সায়দিয়া গুলরুখ
১
রাজায় কইছে চুদির ভাই
সম্প্রতি সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের জাতীয় সংসদের নারীদের মুখে ইতর শ্রেণীর ভাষা শুনে চরম আহত হয়ে একটি লেখা লিখেছেন (প্রথম আলো ২৬ জুন, ২০১৩)। লেখাটি পড়ার পর থেকেই আমার অরূপ রাহীর এই গানটি গাইতে ইচ্ছে করছে। কেন মনে পড়ছে সেই বিষয়ে পরে আসছি। আগে গানটি শুনে নিন।
রাজায় কইছে চুদির ভাই/ রাজায় কইছে চুদির ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই
আঙ্কেল স্যামের চামচাগুলার লাজ শরমের বালাই নাই।
রাজার পোষা বুদ্ধিজীবি সুশীল সমাজ নাম
রাজার বাণী জাবর কাটা – এইটা তাগো কাম
সুশীল সমাজ কয়কি?
সুশীল সমাজ কয়কি? – শোন জনগণ
আমরা কিন্তু গরীব আছি, রাজা মেহেরবান।
রাজায় কইছে চুদির ভাই…
প্রগতিশীল বাঙালী পুরুষেরা তাঁদের কল্পনায় বাঙালী নারীর যে ’ফ্যান্টাসী’ লালন করেন তার বিশদ বর্ণনা লেখাটিতে পাওয়া যায়। লেখার যে অংশে এসে আমি ও আমার কমরেডরা প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই অংশটা তুলে ধরছি।
গত ১৫ জুন পর্যন্ত আমি বাঙালি নারীকে মনে করেছি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী। মনে করতাম ভারতবর্ষীয় নারী ডাইনীর প্রতিমূর্তি নয়। বাঙালী নারী ¯েœহময়ী ও কল্যাণী, ‘যাকে মা বলিতে প্রাণ করে আনচান।’ তবে ব্যাতিক্রম তো থাকেই। জীবনে দু–একবার গ্রাম্য নারীর কাইজ্যা ও চুলাচুলিও দেখেছি। তারা অশিক্ষিত ইতর শ্রেণীর মানুষ। সভ্যতার আলো তাদের কাছে পৌঁছায়নি। এখন টিভিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যে দৃশ্য ও অঙ্গভঙ্গি দেখি, তার কাছে গ্রাম্য ইতর নারীদের ওই ঝগড়ার দৃশ্য তেমন কিছু নয়।
আমার বন্ধুরা রাগে গরগর করেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের মা কেবা হতে চায়? আমি অরূপ রাহীর গানটাই গুনগুন করছি ক’দিন ধরে — রাজায় কইছে চুদির ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই। রাজায় কইছে চুদির ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই।”
সকল বাঙালী নারীকে মা বলে ডাকার এই আকুতি আমাকে তেমন বিচলিত করে না। কেবল পুরুষেরা বেকায়দায় পড়লে নারীকে মা–বোন ডাকে তা কিন্তু নয়, আমরা মেয়েরাও এমনটা বলি। তবে মাঝে–সাঝে। আত্ম–রক্ষার্থে। এই যে সেদিন কোর্ট পাড়াতে আমাদের দেখে কয়েকজন উকিল পুরুষের চোখ দিয়ে লালা ঝরতে দেখে আমি বলেছিলাম, “কিরে ভাই আপনাদেরকে কি বাড়িতে মা–বোন নাই?” ব্যাচারাগণ বিব্রত হয়ে সটকে পড়েন। এখানে আমরা হয়রানীকারী পুরুষের মা–বোনের সাথে কল্পিত সংহতি স্থাপন করে যৌনবাদী চোখ মোকাবিলা করেছি। ভাষার পাল্টা প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করা যায়। আবার ভাষার বিশেষ ব্যাবহার বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে, টিকিয়ে রাখে [১]। এই লেখাটিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ সংসদের ‘বাঙালী নারী’ ও ‘গ্রাম্য ইতর শ্রেণীর নারী’র মধ্যে বিভেদ টেনে বিরাজমান শ্রেণীবিভাজনকেই অনুমোদন করেছেন।
সংসদ বাংলা সমার্থ শব্দকোষ অনুযায়ী, ইতর মানে ভিন্ন, অমার্জিত, অধম। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি হিসেবে খ্যাতনামা কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ নিশ্চয়ই গরীব মানুষকে অধম মনে করেন না। তিনি নিশ্চয়ই অরূপ রাহীর এই গানটিতে যে সুশীল সমাজের চামচাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের মতন মাথা নেড়ে বলেন না, ”শোন জনগণ, আমরা কিন্তু গরীব আছি, রাজা মেহেরবান।”
তাহলে, গরীব নারীকে ‘ইতর’ কেন ডাকছেন তিনি?
২
বাঙালী নারীর মুখ
১৫ জুন, ২০১৩ পূর্ব সকল বাঙালী নারীকে সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর কল্পচক্ষে মমতাাময়ী, কল্যাণময়ী মাতা হিসেবে দেখতে পেতেন – তাঁর এই দাবী আমাকে বিচলিত করে। তবে অন্য একটি কারণে। তাঁর ইতিহাসবোধ নিয়ে বিব্রত বোধ করি। বিশেষ করে কথা যখন হচ্ছে দেশের সংসদের রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতি নিয়ে তখন নারী সংসদদের মুখে খারপ ভাষা শুনে তার আক্ষেপ বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেণী ও ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে তাঁর পাঠ সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে। তাঁর কল্পনার এই চিরন্তন মমতাময়ী, কল্যাণময়ী নারীরা কোনও দিন অপরাধ করতে পারে না। শুধু বাঙালী নারী নয়, এমনকি ভারতবর্ষের কোনও নারীকেও তিনি ডাইনী রূপে কল্পনা করতে পারেন না। নারীকে ডাইনী ডাকার পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাস আছে। সেই তর্কে এখন যাব না।
কেবল পুরুষের ইতিহাসবিমুখ ফ্যান্টাসীতেই সকল ভারতবর্ষের এবং বাঙালী নারীর স্থবির কল্যাণময়ী রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী পাঞ্জাবের গোল্ডেন টেম্পেলে সামিরক অভিযান ’অপারেশন ব্লু স্টার’ চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন [২]। যে অপারেশনে সরকারি হিসেবেই তাৎক্ষনিকভাবে ৪৯২ জন নিরীহ সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারায়। পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টোর কার্টিয়ের ও বার্গলার জুয়েলারী থেকে আধা মিলিয়ন ডলারের অলংকার কেনার কথা আমরা সবাই শুনেছি [৩]। নিজ ভাই মুর্তুজা ভুট্টোকে খুন করার অভিযোগ কাঁধে করেই কবরে গিয়েছেন বেনজীর ভুট্টো। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরূদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ আমলে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাদের অনুল্লেখিত রেখেও সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন নারী কর্তৃক সংগঠিত অপরাধ, অন্যায়ের বহু উদাহরণ খুঁেজ পাওয়া যাবে। সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাত করেছেন হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম (দ্যা ফিনানসিয়াল এক্সপ্রেস, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১২)। এই খবরতো সকলেরই জানা। গত বছর ক্ষমতার অপব্যাবহার ও দুনীর্তির দায়ে ফিলিপিনে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন্নেছাকে দায়িত্বচ্যুত করা হয় (নিউ এইজ, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১২)।
[প্রগতিশীল] পুরুষের ফ্যান্টাসীতেই বুঝি শ্রেণী–বর্ণ–জাতি নির্বিশেষে নারী যুগযুগ ধরে নিষ্কলুষ নিরপরাধ কল্যাণময়ী মায়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে টিকে থাকে । নারীকে তার কর্মফল ভোগ করতে দিন, যার যা সম্মান তাকে ততটুকুই দিন।
আলংকরিক ভাষায় হত্যাকারী বা জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎকারী চোরকে মা বানাতে হবে কেন?
৩
ইতর শ্রেণীর ভাষা
এই লেখায় নারী সংসদদের মাতৃরূপে আকাঙক্ষা করতে গিয়ে তাদের ক্ষমতার রাজনীতি ভুলে গিয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল মকসুদ। তাঁর খেদ, যে নারীর সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধির আন্দোলন করে তিনি গলা ফাটিয়েছেন, সেই নারীরাই সংসদে বসে কি না নিজ শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইতর শ্রেনীর ভাষা ও অঙ্গ–ভঙ্গিমা করছে । খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সংরক্ষিত নারী আসনে বিরোধী দলীয় মনোয়নন প্রাপ্ত সাংসদ শাম্মী আখতার বিদ্রোহী কবি হেলাল হাফিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন, নড়ে–চড়ে বসলাম:
গুছায়া–গাছায়া লন
বেশি দিন পাইবেন না সময়
আলামত দেখতাছি
মানুষের হইবই জয়
কলিমুদ্দীনের পোলা চিঠি দিয়ে জানাইছে
ভাই আইতাছি টাউন দেখতে
আমরা সবাই
শহরের, নগরের ধাপ্পাবাজ মানুষেরে কইয়েন
রেডি হইতে
বেদম মাইরের মুখে কতক্ষণ পারবো দাড়াইতে
রাই হইলেই অমুক সদনে খুব আনা–গোনা
বেশ কানা–কানি
আমিও গেরামের পোলা
চুতমারানি গালি দিতে জানি।
কবিতাটা সংসদদের আনুষ্ঠানিক ধারা বর্ণনা থেকে এক্সপাঞ্জ করা হয়েছে।
এটা সত্য, যে দ্রোহ ও শ্রেণীবৈষ্যম্যের বোধ থেকে হেলাল হাফিজ কবিতাটি লিখেছিলেন, সেই বৈষম্যের বিরূদ্ধে শ্লোগান তোলার জন্য মাননীয় সাংসদ এই কবিতাটি আবৃত্তি করেন নি। তিনি তার ধান্ধায় আছেন। তত্ত্ববধায়ক সরকার চাই, নতুন নির্বাচন চাই, বি.এন.পি–কে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাই। গায়ের পোলার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে এই রাষ্ট্রকাঠামোকে চুতমারানি গালি দেয়ার সাহস বা নৈতিকতাবোধ কোনটাই আমাদের আলোচ্য মাননীয় সাংসদের নেই।
কবি হেলাল হাফিজ সেই বহু বছর আগেই বুঝেছিলেন, ভদ্রলোক, শহরের মানুষকে গালি দিলে, তাদের গায়ে লাগে। সৈয়দ আবুল মকসুদেরও গায়ে লেগেছে। তিনি পাল্টা গালি দিয়েছেন Ñ ’ইতর।’ এই কবিতায় যে নগরের মানুষকে হাফিজ কটাক্ষ করেছেন, পরোক্ষভাবে সেই ’ধাপ্পাবাজ’ শ্রেণীর সাথেই ঐক্যবোধ করেন মকসুদ যখন তিনি লেখেন, ”জীবনে দু–একবার গ্রাম্য নারীর কাইজ্যা ও চুলাচুলিও দেখেছি। তারা অশিক্ষিত ইতর শ্রেণীর মানুষ। সভ্যতার আলো তাদের কাছে পৌঁছায়নি।”এই অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের ভাষা ও জীবনদর্শনের সাথে সৈয়দ আবুল মকসুদ দূরত্ববোধ করেন। এই দূরত্ব আমাদের মাননীয় সাংসদরা রক্ষা করতে পারলেন না বলে তিনি নাখোশ । তাঁর দূঃখ বাংলার শিক্ষিত নারীর মুখ দিয়ে সুয়েরেজের ড্রেনের মতন নোংরা ভাষা বের হচ্ছে। তাঁর দৃষ্টিতে এই শ্রেণীর মানুষের কোনও রুচিবোধ নেই। তাদের ভাষায় নেই কোনও শূচীতা। তারা হাতা–হাতি, চুলাচুলি করে। তাদের যৌন নৈতিকতারও ঠিকঠিকানা নেই।
আমার তেমন একটা গায়ে লাগেনি যখন তিনি সকল বাঙালী নারীকে মা রূপে আকাক্সক্ষা করেছেন। পুরুষের ফ্যান্টাসির কোনও রাত–দিন আছে!! সর্বোপরি, এই আকাক্সক্ষা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর অনৈতিহাসিক ও শ্রেণীক্ষমতা পাঠের দুর্বলতার স্মারক।
আমার গায়ে ফোসকা পড়েছে তখনই যখন সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার ভাই–বোনদের ইতর ডেকেছেন। এই ইতর শ্রেণীর অশিক্ষিত নারীরা গার্মেন্টসে টুলে বসে দিনে ১৮ঘন্টা সেলাই মেশিন চালায় বলেই, আপনার শহরের শিক্ষিত প্রগতিশীল পাড়াগুলোতে আলো জ্বলে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে। তাই বলছি, আসুন, ইতর শ্রেণী ভাষা আমরা সবাই শিখে নেই।
অরূপ রাহীর গান দিয়ে লেখাটির শুরু করেছিলাম। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী কবি ও তাত্ত্বিক, অড্রে লর্ডের একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করি। তিনি একবার বলেছিলেন, ক্ষমতাধরের ভাষা দিয়ে ক্ষমতার প্রাসাদ ভাঙ্গা যায় না [৪]। কল্পনা করতে শিখুন এমন নারীর মুখ, যার খিস্তি–খেউরের তোড়ে জনতার প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য হবে সংসদ।
তথ্যসূত্র:
[১] Joan Scott (1986), Gender: A Useful Category of Historical Analysis.
[২] Brian Keith Axel (2001), The Nations Tortured Body: Violence, Representation and the Formation of Sikh Diaspora.
[৩] Fatima Bhutto (2010), Songs of Blood and Sword: A Daughter’s Memoir.
[৪] Audre Lorde (1981), The Masters Tools will Never Dismantle the Masters House.
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Darun….