সমারী চাকমা*
আমাদের গ্রামের নাম ছিল মাইচছড়ি আদাম। রাংগামাটি জেলার শুভলং–এ ছিল আমাদের এই আদাম। তখনকার রাংগামাটি শহর থেকে সম্ভবত: চার/পাঁচ মাইল দূরে হবে। তখনতো হাঁটা পথ দিয়ে রাংগামাটি আর আমাদের এলাকায় আসা যাওয়া করা যেতো। আমি এই গ্রামের বিত্তশালী “বিন্দা মাজন” এর নাতনি। এলাকার সবাই আমার দাদুকে বিন্দা মাজন নামে চিনত। আমার নাম পঞ্চ চাকমা। আমরা তিন ভাই চার বোন। আমার বাবা আর মায়ের নাম ভরত চন্দ্র চাকমা ও হিরনচন্দ্রী চাকমা। আমার কতসালে জন্ম তা আমি জানি না, তাই এখন আমার বয়স কত তাও সঠিক ভাবে বলতে পারব না। তবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শেষ হবার আগেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। তাই মনে হয় এখন আমার বয়স সত্তর এর উপরে হবে।
সেই আমি ২০১২ সালে এসে ১৯৬০ সালের আগের কথা বলতে বসেছি। আমিতো কখনো ভাবিনি এভাবে এসে কেউ তখনকার সময়ের কথা জানতে চাইবে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। সব কি মনে আছে? সময়ের সাথে সাথে, বয়সের কারণেও অনেক কিছু ভুলে গেছি। তাছাড়া নিজেদের পরিবারের বাইরে এই প্রথম আমি অন্য কারোর কাছে এভাবে বাধের পানিতে তলিয়ে যাবা সময়ের কথা বলছি। এখন তো সবাই বললেও বুঝবে না ঐ সময়ের কথা, যন্ত্রণার কথা। কাপ্তাই বাধের পানিতে সব কিছু ডুবে যাবার পর তখন আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল। কী ভয়ানক কষ্ট! এতবছর পরে সেই মানসিক যন্ত্রণাগুলো, অনুভূতি গুলো ভালো করে বলা আর বুঝানো কঠিন। তবে এটা ঠিক আমার আজও এতো বছর পরেও সেই বাড়ি, সেই জায়গা, সেই মানুষদের জন্য মন কাঁদে। আমরা মারা যাবার পর আর কেউ থাকবে না সেই সময়ের কথা বলার, স্মৃতিচারণ করার। আামার বাবার বাড়ির, শ্বশুর বাড়ির সব জায়গা জমি বাগান বাগিচা চিরদিনের জন্য কাপ্তাই বাধের পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে সব। একই পরিবারের সদস্য, গ্রামের লোকজন একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চিরজনমের জন্য। অন্যসব পরিবারের মতো আমাদের একান্নবর্তী পরিবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কে কোথায় গিয়ে বসতি করেছে তা বলা কঠিন। যে যেখানে পেরেছে সেখানে বসতি করেছে। আমাদের নিরাপদ সুখের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন একেবারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এই কাপ্তাই বাধ। আমি শুনেছি আমাদের গ্রামের অনেকেই “বড়পুরং”* এ চলে গেছে।
হ্যাঁ, আমার বলতে কোন সংকোচ নেই যে, তখনকার সময়ে আমরা সত্যিকার অর্থে খুব ধনী ছিলাম। বললেই বুঝবে। বিশাল বলতে, বিশাল মাটির ঘর ছিল আমাদের। সাদা চুনকাম করা। এই বাড়ির ছাউনি দিতে ঘরের চালের টিন লেগেছিল ”১০০ বানেরও” বেশী। ঐ সময়ে শুভলং বাজারের দোরে একটা মাত্র বৌদ্ধ মন্দির ছিল আর সেটি ছিল আমার দাদুর নামে। সেই সময়ে গ্রামে গ্রামে এখনকার মতো এত বৌদ্ধ মন্দির ছিল না। তখন বছরে একটা সময়ে আমাদের গ্রামে যাত্রা পালা হতো। আমার মনে আছে যাত্রা পালা চলাকালীন আমাদের সেই বিশাল বাড়ির বারান্দায় যাত্রা দলের সকল মেয়েদের থাকার বন্দোবস্ত করা হতো। আমাদের বড় বড় দুটো ধানের গোলা ছিল। এক একটা গোলাতে ২০০০ আড়ি ধান আটতো। আমাদেরতো তখন অনেক জায়গা জমি। আমাদের একান্নবর্তী সংসার সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যময় ভরপুর ছিল। শুধু আমাদের কেন আমাদের গ্রামে সকলেরই একই জীবন ছিল। ধনে সম্পদে ভরপুর কোন অভাব, দু:খ নেই। তাছাড়া এখনকার মতো তখন এতো ভয়ের জীবন ছিল না। এখনতো সারাক্ষণ বাঙালী, আর্মীর ভয়। কখন কি হয়, সেই ভয়!
পরে অবশ্য আমার দুই দাদু আলাদা হয়ে যান। আমার মনে আছে এই বিশাল বাড়িটা দুভাগ করে বাড়ির দুদিকে দুটো আলাদা “ইজোর” তুলে পৃথক সংসার শুরু করেছিলেন আমার দুই দাদু। আমাদের বড় বড় দুটো পুকুর ছিল। একটি বাড়ীর সামনের দিকে আরেকটি পিছনে। পিছন দিকের পুকুরটি ছিল গোসল করার জন্য। বাড়ীর সামনে পুকুরটি ছিল খাবার পানির জন্য। এই পুকুর থেকেই আমাদের বাড়ী সহ আশেপাশের লোকজন সবাই খাবার পানি সংগ্রহ করতো। বাড়ীর সামনের দিকের পুকুরের সাথে অনেক বছর আগে লাগানো একটা বিশাল বটগাছ। বটগাছটি এতো বড়ো ছিল যে আমার সাহসে কুলাতো না। একা একা যেতাম না বটগাছের নীচে। আমার দাদুর বাবা, মানে আমার বড় দাদু এই বট গাছটি লাগিয়েছিলেন। ধান কাটার সময়ে বাঙালী কামলা আনা হতো দূর থেকে। এই বাঙালী কামলারা ধান কাটা থেকে শুরু করে গোলায় তুলে দিতো। শুধু আমরা না আমদের গ্রামের সকলেই ধান কাটার মৌসুমে বাঙালী কামলা দিয়ে কাজ করাতো। ৭/৮ জন মিলে এক একটা দল ছিল তাদের। সবকিছু করা শেষ হয়ে গেলে টাকা নিয়ে বাঙালী কামলারা চলে যেতো তাদের গ্রামে। সেটা কোথায় তা আমরা জানতাম না। হয়তো বাবা বা দাদুরা জানতো তাদের গ্রাম কোথায়।
তখন আমরা রাংগামাটি শহর থেকে আমাদের গ্রামে হেটেই আসতাম। হাঁটা পথ ছিল। এখনতো হাঁটা পথ নেই। আছে শুধু পানি পথ। নৌকা করেই তো সব জায়গায় যেতে হয়। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল প্রাইমারী স্কুল। সেই স্কুলের অনেক শিক্ষক আমাদের বাড়ীতেই থাকতেন। কিন্তু থাকলে কি হবে আমি মেয়ে বলে আমার কখনও স্কুলে যাওয়া হয়নি। আমার দাদু মেয়েদের পড়াশুনা করাটা একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাঁর অপছন্দের কারণে আমার লেখাপড়া আর করা হয়ে উঠেনি। আমার বোনদেরও না। যদিও বাবা মা চাইতেন আমাকে স্কুলে দিতে। লেখাপড়া শেখাতে। কিন্তু দাদুর অনুমুতি ছাড়া সেটা সম্ভব ছিলনা। তাই আমার ছোট বেলার দিনগুলো ছিল হাসি আর আনন্দে ভরা। বাড়ীর কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই। ঘুরে বেড়ানো ছাড়া ছোটবেলায় আমার আর কোন কাজ ছিলনা। মাঝে মাঝে শুধু কাকার ছোট বাচ্চাদের দেখাশুনা করা। আর কিছুই না।
কাপ্তাই বাধের পানিতে পুরাতন চাকমা রাজবাড়ী ডুবে যাবার আগে তিন বার সেই রাজবাড়ি দেখার আর বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। রানী মাতা বিনীতা রায় এর সাথে কথা বলারও সুযোগ হয়েছিল। রাজবাড়ীর এক কর্মচারীর সাথে আমার এক মাসির বিয়ে হয়েছিল। সেকারণেই রাজবাড়িতে যাওয়া সহজ ছিল আমার। আমার জীবনে এইটা এক বিশাল স্মৃতি। আমার আবছা ভাবে মনে পড়ে বিশাল চাকমা রাজবাড়ী সম্ভবত: কালো পাথর দিয়ে তৈরী করা, তবে ভিতরটা রং দেয়া ছিল। গেট দিয়ে ঢুকার পরই দুইটা বড় সিংহমূর্তি ছিল। তারপর সম্ভবত টানা বারান্দা যেখানে অনেক ছবি টাঙানো ছিল। দুটো বড় বড় হাতির দাঁত ছিল যেগুলোর মাথা লোহা দিয়ে মোড়ানো। দুটো হাতিও ছিল রাজার। রাজবাড়ীতে একটা বড় বৌদ্ধ মন্দির ছিল, ছিল একটি বিশাল নাটঘর। রাজপূণ্যার সময়ে এখানে যাত্রাপালা হতো। সম্ভবত: রাজবাড়ির ভিতর দিকে কোথাও ছিল রাজা ভূবন মোহনের একটা বড় মূর্তি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এখন, সেই মূর্তিটি কি পানিতে ডুবে গিয়েছিল, না ভেঙ্গে নতুন রাজবাড়ীতে আনা হয়েছিল! রাজবাড়ীর মধ্যে আরেকটা জিনিষ আমার মনে আছে। দোতলায় নাকি তিনতলায় আমার ঠিক মনে নেই, অনেক বড় একটা ঝুল বারান্দা ছিল। চারিদিকে গ্রীল দেয়া। সেটি আমার এখনো চোখে লেগে আছে। পিনন খাদির প্রতি রানীমার আগ্রহ ছিল খুব। যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন আমাদের গ্রামে নতুন পিনন খাদি পাওয়া যাবে কিনা। থাকলে তিনি কিনে নিবেন। আর দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। আমাদের সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা চাকমায় খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। লম্বা চুল ছিল তার। রাজবাড়ীর রাজকন্যাদেরও দেখেছি। সবাই ছিল খুব সুন্দর দেখতে। বিশেষ করে “বুড়ী”। একবার আমরা চিৎমরং থেকে ফেরার পথে আবার রাজবাড়ীতে যাই। এটাই ছিল আমার শেষ যাওয়া। মনে আছে আমার, রানীমা তখন ছিলেন দোতলায়। রাজবাড়ীর কর্মচারীর সাথে সাথে আমরাও দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। সে রানীমার কাছে গিয়ে জানালো, যে আমরা রাজবাড়ি দেখতে এসেছি। তখন আমাদের সাথে কেউ একজন ছিল যে কখনও রাজবাড়ি দেখে নাই। রানীমা অনুমতি দিয়ে বললেন ঘুরে দেখাতে এবং আপ্যায়ন করতে। রানীমাকে আমার কখনও অহংকারী মনে হয়নি। সবার সাথে খুব ভালো করে কথা বলতেন। এরপরতো আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর আর রাজবাড়িতে যাওয়া হয়নি।
এখনও স্মৃতির জলে ডুব সাঁতার কেটে রাজবাড়ির সেই ঝুলন্ত বারান্দাটা দেখতে পাই। কাপ্তাই বাধের জলে ডুবে যাওয়া ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভিটাবাড়ি স্মৃতির পিঞ্জিরায় তিল তিল করে লালন করেছি। সে কবেকার কথা। আজ এত বছর পরে তুমি শুনতে এলে।
* অাইনজীবী
** কাপ্তাই বাধের পানিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজারো একর জমি আর গ্রাম ডুবে যাবার পর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পরিবেশ রিফুউজি হতে হয়েছিল। অর্ধ লক্ষেরও বেশী চাকমা আর হাজং জনগোষ্ঠীকে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। চাকমাদের কাছে এটাই বড় পুরং নামে পরিচিত।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, যাপিত জীবন
At the core of the [Pakistan] regime’s developmental agenda was a plan to throw a dam across the Karnaphuli river, at the region’s heart, in order to create a huge hydroelectric project. The completion of the Kaptai dam in 1963 was thus intended as the infrastructural baseline for a rapid industrial take-off.39 However, not only was this seen by Bengalis as being for the benefit of the Pakistani regime rather than for the national development of its eastern part, the economic and environmental impact on the region itself, as the government-sponsoredF orestal report later acknowl-edged, was both massive and devastating. Forty percent (or 54 000 acres) of its prime agricultural land was submerged, displacing 100 000 indigenous, mostly Chakma people. Not only were they not consulted about the dam they were not compensated either financially or with other land. In fact, there was no other obvious land to offer to these sedentary rice-growing farmers; only a vastly oversubscribed residual forest area where jhuming was proving unsustainable (p. 350)
From The Chittagong Hill Tracts: A Case Study in the Political Economy of ‘Creeping’ Genocide by Mark Levene: Third World Quarterly, Vol. 20, No. 2 (Apr., 1999), pp. 339-369