সানাউল্লাহ লাবলু, অতিথি ব্লগার
কিছু তথাকথিত ‘পুরুষ’ মানুষ সামাজিক মাধ্যমে নারীর ছবি দেখলে ওড়না কিভাবে পড়া উচিত,মাথায় স্কার্ফ কিভাবে পড়তে হবে কিম্বা হিজাব পড়ার জন্য নারীদের ‘জ্ঞানদান’ শুরু করেন। ফেসবুকে আমার কন্যাসম এক তরুনীর একটি ছবিতে ওড়না নিয়ে এক ‘পুরুষ’-এর মন্তব্য পড়ে এতোটাই বিরক্ত ছিলাম যে মেয়েকে প্রশ্ন করলাম “তুমি প্রতিবাদ করলে না কেন?” জবাবে ও জানালো, লোকটি ওই রকমই। প্রতিবাদ করতে গেলে কথা বাড়ে। তাই সে উপেক্ষা করেছে।
তখন থেকেই ভাবনাটা আমাকে তাড়িয়ে নিতে থাকে, কোনো নারী বা নারীর ছবি দেখলেই এক শ্রেণীর ‘পুরুষ’-এর মাথায় পোষাকের ভাবনা আসে কেন? নারী তার শরীর ঢেকে রাখলেই কী নিরাপদ থাকে? কেন ৫ বা ১১ বছরের নারী শিশুরা ধর্ষনের শিকার হয়? সর্বশেষ ১৭ মাস বয়সী শিশুও ধর্ষিত হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। ওই সব শিশুর কি ক্ষমতা তথাকথিত পুরুষের কামভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করার? আকর্ষনীয় পোষাক বা শরীর কোনোটাই তো তাদের নেই!
ধর্ষণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের নানা লেখা, মন্তব্য পড়ি। হতাশ হই, প্রায় সব জায়গায় নারীর পোষাককে একটা প্রধান ইস্যু তৈরি করা যায়। বেশ পড়াশুনা করা ‘শিক্ষিত’ অনেকেই এমন ভাবনা দ্বারা তাড়িত যে, নারীর পোষাক পুরুষকে ধর্ষণ বা নির্যাতনে প্রলুব্ধ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেহেতু তারা এমন কথা বলেন, তাই আমাদের নারীর পোষাক কতোটা ‘পুরুষ উত্তেজক’ তা দেখা যেতে পারে। পোষাকের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে পোষাক নয়, পোষাকের আড়ালে বা পোষাক ভেদ করে নারীর শরীর কতোটা দেখা গেলে পুরুষ ধর্ষনের মতো উত্তেজনায় আক্রান্ত হন- ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হলেও এমন কোনো মাপকাঠি আজো বের করা যায়নি! ‘উত্তেজক পোষাক’ পরিহিত কোনো নারীকে প্রকাশ্যে বা আড়ালে কোনো পুরুষ ধর্ষনে উদ্যত হয়েছে এমন কোনো খবরও আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ধর্ষনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নারী কোথাও নিসঙ্গ থাকলে আক্রান্ত হন বেশি। বা ধর্ষনের জন্য শিশু বা নারীকে কোনোভাবে প্রলুব্ধ করে ধর্ষক পুরুষ বা পুরুষেরা এমন স্থানে নিয়ে যায় যেখানে সে এই জঘণ্য অপরাধটি বিনা বাধায় সম্পন্ন করতে পারে।
সব ধরণের পর্যবেক্ষনে নিশ্চিতভাবে দেখা যাবে, পোষাকের সঙ্গে ধর্ষনের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের নারীদের দশমিক ১ শতাংশও কথিত ‘অশালীন’ পোষাক পড়েন না। এখানে অশালীন বলতে পশ্চিমী ধাচের পোষাকের কথা বলা হচ্ছে। যদিও শালীনতা বা অশালীনতার সংজ্ঞা পুরোটাই আপেক্ষিক, ব্যক্তির নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নির্ভর। শিশুর কথা আগেই বলা হয়েছে, বোরখা পড়া নারীও ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হন।
পোষাক যদি ধর্ষনের কারণ হতো,তাহলে বাংলাদেশে এ অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটতো অভিজাত অধ্যুষিত এলাকায়। অথবা দেখা যেতো দেশ-বিদেশের সি বিচগুলো সবচেয়ে অরক্ষিত! কিন্তু এসব এলাকায় বা একেবারে ন্যুড বিচেও কেউ ধর্ষিত হন না বা কেউ সেখানে সেক্স করেন না। তাই পোষাকের অজুহাতটা একেবারেই বাজে,পুরো অগ্রহণযোগ্য। এর আড়ালে প্রকৃতপক্ষে নারীর পোষাক পড়ার স্বাধীনতার ওপর ‘পুরুষ’ তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে। সমস্যাটা নারীর পোষাকের নয়, পুরুষের দৃস্টিভঙ্গীর। পুরুষ যতোদিন মানুষ না হবে, নিজেকে মানুষ না ভাববে- ততোদিন সে তার শরীর সম্পর্কিত যাবতীয় অপরাধের দায় নানা অজুহাতে নারীর উপর চাপাতেই থাকবে।
সানাউল্লাহ লাবলু: সাংবাদিক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply