মাহমুদুল সুমন
বিশ্ব আদিবাসী দিবস আদিবাসীরা কেন উদ্যাপন করে? বাংলাদেশে কি আদিবাসীদের ’আদিবাসীকরন’ করা হচ্ছে? এই প্রশ্ন আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর। জবাবে কি বলা যায়? এদিকে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কিন্তু প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে এই আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নটি একটি ’বিদেশী’ চক্রান্ত। এদিকে এই নাম বিতর্কে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ওরাও সহ অন্যান্য সমাজের মানুষও কি বিভ্রান্ত হয়না? এরকম পরিস্থিতি শা¯ত্রীয় দিক থেকে আমাদের কি বলার থাকতে পারে? অনেক সময় এই বিতর্কে নৃবিজ্ঞান শা¯ত্রটির বরাত দিয়ে অনেককেই বলতে দেখি যে বাংলাদেশে আদিবাসীরা আছে এবং এটি নৃবিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত! এই ধারনাটিকেও কি সমস্যার উর্দ্ধে বলা যাবে?
বস্তুত আমাদের যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা দরকার, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশেই এই প্রসঙ্গগুলো ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক আদিবাসী অধিকার ডিসকোর্সের অংশ হিসাবে এসেছে। তবে একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি শুধু এই একটি ন্যারেটিভে আগ্রহী নই। আমি বরং বুঝতে আগ্রহী কেন, কোন প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের আদিবাসী শিক্ষিত সমাজ এই ডিসকোর্র্সটি গ্রহন করছে? এই ডিসকোর্স কি আদিবাসীদের সবাই গ্রহন করছে? আমরা কিন্তু এখনও সেই প্রশ্নের উত্তর জানিনা। আদিবাসী সমাজের দিক থেকে এই ডিসকোর্সকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করবার একটি কারনকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আর সেটি হচ্ছে পরিচয় বা পরিচয়ের প্রশ্ন, ইংরেজীতে যাকে আমরা বলি আইডেন্টিটি। পরিচয়ের রাজনীতি বা আইডেন্টিটি পলিটিক্স কেন জরুরী? এক্ষেত্রে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রান্তিকতার ধরনটি কী?
আমি এখানে খুব সংক্ষেপে শুধু উত্তর বঙ্গের পরিস্থিতির কথা বলছি। এক প্রজন্ম আগেও একজন সাঁওতাল বা মুন্ডাকে একজন হিন্দু কলা পাতাতে ভাত খেতে দিত, মুসলমান দূর থেকে কথা বলেই ফিরে যেত। শুধু দৈনন্দিন মেলমেশার ক্ষেত্র বা কমেনসালিটি নয়, আদিবাসীরা ধীরে ধীরে আরো নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত হিসেবে কাজ করেছে ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ, যখন এ অঞ্চলে ব্যাপক অভিবাসন ঘটে। এ সময় অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি দখল হয়ে যায়। এ ছাড়া ১৯৫০ সালের নাচোল বিদ্রোহ (পুলিশের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে অনেকে ভারতে চলে যান), ১৯৬২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী সম্প্রদায় জমি হারায়। আলাদা করে সাঁওতাল বা মুন্ডা নারী যৌন নিপীড়ন সহ নানা ধরণের সহিংসতার শিকার হয়, পরিচয় দিতে গেলে এই আক্রমনকারীদের ’মুসলমান’ বলেই চিহ্নিত করে সাঁওতাল, মুন্ডা বা এরকম আরো অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এরকম কিছু ঘটনাই আদিবাসী পরিচয়কে সামনে রেখে একটি আন্দোলনের পেক্ষিতের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করি।
আদিবাসীরা আগেও সংগঠিত হয়েছে। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহ ছিল উপনিবেশিক সরকারে বিরুদ্ধে। সিঁধু কানু এই আন্দোলনে নেতৃত্ত্ব দিয়েছিলেন। আবার ১৯৩০ এর দশকে ঝারখান্ডের মুন্ডা ভাষা বলা শিক্ষিত সমাজ (অনেকক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত) আদিবাসী শব্দটিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছেন। ১৯৬০ এর দশকে গারোরা আদিবাসী হিসাবেই নিজেদের সংগঠিত করে লড়াই করেছেন বন বিভাগের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে ১৯৭০ এর দশকে দিনাজপুরে আদিবাসী নামে উন্নয়নমূলক সাংগঠনিক কর্মকান্ড দেখা গেছে। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৫০ এর দশকে ল্যাটিন আমেরিকায় অসম মজুরীর প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে (দেখুন বার্শ ১৯৮৬ “ইন্ডিজেনাস পিপলস: এ্যান ইমার্জিং অব্জেক্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ল”)। মধ্য ১৯৮০এর দশকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের জন্য আদিবাসী বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক মনে করেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তখনকার অবস্থান ছিল খানিকটা এরকম: আদিবাসী বিষয়টি কেবল সেই সকল দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক যেখানে একটি জাতিগত ও বর্ণগত ভাবে ভিন্ন গোষ্ঠী কোন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীকে পরাধীন করেছে। রাষ্ট্রের দিক থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। এদিকে ১৯৮০র দশকের শুরু থেকে আজ আব্দি আন্তর্জাতিক আইনী পরিমন্ডলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রশ্নে জরুরী কিছু বদলও ঘটে গেছে। আই এল ও ১০৭ (বাংলাদেশ যার একটি সিগনেটরী রাষ্ট্র) এর জায়গায় এসেছে ১৬৯ যাকে বলা হয়েছে আগের দলিলগুলোর তুলনায় অনেক প্রগ্রেসিভ। বদল ঘটেছে সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও। অনেক রাষ্ট্রই ’আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রশ্নে এই ডিসকোর্সকে ভিন্ন ভাবে দেখতে শুরু করেছে। যেমন নেপাল এর জনজাতি আন্দোলন। বাংলাদেশ এখনও আগের জায়গায়: বাংলাদেশে আদিবাসী পদটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কটিকে ইতিবাচক ভাবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। ২০১১তে এসেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বলছেন বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তির সাথেও আদিবাসী বিষয়টির কোন সম্পর্ক নেই (দ্যা ডেইলি স্টার, ২৮ মে ২০১১)।
২০১১ সালকে এই বিতর্কের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বছর বলা যেতে পারে। এই বছর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে প্রায় দু’দশক ধরে বাংলাদেশের আদিবাসী সংগঠকদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীটি সংসদে প্রত্যাখ্যাত হয়। শুধু তাই নয়, দেশের নাগরিকরা বাঙালি হিসাবে পরিচিতি পাবে, এই মর্মে যুক্ত করা হয় নতুন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। প্রায় দুদশক ধরে আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি পাবার আন্দোলন ও সংগঠনের পর সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জনগোষ্ঠীকে হতাশ করেছে বলেই দেশের আদিবাসী সংগঠকদের দাবী। একারনেই মনে হয়, আর দশটি ইস্যুতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা যে সক্রিয়তা/ তৎপরতা/আগ্রহ দেখায় আদিবাসী ইস্যুতে সেরকম দেখা যায়না।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ব্যবস্থা প্রবল জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে বুঝতে চাইছে আসলেই বাংলাদেশে আদিবাসীরা আছে নাকি নাই। এটি একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। একারনেই আদিবাসী শব্দটি শব্দের অপপ্রয়োগ বলেও মন্তব্য করেছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমার ধারণা এরকম বাস্তববাদী দৃষ্টি দিয়ে না দেখে একটি নির্মানবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিচয় প্রশ্নটি দেখা দরকার। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখায়, পরিচয় একটি নিরন্তর সৃজিত হতে থাকা বিষয়। পরিচয় কোথাও থাকেনা, স্থিরও থাকেনা। পরিচয় নানা পরিস্থিতিতে বদলায়। আমার মতে, আজকের শিক্ষিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদিবাসী ডিসকোর্সকে উদ্যাপন করতে চাইবার মধ্যে আত্মপরিচয় নির্মাণ প্রক্রিয়াটিই ধরা পড়ে। এর পেছনে রয়েছে এক ধরনের ইতিহাস ও সামষ্টিক বঞ্চনার বোধ।
পরিচয় একটি নির্মান প্রক্রিয়া। আর এই নির্মানের পেছনে থাকে শব্দ আরা কল্পনা। কল্পনার মধ্য দিয়েই একদল মানুষ জাতি বা এথনিক দল হিসাবে নিজকে/ নিজেদের দেখতে পায়। ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ যেমন বলেছেন:
We have a country of words. Speak speak so I can put my road
on the stone of a stone.
We have a country of words. Speak Speak so we may know
the end of this travel.
এটা বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বা, বা আদিবাসী বা জুম্ম সত্ত্বা সব ক্ষেত্রেই সত্য। এরকম একটি তাত্ত্বিক অবস্থান থেকেই তানিয়া লি একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন যা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তিনি বলছেন:
একটি দলের উপজাতি হিসাবে বা আদিবাসী হিসাবে আত্মপরিচয় স্বাভাবিক বা অনিবার্য নয়, তেমনি এটি সরল অর্থে আবিস্কৃত, ধারণকৃত বা চাপিয়ে দেয়াও নয়। এটি বরং একটি অবস্থান যা ঐতিহাসিক ভাবে জমে থাকা নানা চর্চা, জায়গা-জমিন, সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ করে এবং নির্দিষ্ট ধরনের মোকাবেলা ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে। (লি ২০০০: ১৫১)
আমি মনে করি এরকম একটি সংজ্ঞার অর্থগত সম্ভবনা অনেক বেশী এবং এর মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি দেখা গেলে আমরা বাংলাদেশের আদিবাসী বিষয়ে তর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।
[লেখাটি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা’র ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি কর্র্র্তৃক প্রকাশিত একাটি স্মরণিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল ১০ নভেম্বর ২০১২।]
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply