(ছবি: যাত্রাপালার শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করছেন। প্রায়ই তাদের “অশ্লীল” গালি খেতে হয়। আলোকচিত্রী: নাসরিন সিরাজ এ্যানী)
প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরতো জানা
শ্যামলী শীল
অতিথি ব্লগার
আল্লামা আহমেদ শফীর ওয়াজ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে | আল্লমা শফীর বক্তব্য এদেশের নারী সমাজের জন্য এমনকি পুরুষের জন্যও ভয়ংকর অবমাননাকর | এইসব বক্তব্য শ্রবনে ক্ষোভ-বিদ্বেষ-তিক্ত বোধ ভেতর থেকে ওগরে আসে | ঠিক ততোধিক ওগরানো ভাবের উদ্রেক হয় শফির বক্তব্য নিয়ে তথাকথিত সমালোচকদের পুরুষতান্ত্রিক স্থূল রসবোধ দেখে | কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে নিয়ে পুরো বিষয়টিকে একটু যৌক্তিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করি |
১| আহমেদ শফির বক্তব্য ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক, পশ্চাদপদ এবং নারীর অগ্রযাত্রার পথে, সমাজের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধক| কিন্তু বর্তমান সময়ে কি শিক্ষাক্ষেত্রে, কি শ্রমক্ষেত্রে বিশাল শক্তি হিসেবে নারীর যে বিকাশ তার সামনে শফি ধারারা কি সত্যিই কোনো বড় শক্তি? কিংবা উলটো ভাবে দেখলে বর্তমান আধিপত্যশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতি (যার পৃষ্ঠপোষক গত ৪২ বছরের সকল সরকার) মুনাফার প্রয়োজনে যেভাবে নারীর শ্রমকে ঘরের বাইরে এনেছে, নারীর শরীরকে পন্য-পর্ণ করে মুনাফা গড়ার নতুন তরিকা হিসেবে প্রচলিত ধর্মীয় যৌন বিষয়ক নৈতিকতাকে চপেটাঘাত যেভাবে এই অর্থনীতির কাজে লেগেছে, সেই বিশাল পুঁজির শক্তি সত্যিই কি ভেংগে পড়ার উপক্রম হয়েছে শফি সাহেবদের সামনে? তারতো কোন লক্ষণ দেখি না | ঢাকা শহরে লাখ মানুষের সমাবেশে হেফাজত একজন নারী সংবাদ কর্মীকে ন্যাক্কারজনকভাবে লাঞ্ছনা করেছে | লাখ পুরুষের অবদমিত জিঘাংসা হামলে পড়েছে একলা নারীর ওপর | কিন্তু ঢাকা শহরে শত শত বিলবোর্ডে নারীর ‘বেপর্দা’ প্রদর্শনে তারা নূন্যতম ঢিল মারতেও সাহস করেনি | কারণ বোধ করি, হেফাজতরা এইসব বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডের পেছনকার শক্তিটাকে ভালভাবেই টের পান ! ফলে হেফাজতদের অন্তর্গত নারী বিদ্বেষ বাস্তবে কতটুকু কার্যকর সম্ভব তা বলাবাহুল্য | তবে কেন ক্ষমতাসীন শক্তি এবং তাদের প্রচার মাধ্যম শফি সাহেবদের জুজুর ভয় দেখাচ্ছে?
২| মৌলবাদী ওয়াজগুলোতে নারীর শরীর ও যৌনতাকে বিষয় করা নতুন নয় | বরং এটা বরাবরই তাদের ওয়াজ মাহফিলের প্রধান বিষয়| একদিকে দিনের পর দিন এসব ওয়াজ চলেছে, আর নারীরা এসবকে কানে না তুলে, গায়ে না মেখে নীরবে-নিভৃতে প্রতিদিন বহু সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাদের শিক্ষা-শ্রম-যোগ্যতার ভিত্তিতে সমাজে দৃশ্যমান সরব অপরিহার্য শক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে| অস্বীকার করার উপায় নেই শফি সাহেবদের এইসব ওয়াজ নিপীড়নমূলক সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে নারীকে বিশেষত গ্রামাঞ্চলের নারীদের বিবিধ নির্যাতনের মধ্যে পতিত করছে| কিন্তু বিস্ময়কর লাগে, এ যাবত কালে তাদের এইসব ওয়াজ নিয়ে প্রচার মাধ্যমগুলোতে কোনো উচ্চবাচ্চ দেখা যায়নি| তবে হঠাত করে আজ কেন হেফাজত এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এবং প্রচার মাধ্যমে তাদের ওয়াজ নিয়ে কেন এত দুঃশ্চিন্তার ঘনঘটা?
৩|বিএনপিতো এই মূহুর্তে আযান দিয়েই প্রতিক্রিয়াশীল নারী বিদ্বেষি শক্তিদের সাথে আঁতাত করেছে|| কিন্তু ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’, ‘অসাম্প্রদায়িক’, ‘প্রগতিশীল’ আওয়ামীলীগ কোন ভাষায় শফী সাহেবের ভাষাকে ডিফেন্ড করছে| জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষিমন্ত্রী বললেন, ‘জিয়ার আমলে যেসব মহিলারা পেটের দায়ে ‘পতিতা’ হয়েছিলেন তাদের কেন তখন আল্লামা শফী ২, ৩ অথবা ৪ নম্বর বিবি করে ভাত কাপড়ের ব্যাবস্থা করেননি|’ আর প্রধানমন্ত্রীতো এটাকে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে অপমান করার পুরষতান্ত্রিক ঘৃণ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেন(যেই পুরুষতান্ত্রিক হীন চর্চা ইনারা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রায়ঃশই করে থকেন)| শেখ হাসিনা রসবোধ করে প্রশ্ন তুলেছেন শফী সাহেবের নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার কাছে তেঁতুল মনে হয় কিনা; কিংবা তার পাশে বসলে তার বুকের ভেতর লালা ঝরে কিনা!তাদের এইসব রগরগে পুরুষতান্ত্রিক কুভাষায় বয়ান শুনেতো এদেশের নারীদের অপমানে-অবমানে ধরনী দ্বিধা করে বিলিন হয়ে যাওয়া উচিত| তবে কেন ‘অশ্লীলতার’ দায় শুধু হেফাজতের ঘাড়ে বর্তাবে?
৪| প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন কেন এদেশের নারী সংগঠনগুলো শফী সাহেবের বক্তব্যের বিরুদ্ধে রিট করছেন না| প্রশ্নতো আমাদেরও| সরকারের স্বার্থ পরিপন্থী গণতান্ত্রিক মতকে কীভাবে টুটিচেপে ধরা হয় তার অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী আমরা| কিন্ত, নারীর জন্য অবমাননাকর শফী সাহেবের ওয়াজ বাংলাদেশ টেলিভিষন তার নিজস্ব অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকবার প্রচার করেছে| কি উদ্দেশ্যে? এই জুজুর ভয় দেখানোর জন্য যে হেফাজতরা কী ভীষণ প্রতিক্রয়াশীল? তাতে সরকারের কী লাভ? এদেশের নারী ও সমাজের জন্য সামনে যদি সত্যি্ই ভয়ংকর দিন, তবে কেন মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ন, সংবিধানের প্রণেতা আওয়ামীলীগ সরকার নারীর অবমাননা আর সংবিধান অবমাননার দায়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শফি সাহেবের বিরুদ্ধে রিট করার সাহস দেখাচ্ছে না?
প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরতো জানা|
এদেশের নারী সমাজ নির্বাচনী রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হবে না| তারা একদিকে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল এবং অন্যদিকে ‘প্রগতিশীল’ প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতান্ত্রিক সকল শক্তি, তাদের অন্তর্নিহিত ঐক্য এবং তাদের স্ট্র্যাটিজিক শত্রু-শত্রু খেলা্কে নারী মুক্তির প্রধান শত্রু হিসেবে চিনে নিয়েছে| হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, নারীরা আর প্যাসিভ সত্বা নয়, তারা একটিভ এজেন্ট…
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply