টিকফা চুক্তি ও নিশ্চুপ “নারী সমাজ”
নাসরিন সিরাজ এ্যানী
২৬ জুন, ২০১৩ তারিখের ঘটনা। গিয়েছিলাম টিকফা চুক্তি নিয়ে গণসংহতি কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা শুনতে । বাতিক মত প্রথমেই লক্ষ্য করলাম আলোচকদের মধ্যে নারী কেউ আছেন কি না। কাউকে পেলাম না। বক্তাদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ দু’জন ছিলেন। আরো ছিলেন উকিল, স্কুল শিক্ষক, ও গানের শিল্পী। ১৬ কোটির দেশে এসব পেশাতে নারী দেশে নিশ্চয়ই হাজার হাজার। কিন্তু আলোচক হিসেবে তাঁরা নেই। আমার মতই আলোচনা শুনতে এসেছিলেন ফটোগ্রাফার তাসলিমা আখতার। তিনিও বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। পাশে বসেই বললেন, “টিকফা নিয়ে আমাদের মেয়েদের মধ্যে কেউ এখনো বক্তা হয়ে ওঠেনি”। মন্তব্যটা তিনি গণসংহতির কেন্দ্রিয় সমন্বয়কারী কমিটির একজন হিসেবেও করলেন। আমিও সাথে সাথে তাঁর সাথে আমার হতাশার কথা ব্যক্ত করলাম যে টিকফা চুক্তি নিয়ে নারীরা চিন্তিত হয়ে ওঠেনি।
গণসংহতির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকীর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্রায় আড়াই ঘন্টার আলোচনা শুনে আমি যা বুঝলাম তা হল টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে আমরা বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে ক্রমে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়বো। যেমন, এই বিপদজনক চুক্তি নিয়ে শিল্পী অরূপ রাহী ইন্টারনেটে একটুখানি গবেষণা করেই জেনে গেছেন যে পৃথিবীতে অল্প কয়টি দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি করেছে। লক্ষ্যনীয় হল যে এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সবচাইতে অনুন্নত বললে অনুন্নত, গরীব বললে গরীব, ফ্র্যাজাইল বললে ফ্র্যাজাইল, ব্যর্থ বললে ব্যর্থ দেশ। লক্ষ্যনীয় যে, প্রবল পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় নস্যি টাইপ দেশগুলোর সাথেই কেবল টিকফা চুক্তি হচ্ছে আর এটাই প্রথমত সন্দেহজনক। দ্বিতীয় সন্দেহজনক বিষয় হল টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস খাত থেকে জিএসপি সুবিধা তুলে নেবে এরকম একটি ভুল ধারণাকে সত্য বলে প্রচার প্রচারণা।
আলোচনায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ছিলেন। শ্রোতাদের কাছে, এমনকি সাংবাদিকদের কাছেও আলোচক হিসেবে তিনিই ছিলেন মূল আকর্ষণ। এই ধরণের চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ ক্ষতি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিটিকাল পান্ডিত্য দেখাচ্ছেন তিনি। প্রথম সন্দেহের বিষয়টা তিনি আরো পরিষ্কার করলেন। তাঁর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত প্রবল শক্তিধর দেশের সাথে যে কোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তিই ভয়ংকর। কারণ, সেখানে দূর্বল পার্টির কোন বন্ধু নেই। অনেকগুলো দেশ একসাথে চুক্তি করলে সেখানে দূর্বলদের দল পাকানোর সুযোগ থাকে এবং কেউ একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতে পারে না। অতএব টিকফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মানে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আনুগত্য মেনে নেয়া, সোজা গিয়ে তার খপ্পরে পড়া। আবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এতোই বেশী যে তারা সম্পাদিত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করতেও পিছ পা হয় না। আমাদের মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্র বিস্ফোরনের ফলে বাংলাদেশের ৪৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে সেই প্রাপ্য টাকা মার্কিন কোম্পানী তো দেয়ইনি উপরন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা ঢাকায় বসে সে ক্ষতিপূরণ না দেবার ষড়যন্ত্র চালায়। আরো ভয়ংকর যে পুরো পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়েই তারা থোড়াই কেয়ার করে। যেমন, পৃথিবীর আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ঠেকাতে কার্বন পোড়ানো কমিয়ে আনার জন্য সারা বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানরা কয়োটো প্রটোকল এ স্বাক্ষর করেছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা স্বাক্ষর করলেও সেটা মানতে তারা বাধ্য নয় বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের কথা তাদের উন্নয়নের জন্য তারা বর্তমান মাত্রাতেই ফসিল ফুয়েল পোড়াবে তাতে পৃথিবীর উত্তাপ বাড়ুক কি জলবায়ূ পরিবর্তন হয়ে রসাতলে যাক তাতে তাদের কাঁচকলা।
টিকফা চুক্তি করলে একটি ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশকে পড়তে হবে যার আরেক মানে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কাছে দাসখত লেখা-কেন সরকার সেটা মেনে নিচ্ছে এরকম প্রশ্ন করলে কোন কোন আমলা নাকি আনু মুহাম্মদকে বলেছেন যে ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। এ প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ পাকিস্তানের পরিস্থিতি আমাদের লক্ষ্য করতে বলেন। তিনি বলেন পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু ভেবে তাদের সকল চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে আর এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানে মার্কিনী ড্রোন হামলায় নিরীহ মানুষের প্রাণ অকারণে অকাতরে বলি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যে কখনো কারো বন্ধু হতে পারে না এটা তিনি আবারও আমাদের স্বরণ করান। বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীর যুদ্ধ, গণতান্ত্রিক সরকারকে সামরিক ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা এই সবের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি ভূমিকার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেন।
টিকফা চুক্তি ও জিএসপি সুবিধা নিয়ে একই সময়ে আলোচিত হচ্ছে আর মনে হচ্ছে একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। জিএসপি সুবিধা নিয়ে আনু মুহাম্মদ যা বললেন তাতে আমার চক্ষু পুরো চড়কগাছ! পত্রিকায়-টিভি-রেডিওতে যে আলোচনাগুলো হচ্ছিল তাতে আমার ধারণা জন্মেছিল যে জিএসপি সুবিধা পাওয়া আমাদের জন্য খুবই জরুরী, এই সুবিধা পেলে বাংলাদেশের পণ্য, বিশেষ করে গার্মেন্টস পণ্য ট্যাক্স ছাড়া বা ন্যুনতম ট্যাক্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবে বা এরকম কিছু একটা সুবিধা পাবে। আনু মুহাম্মদের বিশ্লেষণে আমার বিভ্রান্তি কিছুটা দূর হল। তিনি জানালেন যে জিএসপি সুবিধা অন্তত গার্মেস্টস খাতে বাংলাদেশ কখনই পেত না পাবেও না। তার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন বানিজ্য নীতি। সেটা অনুযায়ী তাদের নিজেদের কারখানা যে সব পণ্য উৎপাদন করছে সেসব পণ্য তারা আমদানী করবে না বা করলেও উঁচু ট্যাক্স নিয়ে করবে। নিজ দেশের শিল্পের বিকাশের জন্য মার্কিন এই নীতি ন্যায্যই বলা যায়। কিন্তু এই নীতির ফলে বাংলাদেশের অন্তত গার্মেন্টস পণ্যের কর মওকুফের যে কোন সুযোগ তৈরী হচ্ছেনা সেটা পরিষ্কার। রহস্য হল কেন এই মিথ্যার পেছনে বিজিএমইএ, সরকার দল ও বিরোধী দলের এবং “মেইনস্ট্রীম” মিডিয়াগুলোর (যেমন, বিবিসি, প্রথম আলো) এতো ছুটোছুটি! সত্যিই কি তাহলে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে সরকারের উপর চাপ তৈরীর জন্য এই ধুম্রজাল তৈরী করা হয়েছে? আনু মুহাম্মদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের পণ্য মার্কিন মুল্লুকে ঢুকতে গড়ে ১৫% ট্যাক্স দেয় ফলে বাংলাদেশের কাছ থেকে মার্কিনীদের আয় প্রতি বছরে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এর অর্থ আসলে বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ যোগান দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ গরীব আর মার্কিনীদের দয়া দাক্ষিন্যে এ দেশ বেঁচে আছে এটা পুরোপুরি ডাহা মিথ্যা। এই ট্যাক্স কমানোর জন্য আমাদের অর্থ, বানিজ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদবির চালাতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে তারা চুপচাপ।
পাঠক আমার মতই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। মাথায় বাজ পড়ার মত কথা তো এখনো বলিইনি। আর সেটা হল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপারটি রাইট। সহজ করে বললে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হলে কম দামে কম্পিউটারের পাইরেটেড সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার পাওয়ার যে সুযোগ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভোগ করছে সেটার দফারফা হয়ে যাবে সেটা একটা দিক। আরেকটি দিক হল এর ফলে মনস্যান্টো আমাদের উপর চেপে বসবে। মনস্যন্টো পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদ ও তাদের বীজ এর মালিকানা কোম্পানীর হাতে অর্পন করে। ফলে আপনার বাড়ির উঠানে যে নিম গাছটি বড় হল সেটির মালিক আসলে একটি বহুজাতিক কোম্পানী। কৃষক যে ধান বুনলো কি তিল বুনলো তার বীজের মালিকও বহুজাতিক কোম্পানী। মনস্যান্টোর কারণে মার্কিন মুল্লুকেই শত শত কৃষক পথে বসেছে। টিকফার মাধ্যমে বাংলাদেশও সেই দুষ্ট চক্রে পড়তে যাচ্ছে। এমনকি জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজ ও খাদ্য বাংলাদেশে ঢোকার রাস্তা পুরোপুরি খুলে দেয়া হবে এই টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে।
সর্বশেষ: ১৭ জুন টিকফা চুক্তির খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে। বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায়নি বলে মিডিয়াতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিরোধী দল এই না পাওয়াকে সরকারের বিফলতা বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। এতে হয়তো আসছে নির্বাচনী সুবিধা হচ্ছে বিএনপি’র। কিন্তু এতো হৈ চৈ নাটকের নীচে চাপা পড়ে গেছে বড় বড় পুকুর চুরির বিষয়গুলো।
নিশ্চুপ “নারী সমাজ”: “নারী সমাজকে” বোবা ভাবার কোন কারণ নেই। সম্প্রতি সংসদে যে সব নারী আছেন তারা চুদুরবুদুর ও চুতমারানী শব্দ উচ্চারণ করে দেশে হৈ চৈ ফেলেছেন। বেশী দিন আগের কথা নয় হেফাজতে ইসলামের মত ভুঁইফোড় একটি দলকে রুখে দিতে রাজপথে নেমেছিলেন একদল। শাহবাগের গণজাগরনে বীরাঙ্গনা নারীদের যথেষ্ট স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছেনা তার জন্যও ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড টাঙ্গাতে দেখেছি “নারী সমাজকে”। প্রতি বছর সরকার ও এনজিওদের যৌথ প্রযোজনা নারী উন্নয়ন নীতিমালাকে রাজপথে কনটেস্ট বা প্রমোট করেন কেউ কেউ। দিল্লীতে ধর্ষণ হলে ঢাকার পার্লামেন্টের সামনে প্রতিবাদ করতে অবরোধ করতেও ঐক্যবদ্ধ তারা। সারা বিশ্বে এক বিলিয়ন মানুষ রাজপথে নেমে নারীর উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে হৈ চৈ করার আহবানে আমাদের দেশেও সাড়া পড়েছে, পালিত হয়েছে “ভ্যাজাইনা দিবস”।কিন্তু টিকফা চুক্তি ও জিএসপি সুবিধা নিয়ে যে এতো জায়গায় এতো তর্কের ঝড় হল কিন্তু “নারী সমাজ” তাতে অংশগ্রহণ করলো না। কেন? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি এখনও।
বাড়তি : টিকফা চুক্তিটির অনুবাদ দেখতে এবং প্রকৌশলি কল্লোল মোস্তফার বিশ্লেষণ পড়তে ক্লিক করুন: http://www.meghbarta.info/contemporary/3-contemporary-issues/235-2013-06-29-07-45-44.html





Leave a comment