সুস্মিতা চক্রবর্তী, অতিথি ব্লগার
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। পরিবেশ আর জীববৈচিত্রের বিপুল সমারোহে এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যের দিক থেকে সুন্দরবন শুধু আমাদেরই গর্ব নয় এর সীমা আন্তর্জাতিক–অঙ্গনেও স্বীকৃত। ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চলেরও অংশ এটি। এ হেন বনাঞ্চলের সন্নিকটে রামপালে নির্মিত হতে চলেছে কয়লা–বিদ্যুৎ–কেন্দ্র। আমাদের সরকার ‘রামপাল বিদ্যুৎ–প্রকল্প’ নামে ভারতীয় একটি কোম্পানির সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছে। ইতোমধ্যেই সেখানে বেশ কয়েক একর কৃষিজমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেই কাজটা চালাতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন–পুলিশ বাহিনী আর দলীয়–সন্ত্রাসী–ক্যাডাররা ওখানকার মানুষজনদের জোরপূর্বক উচ্ছেদও করেছে। প্রয়োজনে সেখানে প্রকল্পের কাজে আরও কৃষিজমি অধিকৃত হবে বলেও শোনা যাচ্ছে। পরিবেশ–বিশেষজ্ঞগণ নানাভাবে এ চুক্তির ভয়বহতা নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তারিত লেখালেখি করেছেন; মতবিনিময় সভায় তাদের মতামত জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞজনেরা তাদের আলোচনা–মতামতের পরিশেষে যেটা জানাচ্ছেন তা হল, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে সরকারকে অবশ্যই এই চুক্তি বাতিল করতে হবে। কিছু দিন আগে, অর্থনীতিবিদ আর জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটির একজন সক্রিয় কর্মী অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও রামপাল–বিদ্যুৎ–প্রকল্পের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় লিখেছেন (১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)। ঐ লেখাটি থেকে এ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের পাশাপাশি এটাও জানা যায় যে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটির বিরুদ্ধে সেখানকার স্থানীয় জনগণই সর্বপ্রথম প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞজনের কথা হল: যে চুক্তিটি করা হয়েছে সেটি একটি অসম আর অস্পষ্ট চুক্তি। শুধু তাই নয়, কোনো অঞ্চলে এ ধরনের চুক্তি বাস্তবায়িত করতে হলে সেই অঞ্চলটি নিয়ে যে ধরনের সমীক্ষা করার প্রয়োজন সেটি এ ক্ষেত্রে যথাযথভাবে করা হয় নাই। সরকার ইতোমধ্যে যে সমীক্ষাটি করেছে সেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এটি পরিচালিত হয় নাই বলে জানা যায়। এমনকি, সরকারের পক্ষ থেকে সিইজিআইএস যে রিপোর্টটি দিয়েছে সেটি নিয়ে ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভা হয়েছেÑ সেখানে আশি ভাগেরও বেশি বিশেষজ্ঞজন এটিকে ত্রুটিপূর্ণ আর বাজে রিপোর্ট বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশের তেল–গ্যাস–বিদ্যুৎ–খনিজসম্পদ–বন্দর রক্ষার জাতীয় কমিটিও সরকারের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। তাদের সাথে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক–পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গের সচেতন–সমাজ আর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়েছেন।
আমরা জানি, বর্তমান সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে রাষ্ট্র আর এই সমস্ত কর্পোরেট চুক্তির বিরুদ্ধে সেসব দেশের জনগণ শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আর প্রাকৃতিক–সম্পদ রক্ষা করার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা আগের চাইতে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতই তার অন্যতম উদাহরণ যেখানে এই ধরনের প্রকল্প স্থানীয় জনগণের বিরোধিতায় বন্ধ করা হয়েছে। এমনকি, ভারতের পরিবেশ আর বন্যপ্রাণী রক্ষার যে আইন রয়েছে সেখানেও বলা আছে যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পনের কি.মি. ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো জীববৈচিত্র আর বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ এলাকা বা অভয়ারণ্য থাকা চলবে না। ভারতীয় কোম্পানি যত সহজে আমাদের দেশে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার সরকারি অনুমোদন পেয়েছে তা ওর নিজের দেশে এতটা সহজে সম্ভব হত না! আন্তর্জাতিক পরিবেশগত আইনের মানদ–ও এ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় নাই।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বেশ আগেই সুন্দরবনসংশ্লিষ্ট পুরা এলাকাটি স্ব–উদ্যোগে সমীক্ষা করেন। তিনি তার সমীক্ষার ফলাফল বিস্তারিতভাবে পত্রপত্রিকায় তুলে ধরেছেন যেখানে তিনি জানাচ্ছেন যে, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সফল হলে সুন্দরবনসহ গোটা এলাকাটিতে প্রাকৃতিক–জৈবিক–আর্থ–সামাজিকসহ নানা ক্ষয়–ক্ষতির ভয়ঙ্কর রূপ ভবিষ্যতে মূর্ত হয়ে উঠবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা বিকল্প পন্থা নিয়েও তিনি পত্রপত্রিকায় আলাপ করেছেন।
সুন্দরবন আর এর সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে উক্ত প্রকল্পের যে ভয়াবহ প্রভার পড়বে সেগুলো পূরণের কোনো যথার্থ বিকল্প পথ এখনও পর্যন্ত কেউ জানাতে পারেন নাই! ফলে, সুন্দরবনের অসংখ্য জীববৈচিত্র আর এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে এই ধরনের চুক্তি এই দেশের জনগণের কাছে কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়। সামনেই জাতীয় সম্পদ–রক্ষা–কমিটি পাঁচদিন ব্যাপী এক লংমার্চের ডাক দিয়েছে। সেখানে দল–মত–নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এই অপরূপ জীববৈচিত্রপূর্ণ–ভূপ্রকৃতিকে রক্ষা করতে রাস্তায় নামবেন। ইতোমধ্যে সুন্দরবন রক্ষা কমিটিও গঠিত হয়েছে। সারা দেশের নানা স্তরের সচেতন–জনগণ এতে অংশ নিয়ে এই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সামিল হবেন।
এত কিছুর পরও যদি মহামান্য সরকার রামপাল বিদ্যুৎ–প্রকল্প–চুক্তি বাতিল না করে তবে সেটা সরকারের দিক থেকে হবে চরম ভুল। আশা করি, সরকার জনগণের স্বার্থে, সুন্দরবনের মতো এক ও অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার স্বার্থে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে আবারও বিবেচনা করবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, বিদ্যুৎপ্রকল্প–কেন্দ্র নির্মাণের বিকল্প আছে কিন্তু আমাদের এই সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নাই!
পরিশেষে, একটা কথা না বললেই নয় যে, আমাদের দেশের বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক সম্পদ আর পরিবেশ রক্ষার আইন জোরদার করা উচিত। তৃতীয় বিশ্বের একটি প্রাকৃতিক–পরিবেশ–সম্পদ সমৃদ্ধ গরীব দেশ হিসেবে আমাদের দেশ আধিপত্যশীল দেশগুলোর সাথে রাষ্ট্রীয় শাসনপ্রণালীগত নানা কারণেই এই ধরনের আরও নানা কর্পোরেট–চুক্তি করতে তৎপর থাকে। মুষ্টিমেয় শ্রেণীর লোকের বাইরে এই সমস্ত চুক্তি করে প্রকৃতপক্ষে জনগণের কোনো প্রকার লাভ হয় না। বরং বিপরীতে, হারাতে হয় পাহাড়–নদনদী–বনাঞ্চল–খনিজসম্পদসহ দেশের নিজস্ব ঐতিহ্য আর সম্পদকে। ইতিহাসে এই সত্যটাই বেশির ভাগ সময়ে প্রমাণিত। ফলে, জনগণের উচিত আসন্ন এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধে সরকারকে বাধ্য করা। জনগণের ঐক্যবদ্ধ হাতই পারে এই সমস্ত ব্যবসায়িক–তৎপরতা রুখে দিতে। মারাত্মক ধ্বংস আর অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে সুন্দরবনকে বাঁচানো তাই এখন সময়ের দাবি। আশা করছি, দেশের স্বার্থে আর জনগণের স্বার্থে সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
রাবি–ক্যাম্পাস: ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply