উদিসা ইসলাম
ঢাকায় হরেক রকম মেলা হয়। বৃক্ষ, যন্ত্রপাতি, কাপড়, ইট কাঠ প্লাস্টিক, নববর্ষ, নিউ ইয়ার, ঈদ, পূজা। ঢাকায় আরেক রকমের মেলাও হয়। সেটা হলো জেণ্ডার মেলা। সেখানে মহারথীরা আসেন, নারী বিষয়ে (এটাকেই তারা জেণ্ডার বলেন) নানা আলাপ করেন, নারীদের বানানো জিনিসপত্র নারীরা বিক্রি করেন ছোট ছোট চারপাশের স্টলে। এরকমই একটা জেণ্ডুমেলার ঘটনা। ঢুকেই দেখি- হুম মহারথীরা এসেছেন। অনেক সংরক্ষিত আসনের এমপিরা এসেছেন। ৩ জন নারী দামী দামী শাড়ি পাট পাট করে পরে ফুল ছিটিয়ে বরণ করছেন অতিথিদের।
সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এলেন যারা তাদের কারো কারো বক্তব্য শুনি।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রতিমন্ত্রী বললেন- রোকেয়াকে আমি উঠতে বসতে স্মরণ করি। উনি ছিলেন বলেই আমরা আজ যার যার চেয়ারে নারীরা বসে আছি। আমি সম্প্রতি বিদেশ গেছিলাম। ওখানে এক অনুষ্ঠানে এক বৃদ্ধা আসবেন। তার জন্য দেখি খালি সবজি। তাও পিয়াজ ছাড়া। আমি বললাম, কেন? তারা জানালো, কারণ তিনি ১৮বছর আগে স্বামী হারায়সেন। তিনি হিন্দু বিধবা। আমরা নারীরাই যদি নিজেদেরকে না বুঝাতে পারি, এরকম জীবন যাপন করতে থাকি, তাহলে অধিকার পাব কি করে? রোকেয়া আমাদেরকে নিজের অধিকার বুঝে নিতে বলেছে। আমরা একজন নারী আরেকজন নারীর জন্য পিয়াজ ছাড়া তরকারির ব্যবস্থা না করে পিয়াজসহ ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে। সে যা চায় সেরকমই রেখে দেয়া হলো।
জেণ্ডার মেলায় শুধু যে ‘জেণ্ডার’ নিয়ে আলাপ আছে তা না…আলোচনা চলছে যে ঘরে তার চারপাশে ২২টি স্টলও দেয়া হয়েছে। হাতে তৈরিব্যাগ, অলংকার, কুশন কাভার, বেড কাভার, টিসু প্যাক কাভার, আছে প্রাকৃতিক রং এর পোষাক, ঘর সাজানোর নানা জিনিস, আরও কতো কি!! উপস্থিত আয়োজকরা ছাড়া জনা ৬০ মানুষ আছে। সূধীদের কাছে আলোচনার চে সেইসব স্টলের জিনিষের দিকে আগ্রহ অনেক বেশি। দেখা গেলো মূল মঞ্চের সামনে ১৫জন মতো বসে আছেন। বাধ্য হয়ে উপস্থাপককে অনুরোধ করতে হলো: দয়া করে ১ ঘন্টার জন্য স্টলে বিক্রি বন্ধ রাখুন, তাহলে আলাপ করতে সুবিধা হবে। এখানে একচা নতুনত্ব আছে- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুরাঘুরি করতে নিষেধ করে আলাপ শুনতে বলা হয়, এরা সরাসরি ঘরাঘুরির জায়গাই বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিলো।
এক নারীনেত্রী দ্বিতীয় সেশন পরিচালনা করছিলেন। তিনি মুল আলোচক বদিউল আলম মজুমদারকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে আলাপ করতে আহ্বান জানালেন। এসময় তিনি তাকে বললেন, ‘আমি অনুরোধ করবো রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন আর ক্ষমতায়ন বলতে কি বুঝায় তা আগে বলবেন। আমি গবেষণা করে অনেক কিছু বলবো ভেবে এসেছিলাম সময়ের স্বল্পতার কারণে বললাম না।’ তিনি কিন্তু যথেষ্ট সময় নিয়েছেন এবং পেয়েছেন। কিন্তু দুই লাইন পরপর এই একই কথা বললেন- আমি গবেষণা করে অনেক কিছু বলবো ভেবে এসেছিলাম সময়ের স্বল্পতার কারণে বললাম না।
এ পর্বে আসলেন নারীনেত্রীদের আরেকজন। সারাদিনের কথাবার্তার মধ্যে তার কথাটাই একটু শোনার উপযোগী মনে হলো। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে। তিনি তার কথার এক জায়গায় বললেন, সংসদে মূল কাজ রেখে কে কতোটা বরাদ্দ পেল বা পেল না সেটা নিয়েই বেশি কথা হয়। এখন সংসদ হয়েছে ব্যবসায়ীদের সংঘ। নারীর ক্ষমতায়ন এর কথা উল্লেখ করে তিনি আরো কিছুক্ষণ বললেণ।
এরপরপরই এক সঙরক্ষিত নারী এমপি (নামটা মনে নেই, নামের শেষে মনি আছে, দু:খিত) বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন- সংরক্ষিত এমপি হওয়ায় তার কোন ক্ষমতা নাই। তার কোন বরাদ্দ নাই, অতি সামান্য বরাদ্দ। ঠিক আগের বক্তাই কিন্তু বলে গেলেন যে, সাংসদরা বরাদ্দ ছাড়া কোন আলাপে যেতে পারেন না। আগের বক্তার কথা তিনি শুনেও এই লাইনটা বাদ দিতে পারেন নি। কারণ তার স্ক্রিপ্টে এই লাইনটা ছিল। তিনি ওখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছেন।
সারাদিন শেষে মেজাজ খারাপ করে একটু জানতে চাইলাম সবশ্রেণীর আগমণরতদের কাছে- জেণ্ডার মেলাটা কি জিনিস?
স্টলের বিক্রেতা– ম্যাম, আমরাতো আয়োজক না, এখানে প্রডাক্ট সেল করতে আসছি। আপনি প্লিজ রিসিপশনে যোগাযোগ করুন।
স্টলের ক্রেতা– আমাদের অরগাইজেশন এখানে পারটিসিপেট করছে, সেকারণে এসেছি। এখানে জেণ্ডার বিষয়ে আলাপ হবে, জেণ্ডার রিলেটেড প্রডাক্ট ডিসপ্লে, সেল হচ্ছে। এইতো। জেণ্ডার সেনসিভিটি নিয়ে কথা হলো শুনলেন না, এসব বিষয়ে পরস্পরের মতবিনিময় মেলা।
সংরক্ষিত আসনের এমপি– জেণ্ডার বিষয়টাতো এখন আমাদের সবজায়গায় ভাবতে হয়। সেটাকেই আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই আমলে। কিন্তু এই শব্দটা এনজিওর বাইরে সরকারী পর্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে। এখানে মেলা হবে মানে হলো এই যে নারীদের নিয়ে কথা হচ্ছে, নারীদের ক্ষশতায়নের ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ চলছে, দেখেন আপনার অফিসো কিন্তু নারীকেই পাঠিয়েছেন এখানে, এইতো।
সর্বোপরি…আমাদের সবার হাতে একটা ফোল্ডার দেয়া হয়েছিল- (ছবি সংযুক্ত করলাম) সেখানে যে ছবিটি আছে তাতে ১৩জন মানুষের মুখের আদল আছে। পাঠক এরমধ্যে একটিওকি নারীর আদল দেখতে পাচ্ছেন?? পেলে জানাবেন। এই ‘জেণ্ডার চর্চার’ জয় হোক।
** দিনব্যাপী ‘জেণ্ডার চর্চা’ থেকে আমার শিক্ষা হলো- আমি হাতে বানানো দুইটা ফুল কিনেছি। হা হা হা। 🙂
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply