মাটিরাংগায় বাঙালী সেটলারদের আগ্রাসন: তনয়শশি চাকমার আগুনে পোড়া জীবন
তাইন্দং থেকে ফিরে- সমারী চাকমা
সর্বেশ্বর পাড়া। তাইন্দং ইউনিয়নের মাটিরাংগা উপজেলার একটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রাম। গ্রাম থেকে ভারত সীমান্ত মাত্র আধা ঘন্টার হাটা পথ। এই গ্রামের প্রায় সবাই চাকমা সম্প্রদায়ের বুং হোজার রনজু গোষ্ঠীর বংশধর। তবে কিছু কিছু তন্যে গোজার বংশধরও আছেন। পাশের গ্রামের নাম বগা পাড়া। তনয়শশি চাকমা। এই তনয়শশি চাকমা এই গ্রামের একজন বাসিন্দা। তার বাড়ীর রাস্তার মুখে দাড়াঁলে সামনের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সবুজ আর সবুজ চারিদিকে। সামনে বিশাল ধান্য জমির ক্ষেত। তার পরে একটু টিলা সমান উঁচু জায়গা। ওখানেও বাঙালি পাড়া। শুধু তাই নয়, সর্বেশ্বর পাড়া থেকে বের হবার মুখে রয়েছে বাঙালির বসতি। কিন্তু ঐ রাস্তার মুখে দাড়ানো অবস্থায় পিছনে তাকালে দেখা যাবে আগুনে পুড়ে যাওয়া বিশাল বিশাল দুটি গুদাম মানে মাটির ঘর দাড়িঁয়ে আছে, পুড়ে যাওয়া মাটির চার দেয়াল নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে এইবলে এইতো ৩/৮/১৩ তারিখ সকাল পর্যন্ত এখানে আমরা ভালোই ভাবে ছিলাম। বাড়ীর চারিদিকের গাছ গুলো পুড়ে গেছে। গাছের সবুজ পাতা হয়ে গেছে পুড়ে যাওয়া ইটের মতো লাল রঙ এর কাছাকাছি। এই দুই বাড়ির পর আরো একটা বেড়ার ঘর। সেটাও পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া সেই ঘরের মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে এখনো আছে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া একটা লাঙ্গলের কংকাল। হঠাৎ চোখে পড়লো উঠোনে কাপড় রোদে দেয়ার বাঁেশ দুলছে ছেড়া অর্ধ পোড়া একটা খাকি রং এর প্যান্ট। অর্ধ পোড়া এই প্যান্টটি বাতাসে দুলছেই তো দুলছে। এই তিন বাড়ির কারোর শখের প্যান্ট হবে নিশ্চয়। না হলে কেউ শখ করে সুন্দর করে এরকম অর্ধ পোড়া প্যান্ট ঝুলিয়ে রাখে !
পাশাপাশি দুটো মাটির পোড়া বাড়ির সামনে একটা তাবু খাটানো। সাদা রং এর। গ্রামকে গ্রাম পুড়ে ছাড়খাড় করে দেবার পর আর্মিরা উঠোনে এই তাবু খাটিয়ে দিয়েছে। স্বর্বশ্ব হারানো মানুষদের থাকার জন্য। একজন বয়স্ক চাকমা নারী বললো- কী দুগর্ন্ধ। ঘুমাবো কি। তাবুতে ঢুকেই তো বমি করতে করতে বের হলাম। এই রাস্তার মোড়ে গ্রামের অনেকে জটলা বেধে দাড়িয়ে আমাদের অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। কি ভাবছে ওরা আমাদের ? ত্রাণ কর্তা ? নাকি অন্য কিছু? আচ্ছা আমাদের বাড়ী যখন ১৯৮৬ সালের ১ মে তে বাঙালিরা পুড়িয়ে দিয়েছিলো আমি কি তখন এইভাবে তাকিয়ে ছিলাম তাদের যারা আমাদের দেখতে এসেছিল? আমার মনে করতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
আর আমার সামনে তিন নারী, যাদের একজন মাত্র ক্লাশ সেভেনের ছাত্রী,পাশাপাশি দুটো কাঠাঁল গাছের গোড়ায় বসে আছে। শূণ্য চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, সংগে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, নিরাপত্তাহীনতা। তাদের একজন আমাকে জীজ্ঞেস করলো এভাবে আর কতদিন। তাইতো , আর কতদিন?? এই প্রশ্নতো আমারই। কতদিন, কতবার?
এই গ্রামের কার্বারী হচ্ছেন তনয়শশি চাকমা যাঁর বয়স এখন ৬১ বছর। তাঁর বাবার নাম ছিল সর্বেশ্বর কার্বারী চাকমা। বাবার নামে নামকৃত এই গ্রাম। গত ৩/৮/১৩ তারিখে তাইন্দং এর সেটলার বাঙালিদের হামলায় ৪টি গ্রামের ৩৫ টি বাড়ীর সাথে তাঁর বিশাল বাড়ীও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘটনার ৮ দিন পর আমরা যখন তার বাড়ীতে পৌঁছায় তখনও পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া ধান থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এই ৮ দিনেও আগুন তার ধান পুড়িয়ে শেষ করতে পারেনি। সারা বছরের খোরাকের জন্য রক্ষিত এই ধান পুড়ে যাওয়াতে তনয়শশি চাকমা বারবার হাহাকার করছিলেন, এরপরে খাবো কি? বাঁচবো কিভাবে ?
এই ফেনী কূলের তাইন্দং এলাকার কত হাজারো ঘটনার স্বাক্ষী এই কার্বারী। মাত্র ৬১ বছর বয়সে তাকে যে কতবার গ্রাম থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে, কতবার তার ঘর লুট হয়েছে, কতবার তাঁর ঘর আগুনে জালিয়ে দেয়া হয়েছে তার হিসেব আমরা কি রাখি। কিন্তু তাকে রাখতে হয়। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে শুধু আগুন আগুন আর পালানো। চোখের সামনে বদলে গেছে এই এলাকা। ১৯৬২ সালের দিকে যে এলাকায় মাত্র ১২ পরিবারের বাঙালির বসতি ছিল, এখন সেখানে সীমান্তবর্তী কয়েকটা গ্রাম ছাড়া জুম্মোদের দেখা পাওয়ায় কঠিন। সব ফেনী তাইন্দং কূল এখন পুরোপুরি পুরোনো সেটলার বাঙালিদের দখলে। আর এখন এই সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলো বেদখলের সব চেষ্টা করছে বাঙালি আর প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। তাইতো এই ঘটনা। এদের গ্রাম বেদখল হয়ে গেলেই একসময়ের সমৃদ্ধশালী জুম্মো অধ্যুষিত ফেনী কূল হয়ে যাবে বাঙালির এলাকা।
অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া তনয়শশি চাকমা তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন “তখন ৬২ কি ৬৩ সাল আমার বয়স যখন ১০ বছর। সেবারই প্রথম আমাকে বাড়ী গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয় এই সময়ে। আমরা বলি জলিয়া যুদ্ধ। জলিয়া নামক জায়গাকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ হয়। জানো তখন এই আমাদের এলাকায় মাত্র ১২ পরিবার বাঙালী ছিল। এরা সবাই ভারত পাকিস্তান ভাগের সময় ভারত থেকে এখানে এসেছিল। তাও তাইন্দং বাজারে। আমার মনে আছে ২১ দিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলেছিল। আমরা সবাই পালিয়ে পাহাড়ের উপরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারপর অনেক বছর বাদে ৭১ সালে আমরা আবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল তখন। এই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা আমাদেরকে পাকিস্তান পন্থি মনে করে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। আমরা এইবার পানছড়িতে পালিয়ে গেলাম। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামে এসে গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। আমাদের বাড়ীও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর নয় মাস পরে আমরা যখন গ্রামে ফিরে আসি তখন চারিদিকে শুধু শূন্য আর শূণ্য। বাড়ী ঘর কিছুই নেই। এই শূণ্যের উপর ভর করে আমরা আবার জীবন গোছাতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু কি নিয়তি! তার কয়েকবছর পরেই আবার গোছানো বাড়ী ঘর ফেলে পালাতে হলো প্রাণের মায়ায়। ৭৯ সালে শান্তিবাহিনী বগাপাড়া বিডিআর (এখন বিজিপি) ক্যাম্প আক্রমণ করলে অনেক হতাহত হয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমরা এইবার ভারতে চলে যায়। কিন্তু সীমান্ত থেকে বিএসএফ আমাদের মেরে তাড়িয়ে দেয়। আমরা অনেকদিন পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলাম। কী কষ্টের জীবন। কিছুদিন পর গ্রামে ফিরে এসে শুধু বাড়ীই ফেরত পাই, বাড়ীতে কোন সম্পত্তিই অবশিষ্ট ছিলনা। সব লুট হয়ে গেছে। তখন আমাদের ধানের গোলায় ৩০০ আড়ি ধান ছিল। তার এক আড়িও অবশিষ্ট ছিলনা। ৮১ সালের দিকে আবার পালাতে হলো। এইবার আর্র্মি আর শান্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে গোমতিতে। আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু দূরে হলেই কি হবে, আমাদের পালাতেই হল। এইবারও আমাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হলো। ফিরে এসে সেই তো একই দৃশ্য। আগুন আর পোড়ার গন্ধ। পোড়া ধানের গন্ধ চারিদিকে। কিন্তু বেঁেচ থাকার তীব্র ইচ্ছায় আবার নতুন করে শুরু করলাম সংসার।
কিন্তু ৪/৫ বছর পার হতে না হতেই ৮৬ সালে শুরু হলে স্বরণ কালের ভয়াবহ গন্ডগোল। হাজার হাজার মানুষের সাথে আমরাও ঘর বাড়ি গ্রাম ছেড়ে প্রাণের ভয়ে ভারতে চলে গেলাম। ওখানে শরনার্থী হিসেবে পার করলাম জীবনের ১২ টি বছর। শরনার্থী মানেই তো পরদেশে পরগাছার মতো। সবাই ছি ছি ঘি ঘি করে। কিন্তু বাচঁতে হবেতো। তাই থাকা আর দিন গোনা। ফিরে এলাম ১২ টি বছর পর নিজের দেশে নিজের ভিটে মাটিতে। মনে মনে ভাবি এইবার থেকে বুঝি আর পালাতে হবেনা। কারণ শান্তিবাহিনী আর বাংলাদেশ সরকা
রের মধ্যে চুক্তি হয়েছে যে। শান্তিবাহিনী অস্ত্র ফেরত দিয়েছে। তাই ভাবলাম জীবনের এই বুড়ো বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে পারব্ ো। কিন্তু না। আজ ২০১৩ সালে এসে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে চিরতরে। কি দুখের কথা ভাবতে পারো এই পুরো ফেনীর কূল ছিল একসময় জুম্মোদের। এখন সীমান্তর্বতী মাত্র কয়েকটা গ্রাম ছাড়া কোথাও এই এলাকায় জুম্মো দেখতে পাবেনা। জায়গা জমি সব বেদখল হয়ে গেছে। তুমি কি বলতে পারো আর কতবার আমাদের বাড়ী এভাবে পুড়িয়ে দেবে বাঙালিরা, আর কতবার পালাতে হবে প্রাণের ভয়ে ? আমাদের ভবিষ্যৎই বা কি? ”
আমার কাছে এর কোনটারই উত্তর নেই। চোখের সামনে শুধু পোড়া ঘর, পোড়া ধানের গন্ধ আর পোড়া মন ।
Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে
Leave a Reply