গর্গ চট্টোপাধ্যায়, অতিথি ব্লগার*
কামদুনিতে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে যে মিছিলটি কলেজ স্কয়ার থেকে হাটতে শুরু করলো তাতে ছিলেন অনেক রকম মানুষ। স্বতস্ফুর্ত ভাবে এসেছিলেন অনেকে। সেই সুযোগে জনতার ভিড়ে মিশে গিয়ে অনেকে শাক দিয়ে পুরনো মাছ ঢাকার চেষ্টাও করলেন। আসলে কোন মুখ কখুন চুপ হয় কখুন মুখর হয়, তার হিসেবনিকেশ তো কারোরই অজানা নয়।তবে এই মিছিল দেখে আমার মনে হচ্ছিল অন্য কথা এই মিছিল-এ যারা ছিলেন বা সমর্থন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষের মত অনেকেই আছেন যারা হয়ত কালের নিয়মেই আর খুব বেশি বছর আমাদের সাথে থাকবেন না। এমন মনিষীদের মৃত্যু-ও কি হাইজাক হবে এক শ্রেনীর মৃত্যু-লোভি রাজ্নিইতিক নেতানেত্রী দ্বারা? এরা যদি উইল করে যান যে এদের শেষ-যাত্রায়ে দলীয় নেতা-নেত্রীরা যেন কাছেপিঠে বা তদারকিতে না থাকেন, তাহলে মৃতদেহের যে একটা নুন্যতম সম্মান আছে, সেটা রক্ষা পায়ে। এরা যদি আবার রাষ্ট্রীয় আগ্রহী থাকেন, সে অন্য কথা। কদিন আগেই তো হয়ে গেল ঋতুপর্ণের শেষযাত্রা, তাই শংকা হয়। শংকার কারনটা একটু বিশদে বলা প্রয়োজন।
আমার হাই-স্কুল পরীক্ষার সময় আমার মা আমাকে নিয়মিত মনে করাতেন যে গ্রামাঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রীদের আমার মত শহুরে পড়ুয়ার মত সুযোগ সুবিধে নেই। অতয়েব যখন তাদের নম্বর দেখে আমরা মেধা বিবেচনা করব, তখন প্রাপ্ত নম্বর এর থেকেও তাদের মেধার মান শহুরেদের চেয়ে আরো এগিয়ে, এইটা মনে রাখা জরুরি। যখন ভারত-রাষ্ট্রের সকল সংবাদমাধ্যম এক মূলতঃ অ -হিন্দি চলচ্চিত্র পরিচালকের মৃত্যুর সংবাদকে এতটা প্রাধান্য দেয়ে প্রথম পৃষ্ঠা-এ , তখন উঠে বসতে হয় বই কি। এই উপমহাদেশে বর্তমানে খুব কম শিল্পী আছেন যাদের শিল্পের মান এতই, যে তা বলিউড-কেন্দ্রিক একমাত্রিক শিল্পকল্পনার ধারণা কে কিছুক্ষনের জন্য হলেও নিষ্প্রভ দেখাতে পারে। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন এমনি একজন। এহেন ইন্দ্রপতনে শুধু নিখিল বাংলাদেশেরই অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা নয়, বিশ্ববাসী হারালো মানব-মনের এক কবিকে। এইরকম পিস কালে-ভদ্রে একেকটা আসে। বলিউডী একমাত্রিকতার চোটে এই গোত্রের শিল্পীর আবির্ভাব হওয়া দিন কে দিন আরো শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
যে ঘরটি এক মুহূর্ত আগে হাস্যোচ্ছল ছিল, মৃত্যু সেখানেই চকিতে নামিয়ে আনতে পারে অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। অনেক বাঙ্গালী -ই বহুকাল মীর আফসার আলী নামের এক ভাড়-এর ‘মিরাক্কেল’ নামক কৌতুক -অনুষ্ঠানে হাসছিল। তার সেই কৌতুকে, ঋতুপর্ণ ঘোষের ভাব- ভঙ্গিমা তুলে ধরে হাসাহাসি করেই আমরা অনেকে পরিতৃপ্ত হয়েছি। সেখানে আমরা দেখেছি, জওয়ান ছেলেরা কোনক্রমে নিজেদের ঋতুপর্ণ-বেশী কৌতুক-শিল্পীর লালশাময় থাবা থেকে নিজেদের বাচাতে উদ্যত। সমাজ-অনুমোদিত যৌন-প্রবৃত্তির বাইরের মানুষজন, তথাকথিত ‘মেয়েলি’ পুরুষ-কে এক ধরনের সদা -কামন্মাদ শ্বাপদ হিসেবে দেখানোকে আমরা অনুকরণ-কৌতুক বা মিমিক্রি বলে চালিয়েছি অবলিলায়ে। আমাদের সমাজে অন্তর্নিহিত যে রোগ-এর নির্ধারণ করতে আমরা ভয় পাই, হাসি তার-ই ঔষধ হতে পারে। এই রোগ হলো সংখ্যালঘু কে মানবেতর হিসেবে কল্পনা করা। সেই যৌন সংখ্যালঘু হোক বা ধর্মীয়/জাতিগত সংখ্যালঘু হোক। ঋতুপর্ণের অকালমৃত্যুর পরে সেই হাসির রল হঠাত থেমে গেছে। এই বাক-হীনতা অবশ্য এক যৌন-সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে নিয়ে হাসাহাসি করা নিয়ে প্রতিবাদ-হীনতার থেকে আলাদা নয়। আমাদের ভেতরে যে জীব বাস করে, তার চরিত্র নিয়ে সততা প্রকাশ করাই হতে পারে রিতুপর্নের প্রতি সশ্রদ্ধা -জ্ঞাপন। তবে আমি অত আশাবাদী নই।
