সুস্মিতা চক্রবর্তী
মানুষের শারীরিক মূল গঠন নিজের একার তৈরি নয়। প্রতিটি মানুষই তার পূর্বনারী-পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তা নিয়ে আসে। সেখানে কেউ হয় সাদা আর কেউবা কালো, বাদামি বা আরও নানা বর্ণের [অন্য দেশের হলে]। এমনকি, মানুষের চোখ-চুল-নখ-দাঁত-কপাল-ভ্রু সমস্তটাও এভাবেই আসে। পরবর্তী সময়ে, বিভিন্ন সামাজিক নির্মাণ-মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানুষ একেক জনকে ‘সুন্দর’ বা অসুন্দর’-এর তকমা সেঁটে দেয়! যদিও সৌন্দর্য আরও বড় কিছু। মানুষের শারিরীক, আত্মিক, রুচি, ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরন আর কাজের মেলবন্ধনের মাধ্যমে প্রকৃত সৌন্দর্য বিকশিত হয়। সেখানে সাজসজ্জা থাকুক আর না-ই থাকুক। প্রকৃত ‘সুন্দর’ থেকে তাই এক ধরনের জ্যোতি ঠিকরায়। এর সাথে চামড়ার বিশেষ কোনো সম্পর্কই নাই। কিন্তু আমাদের সমাজে বিশেষ বিশেষ গোত্রের মানুষ রয়েছে। একপক্ষ সাদা চামড়াকেই সৌন্দর্য জ্ঞান করে আবার অপর-পক্ষ, যারা কিনা সঙ্গত কারণে সাদা চামড়ার প্রভুত্বপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্রেফ ভুলেই বসে থাকে যে, চামড়ার এই রকমফের-এ মানুষের আদতে তেমন কোনো হাত-ই নাই! ফলে, তারা কালো চামড়ার জয়গান করতে গিয়ে নিজেই ফের একইভাবে সাদা চামড়ার প্রতি ঢালাওভাবে বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। সাদা চামড়ার প্রভুত্ব-এর কথা আমরা জেনে এসেছি এমনকি এই প্রভুত্ব এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে বর্ণবাদিতার মতো ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি পৃথিবীকে কম গ্রাস করে নাই। এমনকি, এখনও করছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে যদি ফের সেই বর্ণবাদিতার খপ্পরেই থাকতে হয় তবে সেটা সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনে না। বরং পাল্লাপাল্টির একটা সংস্কৃতি সর্বদা জারি থাকে। একপক্ষ তখন কালো চামড়া দেখলেই আঁৎকে ওঠে আবার বিপরীতে, অন্য পক্ষ, ‘সচেতন-রাজনীতি’র নামে ঢালাওভাবে সাদা চামড়া দেখলেই বিষোদগার করে। ফলে, এই পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতির আর সুরাহা হয় না। এর সাথে আবার জুটেছে কর্পোরেট-মিডিয়া-বিজ্ঞাপন-এর নিত্য নতুন ব্যবসার নানান ফায়দা। এত দিন তারা কেবল সাদা চামড়ার পক্ষে নানান প্রচারণা চালিয়েছে। এখন দিন খানিক বদলেছে কিন্তু বিদ্যমান এই সমস্ত পুজিঁবাদী-ব্যবসানির্ভর-কর্পোরেট-মিডিয়া-সংস্কৃতির খুব তেমন বদল ঘটে নাই। ফলে, এখন আবার, এরাই কালো চামড়াকে নিয়ে মেতে ওঠেছে। ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতায়’ এখন আর স্রেফ সাদা নয়, কালোর মাথায়ও একইভাবে মুকুট তুলে দিচ্ছে তারা। আপাতভাবে বিষয়টা আনন্দের মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে বিশেষত নারীর জন্য একজন মানুষ হিসেবে, শেষ পর্যন্ত এটা প্রকৃত সম্মান বয়ে আনে না! বরং সাদা আর কালোর বর্ণবাদিতার অবসান ঘটিয়ে নারীকে নিয়ে কর্পোরেট-মিডিয়া-বাণিজ্যের এই খোলামখুচি ব্যবসা করার পায়ঁতারার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা জরুরি। অনেক জরুরি সৌন্দর্য নামক ধারণার বদল ঘটানো। স্রেফ নারী-শরীরকে পুঁজি করে সারা বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে বন্যা নানাভাবে বয়ে চলেছে তার বিপক্ষে অবস্থান আর প্রচারণাই আজকের দিনে নতুন রাজনীতির বোল হিসেবে অহর্নিশি ফোটা দরকার। যদিও আমরা জানি, আজ আর কেবল নারী নয় সকল কিছুই পণ্য-এর মোড়কে মোড়া। তারপরও শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে যে ব্যাপক কর্পোরেট-মিডিয়া-বাণিজ্যবেসাতির সহজলভ্য হাতছানি এর বাস্তবতাকে কৌতূহলী চোখ এড়াতে পারে না। তাই এই সমস্ত নারীর শরীর আর যৌনতা-নির্ভরব্যবসাবাণিজ্যের সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়া জরুরি। আর বিশেষত, নারীর জন্য তো বটেই। বাস্তবের লড়াই-সংগ্রাম সমাজে সকল নারীর জন্যই কম-বেশি বলবৎ থাকে। এগুলোকে পাশ কাটিয়ে কেবলমাত্র শরীর-সৌন্দর্য আর যৌনতানির্ভর নারীকেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্যের অবসান ঘটা দরকারি। বর্ণবাদিতার অবসান ঘটাতে গিয়ে নতুন করে আবারও বর্ণবিদ্বেষের অঙ্কুরোদগম করা উচিত নয়। বরং নারীকে এই সমস্ত থেকে বের করে মানুষরূপে দেখতে শেখা বোধ হয় অনেকখানি সম্ভাবনাময় দিকের ইঙ্গিতবাহী। তাই পুরোনো হলেও কবির সেই কবিতাই বার বার এ ক্ষেত্রে উচ্চারিত হতে পারে: ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ ভেতরে সবারি সমান রাঙা’ কিংবা অধুনা গানের কথায়: ‘কেউ সাদা কেউ কালো/ রঙিন বলেই ভাল/ রঙমশালটা একলা জ্বেলো না/ আমার মনেও জ্বালো।’
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply