মাহমুদুল সুমন
কুড়িগ্রামের ধর্ষণের ঘটনা এবং প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ শিরোনামটি (http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-07-05/news/365443) ভাবাচ্ছিল আমাকে। পত্রিকা মারফত জানতে পারি, ”মেয়েটি দশম শ্রেণীতে পড়ে! প্রথম বৈ দ্বিতীয় হয়নি কোনো দিন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে। পড়াশোনাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। সে স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছে তিন পাষন্ড। মেয়েটিকে গণধর্ষণ করেছে ওরা। …সেই কিশোরী এখন কুড়িগ্রাম সদরের একটি হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর অঝোরে কাঁদছে। তার একটাই জিজ্ঞাসা, ‘কেন ওরা আমার জীবনটা নষ্ট করে দিল?’ ” (বাঁকা শব্দ আমার)
কতই বা বয়স মেয়েটির? ধর্ষণের ঘটনায় নিশ্চয় মেয়েটি অনেক কষ্ট পেয়েছে। নিশ্চয় সে কষ্ট শারীরিক ও মানসিক। কিন্তু তাই বলে তার জীবন ”নষ্ট” হবে কেন? এই ”নষ্ট” ধারণাটি একটি পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণ। আমাদের সমাজ সেই পিতৃতন্ত্রের অংশ। তাই ”নষ্ট” শব্দটার একটা অর্থ হয়ত আমি করতে পারছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটিতো একটি শব্দ মাত্র। যার একটি প্রভাব রয়েছে।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে ফেরার পথে শুনছিলাম, এক পুরুষ সহযাত্রী কি অবলীলায় এক আলাপে পরশ্রীকাতরতা শব্দটাকে রসিকতা করে বলতে থাকলেন ”পরস্ত্রীকাতরতা”, আর এই বলেই বাসে উপস্থিত পুরুষমহলে অট্টহাসির খোরাক যোগালেন। মনে হয় রসিকতা করে ওই বাস সহযাত্রীকে পরস্ত্রীকাতর বললেও তিনি আক্রান্ত বোধ করতেন না। বিপরীতে ”পরস্বামীকাতরতা” শব্দের ব্যবহার আমি কখনো শুনেছি বলে মনে হয়না।
আরেক দিন বাসে আমার কিছু নারী বন্ধুদের সাথে কুড়িগ্রামের এই ধর্ষণের ঘটনা এবং সংবাদপত্রে এনিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি নিয়ে কথা বলতেই একজন বললেন ”রেইপ হয়েছে তাই বলে জীবন নষ্ট কেন হবে… এই কথা গুলো বার বার বলা দরকার, পত্রিকা গুলোও আছে, ধর্ষণের রিপোর্ট গুলো এমনভাবে করে!” আরেকজন বললেন ”ধর্ষণের ঘটনা দু:খজনক, এর ট্রমা অবশ্যই আছে। কিন্তু তাই বলে এই ঘটনায় জীবন নষ্ট হতে যাবে কেন?”
দেখলাম বাসের একজন পুরুষ সহযাত্রী আমাদের কথা শুনে আঁড়চোখে তাকালো, কিছু বললনা অবশ্য। লোকটার তাকানোর ভঙ্গিতেই কী যেন একটা ছিল, আমি মনে মনে ভাবলাম হয়ত এই মানুষগুলোর জন্যই ছোট্ট মেয়েটি ভাবতে বসেছে, ওর জীবটা নষ্ট হয়ে গেছে। লোকটি ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল আমাদের কথা শুনে, আর আমার বন্ধুরা কথা থামায়নি। আমি মনে মনে বলছিলাম, বলুক, বার বার এই কথা গুলোই বলুক, রেপ হয়েছে তো কি হয়েছে? এ সমাজে মেয়েরা কি কম নির্যাতনের শিকার হয়? তাই বলে জীবন নষ্ট হয়ে গেল তা ভাবতে হবে কেন?
ধর্ষণের সাথে সম্পর্কিত করে আরো কিছু শব্দ (যেমন: নষ্ট হওয়া, শ্লীলতা হানি, ইজ্জত) পাবলিক ডিসকোর্সে হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়। যেমন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে প্রথম আলোরই একজন পাঠক লিখেছেন ”এই মানবতাবিরোধীদের বিচার কে করবে, কখন করবে, জাতিকে এ কলংক থেকে কে মুক্ত করবে? এরা ’৭১ এর পাকিস্তানীদের চেয়েও জঘন্য, কারণ এরা নিজ দেশের নিরীহ মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে।” (বাঁকা শব্দ আমার)
প্রতিরোধের এই ভাষাও সমস্যাজনক। ধর্ষণের সাথে এই অর্থ গুলোর সম্পর্ককে কিভাবে বদলে দেয়া যায় তাই ভাবি? শব্দের রাজনীতি যদি বুঝেই থাকি তাহলে এগুলোকে বদলে দেই না কেন? এই প্রসঙ্গে আগ্রহের সাথে লক্ষ করি একই সংবাদে আরেকটি পাঠক প্রতিক্রিয়া । গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় এখানে মন্তব্যটির প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরলাম:
”…ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তি ধর্ষকের প্রাপ্য। কিন্তু অপরাধের শিকার হওয়ার কারণে একটি মেয়ের স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল এই প্রচলিত ডিসকোর্স থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। কোন মেয়েকে ধর্ষিতার লেবেল দিয়ে অথবা তার স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সমাজ এক অর্থে মানসিক নিপীড়ন চালায়।… পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রচলিত এই ডিসকোর্স ডিকনস্ট্রাকট করার ক্ষেত্রে পত্রিকাটির উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আমরা এমন এক সমাজে বড় হতে চাই যেখানে আকস্মিক শারীরিক আক্রমণের কারণে আমাদের স্বপ্নের আকাশ সংকুচিত হবেনা।”
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
“Rape is horrible. But it is not horrible for all the reasons that have been drilled into the heads of women. It is horrible because you are violated, you are scared, someone else takes control of your body and hurts you in the most intimate way. It is not horrible because you lose your “virtue.” It is not horrible because your father and your brother are dishonored. I reject the notion that my virtue is located in my vagina, just as I reject the notion that men’s brains are in their genitals.”- Sohaila Abdulali