আমার মনে পরে যাচ্ছে ঋতুপর্ণের বেশ প্রথম দিকের একটা ছবি, ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া – নাম ‘দহন’। কলকাতার রাস্তায়ে যৌন-আক্রমনের শিকার হব এক নারীর পরবর্তী সংগ্রামের অবিস্মরণীয় কাহিনী। ঋতুপর্ণের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা-দেবী তার সারম্বর বিদায়ের দায়িত্ব ছো মেরে নিয়ে নিলেন। আটকাবেই বা কে – দন্ড মুন্দের কর্তা তিনি। মৃত-মানুষকে কব্জা করে ধ্বজা বানানোর যাত্রা-পালা বঙ্গদেশের ক্লেদাক্ত রাজনৈতিক ঐতিজ্ঝের এক অংশ। কাস্তে-হাতুড়ি, জোড়া-বলদ, ঘাসফুল, পদ্মফুল – নানা বাহারি ধ্বজা সেসব। মৃত্যুর পরে আমরা ভুলে অনেক কিছু ভুলে যাই। তাই আমরা ভুলে যাই যে মহানগরের রাস্তায়ে যৌন-আক্রমন নিয়ে ছবি করা চলচিত্রকারের শেষ-যাত্রার তদারকি করছেন যিনি, মাত্র কয় মাস আগে কলকাতার-ই পার্ক স্ট্রিট-এ এক মহিলার গণ-ধর্ষিত হওয়ার পর এই নেত্রী-ই অবলিলায়ে বলেছিলেন ‘সাজানো ঘটনা’। ধর্ষণ-এর ঘটনাটির তদন্তকারী ছিলেন দময়ন্তী সেন নামের এক মেরুদন্দযুক্ত অফিসার। ‘সাজানো ঘটনা’টি যে সত্য ঘটনা, তা প্রকাশ পেল দময়ন্তীর সৎ তদন্তে। এই ধৃষ্টতার জন্য তাকে পত্রপাঠ বদলি করা হলো। মুখ্যমন্ত্রীর দলের আরেক বড় মাপের সংসদ সদস্যা বলেছিলেন যে এই ধর্ষণের নেপথ্যে নাকি আছে কোনো ব্যবসার দর-দাম নিয়ে মতের অমিল। হয়ে, এদেরই দায়িত্বে হলো ঋতুপর্ণের শেষ যাত্রা। এরাই শেষ নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখলেন, অভিনেতাও এরা, ঢাক-ঢোল সব এদের। আর আছি আমরা – এই নাটকের নির্লজ্জ দর্শক। গুণীকে সম্মান দিতে জানে সরকার – এই কথাটা বলতে আমাদের মুখে বাধে না। হাজার কলসি আতর ঢেলেও পচা ফুলের গন্ধ মিলিয়ে যাবে না।
এই উপমহাদেশে, যৌন-সংখ্যলঘুরা পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বারা দৈনিক নির্যাতিত হয়। এই পুরুষ-সিংহ-দের-ই কয়েকজনকে সারি নিয়ে দাড় করিয়ে রিতুপর্নের মৃতদেহের সামনে গুলি ছোড়ার ব্যবস্থা করা হলো। পোশাকি নাম – গান সালুট। যৌন-সংখ্যালঘু যে মানুষটি শায়িত ছিলেন, তার বিদেহী আত্মা কি এই গুলি ছোড়াছুড়ি দেক্ছিল সকলের অলক্ষ্যে? কি ভাবছিল সেই তখন? আমরা জানব না, কিন্তু আন্দাজ করতে দোষ নেই।
একমাত্র পাপিষ্ঠরা নিজেদের নগ্নতাকে ভয় পায়। আর সেই নগ্নতাকে ঢাকতে তারাদ্নাত্নখ দিয়ে একরে ধরতে চায়ে যা কিছুই, এমনকি মৃতদেহের চাদর বা কাফন-কেও। পাপিষ্ঠরা নিজেদের মৃতদেহের কাফন দিয়ে আবৃত করে। এরা বড় অদ্ভূত রকমের কাফন-চোর, যারা চুরি করতে গর দেব অবধিও অপেক্ষা করে না। রাতের অন্ধকারের চেয়ে এই শ্রেনীর কাফন-চোরের পছন্দ ক্যামেরার ঝলকানি আর মানুষের ভীড়। মুখে লেগে থাকে নিথর শোকের ভাব। এই নাটকের নাম দেওয়া যেতে পারে, ‘নগ্ন বিদায়।
*গর্গ চট্টোপাধ্যায় ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে মস্তিস্কবিজ্ঞানী এবং উপমহাদেশের নানা সংবাদপত্রে কলম-লেখক। এই েলখািটর একটি সংিক্ষপ্ত রূপ প্রথম অােলােত ছাপা হয়েিছল।
garga@mit.edu
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply