আ-আল মামুন, অতিথি ব্লগার*
গত বছর কলকাতায় গিয়ে শুনি ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের সেন্টারে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছেন। সেখানে সাবজেক্ট এন্ড দ্য বডি কোর্সে শরীর ও কামনার নির্মাণ এবং জেন্ডার পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে শিবাজী বন্দোপাধ্যায়ের দু-তিন ঘণ্টাব্যাপী অসাধারণ লেকচারগুলো আমাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। আর, ঘরোয়া আড্ডাতে তো তিনি মহারাজা। অন্যদের কথা বলার সুযোগ কখনোই কেড়ে না নিয়েও তিনি সূক্ষ্ম রসবোধ, সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁকে টুকরো টুকরো চটুলতা, আর বিদ্যুত চমকের মতো হঠাৎ ঝলসানো দার্শনিক প্রশ্ন তুলে সবার নজর তার দিকেই ফিরিয়ে রাখেন। ইতিহাসবিদ্যার ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ ঘরানার বিকাশ ঘটেছিল এবং জগতজোড়া খ্যাতি জুটেছিল যে সেন্টারের মাধ্যমে সেইখানে শিবাজীদা ‘ভাইরাসের’ মতো ঢুকে পড়ে উত্তর-কাঠামোবাদী অবস্থান থেকে সাহিত্য-চলচ্চিত্র-শিল্প-দর্শন-বিজ্ঞানের এবং সর্বোপরি শরীর ও তার নির্মাণের রাজনীতি নিয়ে আমাদের আগ্রহ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছিলেন। জানতে পারলাম, শিবাজীদার এহেন লেকচারগুলোর লোভেই সেন্টারে ঋতুপর্ণের নিয়মিত যাতায়াতের সূত্রপাত ঘটেছে। এবছরের শুরুতে গিয়ে দেখি বন্ধুদের খুব কাছের মানুষ ‘ঋতুদা’ হয়ে উঠেছেন তিনি। আমার জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল। ওরা জানালো শিবাজীদা ঋতুপর্ণের নতুন ছবিতে অভিনয় করবেন! চমকে উঠেছিলাম কারণ সুদূরতম দুঃস্বপ্নেও আমরা ভাবতে পারিনি প্রফেসর শিবাজী বন্দোপাধ্যায় কখনো অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেবেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রভাবেই তিনি এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র জগতের খোঁজখবর রাখেন যারা, তারা হয়তো জানেন যেকোনো অভিনেতার কাছে থেকে, এমনকি একেবারে আনকোরা কারো কাছে থেকেও, সর্বোচ্চ সুন্দর অভিনয় আদায় করে নেবার যাদুকরী দক্ষতার গুণে ঋতুপর্ণ সুবিখ্যাত ছিলেন। গোয়েন্দা কহিনী ব্যোমকেশের গল্প নিয়ে ঋতুপর্ণের নির্মাণাধীন সত্যান্বেষী অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, আমরা আর দেখতে পাবো না, পাবো না দেখতে ‘অভিনেতা’ শিবাজীদাকেও। অল্প বয়সেই মানবলীলা সাঙ্গ করে চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ বছরের শিল্পিত ক্রিড়া থামিয়ে দিলেন তিনি।
ফলে, ঋতুপর্ণের শেষ কাহিনী-নির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে আমাদের সামনে হাজির থাকছে চিত্রাঙ্গদা (২০১২)। চিত্রাঙ্গদা’র চালচ্চিত্রিক নবজীবন এবং অতঃপর অকালমৃত্যুর মাধ্যমে এই ধরাধামে ঋতুপর্ণের অনুপস্থিতি একটা আইরনি বিশেষ হয়ে রইল। নিশ্চিতভাবেই এর প্রতিকি তাৎপর্য বহুকাল বাংলা চলচ্চিত্রকে তাড়িত করবে। চলচ্চিত্রভাষ্য হিসেবে তিনি রবি ঠাকুরের কাব্যনাটক চিত্রাঙ্গদাকে