং অন্য সময়ে পৃথক আলাপ তোলা যাবে।
রাবি-ক্যাম্পাস: ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮।
*আসমা বীথি সম্পাদিত ঘুড়ি পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
**সুস্মিতা চক্রবর্তী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, সংস্কৃতি-রাজনীতি
Leave a Reply