এমন কায়দায় বিনির্মাণ করেছেন যা হয়ে উঠেছে অটোবায়োগ্রাফিক্যাল। চিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, এবং নিজে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রুদ্র’র ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। আর, এই সকল তৎপরতার মাধ্যমে লিঙ্গীয় পরিচয়ের রাজনীতিতে তিনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। বলা যায়, তার আত্মপরিচয় সন্ধানের জীবনব্যাপী সফরের চূড়ান্ত পরিণতি ও প্রকাশ ঘটেছে চিত্রাঙ্গদায়। নিজের পরিচয় অসঙ্কোচে দৃঢ়ভাবে নির্মাণ ও পরিবেশনের মধ্যেমে তিনি পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গীয় পরিচয় চিহ্নকারী ‘নারী-পুরুষ’ বৈপরীত্যযুগলের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং মূল্যচেতনাকে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত করে ছেড়েছেন। কিংবা হয়তো এভাবে বলাই যথার্থ হবে যে, এই নির্মাণ ও প্রস্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের নবযাত্রার অভিমুখ তৈরি করে দিয়ে গেলেন।
অবশ্যই বাংলা চলচ্চিত্র ও শিল্পের ঐতিহ্যে ঋতুপর্ণের আগের অবদানগুলোকে আমি খাটো করে দেখছি না মোটেই। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ১৯শে এপ্রিল (১৯৯৪) নির্মাণ করেই তিনি সবার নজর কেড়েছিলেন, সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন এই চলচ্চিত্রের জন্য এবং তারপর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তি তার নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল বাংলা সিনেমার যে ঐতিহ্যের সূত্রধর, ঋতুপর্ণ তার সুযোগ্য উত্তরসূরী। তিনি নিজেকে সবসময় সত্যজিৎ রায়ের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। সত্যজিৎয়ের জলসাঘর (১৯৫৮) চলচ্চিত্রে জমিদার চরিত্রে পুরুষ সত্ত্বার চূড়ান্ত প্রকাশ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ১৯শে এপ্রিলে নারী সত্ত্বার টানাপোড়েন ও বিকশিত হয়ে ওঠা দেখাতে। সত্যজিৎয়ের পরে, এবং তাকে অনুসরণ করে, তিনিই রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। চিত্রাঙ্গদার আগে নির্মাণ করেছিলেন চোখের বালি (২০০৩) ও নৌকাডুবি (২০১০)। জীবনস্মৃতি (২০১২) নামে রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল নিয়ে চলচ্চিত্র বানাবার ইচ্ছে আর তার পূরণ হলো না।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি খুবই শক্তিশালী গল্পকথক হিসেবে ঠাঁই করে নেবেন। মাত্র বিশ বছরের ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্রের ভাষায় ১৯টি শক্তিশালী গল্প নির্মাণ করেছেন। কোনো কথা না বলেও তার চরিত্রগুলো শরীর ও ভঙ্গিগুলো দিয়ে হাজারটা কথা বলে যায়। মানবসম্পর্কের আবেগীয় মাত্রাটি খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে ভীষণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। সর্বোপরি, বাংলা সিনেমায় ভনিতাহীন শরীরী বাসনার প্রকাশ তার হাতেই সবচেয়ে বেশি ঘটেছে, এবং সচেতনভাবেই তিনি তা করেছেন। বলা যায়, তার ছবিগুলোতে শারীরিক সম্পর্ক সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কোনোরকম প্রতীকের আড়াল-আব্রুর আশ্রয় না নিয়ে তিনি সরাসরি যৌনক্রিড়া দেখিয়েছেন অনেকবার। যেমন অন্তরমহলের (২০০৫) শুরুই হয় খাট ক্যাচ-ক্যাচ করা একটা সঙ্গমের দৃশ্য দিয়ে এবং নপুংশক জমিদার স্বামীর পুত্রবাসনা পূরণের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী যশোমতীকে প্রতি রাতে যন্ত্রণাকর সঙ্গমের শিকার হতে হয়। যশোমতীর আত্মহত্যার মাধ্যমে সিনেমার সমাপ্তি ঘটে। আমার মনে হয়েছে, দর্শককে তার বেদনার সঙ্গী করতেই বারবার আবেগহীন ভয়ানক সেই সঙ্গমদৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কিন্তু যেহেতু মধ্যবিত্ত বাঙালির যৌনতা নিয়ে ন্যাকামোর অন্ত নাই, অন্তরমহল তাদের সেন্টিমেন্টকে ভীষণভাবে আহত করে, আহত করে চোখের বালির অল্পবয়সী বিধবা বিনোদিনীর অকপট কামনা ও শরীরী উদযাপন। বাঙালির দেখার চোখকে বারবার তিনি বিদ্ধ ও বিপন্ন করেছেন এবং তা করেছেন নতুন সময়ের সিনেমা-ভাষা তৈরি করতে গিয়ে। নাচ-গানে আব্রু রেখে ভালগার ইঙ্গিতময় যৌনতার প্রকাশ তারা হজম করতে পারলেও সরাসরি শরীরি ক্রিড়ার উপস্থিতি তাদেরকে আড়ষ্ট করে তোলে।
যৌনজ শরীর, কামনা ও ক্রিড়ার পণ্যগুণ অস্বীকার করা যায় না। বিজ্ঞাপন থেকে বি-গ্রেড সিনেমা, সংবাদপত্র থেকে টেলিভিশন মাধ্যম সকল ক্ষেত্রেই পণ্যশরীর পরিবেশনার বাজারমূল্য আমরা জানি। তাই, নৈতিকতার পাহারাদাররা অভিযোগ উঠাবেন ঋতুপর্ণ ওইভাবে যৌনতা প্রদর্শন না-করেও তো কাহিনী পরিবেশন করতে পারতেন। তিনিও নিশ্চয় পুরুষ দর্শক চোখের ভোগের জন্যই যৌনজ শরীর, কামনা ও ক্রিড়ার বিস্তর প্রয়োগ ঘটান, যা বাঙালি দর্শকরুচির সাথে বেমানান।
কিন্তু আমরা এমন একটা সময় পরিসরে দাঁড়িয়ে যৌনতা ও শরীরের সীমানা এঁটে রাখার চেষ্টা করছি যখন নৈতিকতা ও ফিক্সিটির যেকোনো সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে জীবনের বিবিধতা। প্লাস্টিক সার্জারি ও হরমন ট্রিটমেন্ট এতোকাল প্রাকৃতিক ও অপরিবর্তনীয় হিসেবে চিহ্নিত পুরুষ শরীরকে সহজেই বদলে নারী শরীর, এমনকি উভকামী শরীর বানিয়ে তুলতে পারে, নারীর শরীরকেও বানাতে পারে পুরুষময়। এ সময়টা বহুবিধতার- হেটেরোটপিয়ার। ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবাদে যৌনতা ও শরীরী উদযাপনের বহুবিধ আয়োজনও বহু মাধমে আমাদের চোখের সামনে, কানের পর্দায়, ঘরে বাইরে, আমাদের বুকপকেটে জমা হয়ে থাকছে। এ সময়কে অনেক তাত্ত্বিক তাই চিহ্নিত করছেন পর্ণোগ্রফিক বলে। বহুবিধতা ও পর্ণোগ্রাফির এই সময়ে যৌনতা ও শরীরকে শিল্পে ব্যবহার করতে না-চাওয়া নেহায়েতই গায়ের জোরে কথা বলার সামিল। কাঙ্ক্ষিত বার্তা পরিবেশনায় পণ্যশরীর বাধাদানের শঙ্কা জাগানো সত্ত্বেও ঋতুপর্ণের ব্যক্তিজীবন ও চলচ্চিত্র মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে আমরা দেখতে পাবো যৌনতা ও শরীরকে তিনি প্রয়োগ করে চলেছেন পুরুষতন্ত্র, তার নীতিনৈতিকতা, অবদমন, এবং শেষজীবনে নারী-পুরুষবাচক বাইনারি লিঙ্গীয়-পরিচয়ের পাঁচিল ভাঙ্গার অস্ত্র হিসেবে। এক্ষেত্রেই তিনি পূর্বাপর বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের থেকে আলাদা হয়ে যান, আর এজন্যই তিনি স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রভাষা গড়ে তুলতে বারবার সচেষ্ট হয়েছেন। সকল চলচ্চিত্রেই তিনি খুব সচেতনভাবে নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ করেছেন; নারী-সত্ত্বার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে চেয়েছেন। তবু, শেষবিচারে তার চলচ্চিত্রগুলোকে রাজনৈতিক অর্থে নারীবাদী বলা যায় না, তিনি নিজেও বলেননি কখনো। কেননা, পুরুষতান্ত্রিকতাকে অস্বীকার করা বা তার বাইরে এসে র্যাডিকালি নারীবাদী ছবি তৈরি করা ভারতে, এবং হয়তো বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশেই, এখনও অসম্ভব বলেই।
নারীর কামনা নির্মাণের পরম্পরা ধরেই পুরুষতন্ত্র ও তার মানজ্ঞাপক নারী-পুরুষ বাইরির স্থিতিশীলতাকে শেষবার জোরালো আঘাত করে গেলেন তিনি জীবনের আরেকটি প্রতিসরণ ঘটিয়ে- চিত্রাঙ্গদা নির্মাণের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে নিজের আইডেনটিটির স্বীকৃতিও দাবি করে গেছেন তিনি। মহাভারতের অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা প্রেমোপখ্যান অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিত্রাঙ্গদার কাহিনী আমরা হয়তো অনেকেই জানি। মণীপুরী রাজ পুত্র কামনা করেও কন্যাসন্তান চিত্রাঙ্গদার জনক হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কন্যাকে পুত্ররূপেই পালন করলেন, চিত্রাঙ্গদা অস্ত্র ও ধণুর্বিদ্যা শিক্ষা করলেন। নারী শরীর সত্ত্বেও চিত্রাঙ্গদা যাপন করতে থাকলেন পুরুষের জীবন। অনর্থ ঘটলো অর্জুনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটায়। অর্জুনের প্রেমে মজে গেলেন তিনি। কিন্তু কুৎসিৎ কুরূপা পুরুষালী চিত্রাঙ্গদার প্রতি কোনোভাবেই অর্জুনের নজর আটকালো না। অবশেষে, অর্জুনের সাহচর্য পেতে অনঙ্গদেবের কাছে বর মেগে চিত্রাঙ্গদা এক বছরের জন্য অনন্য সুন্দরী হয়ে উঠলেন। অর্জুনের সাহচর্য মিলল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদার প্রকৃত পরিচয় গোপন রইল অর্জুনের কাছে। কিছুদিন যেতেই নারীর ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য নিয়ে অর্জুনের মোহভঙ্গ ঘটল। তিনি ভাবতে শুরু করলেন রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার কথা, তার বীরত্বগাথা। একথা গোপন রইল না চিত্রাঙ্গদার কছেও। বর হিসেবে পাওয়া নারী-রূপ তখন ভার হয়ে উঠল। পুনরায় রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার পৌরুষেয় রূপে ফিরে গিয়ে তিনি মিলিত হলেন অর্জুনের সাথে।
এই টেক্সটের ভিতরে লুকিয়ে থাকা পুরুষ সমকামীতার ইঙ্গিতকে পুনর্পঠনের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলেন ঋতুপর্ণ। তার নির্মিত চলচ্চিত্র চিত্রাঙ্গদায় পুরুষ সমকামিতা আবেগ, টানাপোড়েন, দাম্পত্যের সম্ভাবনা, পুরষ শরীরে নারী স্বভাবধারী সমকামী মানুষটির অনিবার্য নিঃসঙ্গতা, সামাজিক-পারিবারিক দ্বন্দ, পরিচয় সঙ্কট এবং সর্বোপরি, শরীরী বাসনার ক্রিড়া জ্যান্তরূপে হাজির হয়। খ্যতিমান রুদ্র প্রেমে পড়েন তারই প্রডাকশনের ড্রামবাদক পার্থর। এক পর্যায়ে রুদ্র পুরুষ শরীরের ভারমুক্ত হয়ে নিজের স্বভাবমতো সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠতে আধুনিক সার্জারির আশ্রয় নেন। কিন্তু পার্থ যে শরীরসমেত রুদ্রকে ভালোবেসেছিল তা পুরুষেরই শরীর। ফলত, অনিবার্য হয়ে ওঠে টানাপোড়েন। অবশেষে বিচ্ছেদও ঘটে যায়। অনিবার্য অসীম নিঃসঙ্গতা ও পুরুষ শরীরের ভার রুদ্র মেনে নেয়, নারী শরীর গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। আমরা হয়তো জেনে অবাক হবো, এ চলচ্চিত্রে ঋতুপর্ণের নিজেরই জীবন বিস্তারিত কাহিনী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, আমার শহর আমাকে বুঝতেও পারেনি, আমকে এড়িয়ে চলতেও পরেনি। সবসময় তিনি তার সৃষ্টি ও জীবন নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা এবং গুজবের বিষয়বস্তু হয়ে থেকেছেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ঋতুপর্ণ ঘোষ নারী বা পুরুষবাচক লিঙ্গীয় পরিচয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জনপরিসরে হাজির হয়েছেন। নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তেমন পোশাকও পড়তেন না। যদিও, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত টুইটারে জানিয়েছেন ঋতুপর্ণ নারী শরীর নিয়ে মরতে চেয়েছিলেন। কামনা-বাসনাময় যে মানুষ্য জীবন তিনি যাপন করেছেন অকপটভাবে তার চলচ্চিত্র ভাষ্য নির্মাণের মাধ্যমে শিল্পী ও তার শিল্পর দূরত্ব যেমন তিনি ঘুচিয়েছে, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করেছেন, প্রবল পুরষতান্ত্রিকতার লিঙ্গীয় রাজনীতিকেও চ্যালেঞ্জ করে গেছেন। নিজের শরীর-মন, সৃষ্টি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার সম্মিলনের এরকম নজির বাংলা সিনেমায় আর একটাও নাই।
রবি ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা নিয়ে ঋতুপর্ণ যে বিনির্মাণ ঘটান এবং ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-স্পেশাল জুরি এওয়ার্ডও জিতে নেন বাংলাদেশের পরিসরে সেরকম কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ এখনও অসম্ভব। ঋতুপর্ণর মতো চলচ্চিত্রকারকে ধারণ করার মতো সহনশীলতার পরিবেশও বাংলাদেশে নাই। চিত্রাঙ্গদার মতো কোনো চলচ্চিত্র বাংলাদেশে নির্মিত হলে তার পরিচালককে নিশ্চিতভাবেই রবীন্দ্রনাথের অন্ধভক্ত কালচার্ড হিসেবে চিহ্নিত প্রগতিবাদীরা এবং ধর্মান্ধ আনকালচার্ড হিসেবে চিহ্নিত মুসল্লীরা একজোট হয়ে শূলে চড়াবেন কিংবা দেশান্তরী করে ছাড়বেন।
*ঋতুপর্ণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এ লেখা উৎসর্গীত। লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে পিএইচডি ফেলো, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটা।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply