নাসরিন সিরাজ এ্যানী
“রক্তের বোন” মাসিকের ত্যানা (স্যানিটারি ন্যাপকিন) নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ। এই উদ্যোগের সাথে আমার পরিচয় হয় এক কোরিয়ান মেয়ের সূত্র ধরে। কোরিয়াতে সে সেলাই কারখানার (গার্মেন্টস্ ফ্যক্টরি) শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে কাজ করে। বাংলাদেশের কোন এক শ্রমিক সংগঠনের কোন এক ফিল্ম মেকার বন্ধু জুটেছিল তার আর সেই সূত্র ধরে ঢাকায় আমার বাসায় তার বেড়াতে আসা। তার কাছে জেনেছিলাম যে, “ব্লাড সিসটার” কোরিয়ান শ্রমিক মেয়েদের এমন একটি সংগঠন যারা নিজেদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানান কাজের পাশাপাশি স্বস্তা, কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরী করে, পুরোনো ব্যবহৃত সুতি কাপড় ভাঁজ করে।
রক্তের বোনটিই আমাকে সর্বপ্রথম বাজারের জন্য বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সিনথেটিক স্যানিটারি ন্যাপকিন স্বাস্থ্য সম্মত কি না এ নিয়ে চিন্তিত করে। ওর সাথে দেখা হবার আগ পর্যন্ত আমার লড়াই ছিল মায়ের শেখানো পুরোনো শাড়ী/লুঙ্গি ভাঁজ করে বানানো ঘরোয়া ন্যাপকিন বর্জন করে “স্বাধীন” ও “আধুনিক” নারীতে রূপান্তরিত হওয়া। মাসিকের দিনগুলি মা/নানীদের যুগের মেয়েদের মত জুবুথুবু ভাবে নয়, আমি চেয়েছিলাম টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মেয়েদের মত সাদা টাইট প্যান্ট পরে হাইজাম্প, লংজাম্প দিয়ে কাটাতে। কিন্তু ব্লাড সিস্টারের কাছে ডিসপোজেবল সিনথেটিক স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরী করতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হয় জেনে বিজ্ঞাপনের উপর সরল বিশ্বাস আমার ভেঙ্গে পড়ে। আমাকে সহজভাবে বোঝাতে ও আরও বলল, “তুমি নিজেই ভেবে দেখো কোনটা তোমার ভ্যাজাইনার মত স্পর্শকাতর ও নাজুক অঙ্গের জন্য স্বাস্থ্যকর? একটা প্লাস্টিক না পরিষ্কার সূতী কাপড়?” পরে আমার ডাক্তার বোনের সাথে বিষয়টি আলাপ করে দেখি সেও মাসিকের দিনগুলিতে ঘরে বানানো সুতি কাপড়ের ন্যাপকিন ব্যবহারের পক্ষপাতি।
তের বছর বয়সে যখন আমার প্রথম মাসিক শুরু হয় তখন আম্মু শিখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে পুরোনো সূতী শাড়ী কেটে ন্যাপকিন বানাতে হয়। ব্যবহারের পর সেগুলো সেদ্ধ করে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যেত। কিন্তু বরাবরই প্রচন্ড অলস আমি। কাপড় ধোয়ার মত কাজ করতে আমার ভাল লাগতো না। বেশীরভাগ মেয়েদের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি কবে তাদের মাসিক হল কেউ টের পায় না, অথচ আমার দিনগুলোতে আমার বিছানা, জামা কাপড় সব রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়। মাসিক শুরু হবার আগে ও চলমান দিনগুলোতে আমার তলপেটে থাকে প্রচন্ড ব্যাথা। ফলে আমার জন্য ডিসপোজেবল স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে কিনতে পাওয়া যাওয়া ছিল একটা আশীর্বাদের মত। মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে, বাবার কাছে আবদার করে আমি আমার জন্য এটা কেনার বাজেট বরাদ্দ করেছিলাম। সেটা ১৯৮৭ সালের কথা। সেই সময়ে টেলিভিশনে ডিসপোজেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ছিল। ফলে এর ব্যবহার এতোটা বিস্তার লাভ করেনি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
পাল্টে যাওয়া এই পরিস্থিতি নিয়েই আমার এক সাংবাদিক বান্ধবীর সাথে একদিন রিক্সায় করে ঢাকার অলি গলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ করছিলাম। প্রসঙ্গটি সাংবাদিক বান্ধবীটিই তুলেছিল। একদিন কি এক ওষুধ কিনতে সে ফার্মেসীতে ঢুকেছে এমন সময় একটি তরুনীও নাকি সেই দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনবে বলে ঢোকে। আমার বান্ধবীর গল্পের মূল প্রতিপাদ্য দোকানদারের সাখে মেয়েটির স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটের রং বাছাই নিয়ে কথপোকথনটি। ওর কাছে মনে হয়েছে মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। মানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত বিষয়ে কথা বলা নিয়ে মেয়েদের যে লজ্জা আগে ছিল তা এখন ভেঙ্গে গেছে। “আমাদের সময় এরকম ছিল না”, বললো সে। আমিও একমত হলাম। আসলেই আগে আমরা কতই না লজ্জা নিয়ে ফার্মেসীতে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে ঢুকতাম আর কোনমতে জিনিষটা কিনে চট করে লুকিয়ে ব্যাগের ভেতরে পাচার করে তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। দোকানীও এই গোপনীয়তার খেলায় অংশীদার হত আমাদের। খবরের কাগজে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটটা মুড়ে টুড়ে একদম একাকার করে ফেলতো সে। দেখে বোঝা যেত না সেটা স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট না বাংলা একাডেমীর অভিধান। দোকানীর সাথে স্যানিটারি ন্যাপকিন কোন ধরনেরটা নেবো- প্যান্টি না বেল্ট, দেশী না বিদেশী, এক্সট্রা লার্জ না এক্সট্রা থিক, সেনোরা না হুইসপার, নাকি ফ্রিডম – এতো বিষয়ে আমাদের কথাই হতো না।
রক্তের বোনের সতর্কতা স্বত্তেয় ডিসপোজেবল সিনথেটিক স্যনিটারী ন্যাপকিন মাঝে মাঝে আমি এখনো ব্যবহার করি। না করে কোন উপায় নেই কারণ এমনই অস্থির দুনিয়ায় বসবাস আমাদের। এখন সারাক্ষণ আমাদের ছুটতে হয় পয়সা রোজগারের ধান্দায়। এমনকি রজস্রাবের বিশেষ দিনগুলোতেও। অবসর নেই আমাদের, ক্লান্তিও নেই। মধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত নারীদের কথাই বলছি আমি। একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের রজস্রাবের দিনগুলোতে তাদের ঘর থেকেই বের হতে দেয়া হতনা। সংস্কারটাতে হয়তো মেয়েরা মাসিকের ঐ বিশেষ সময়ে কর্মব্যবস্থা থেকে কিছুটা রেহাই পেত, রেস্ট পেত। সংস্কারটা কু বলে আমরা তাকে বিদায় করেছি কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি কাকে এগিয়ে নিতে নিজেদের শরীরের সুস্থতাকে বিসর্জন দিচ্ছি? মেয়েরা আমরা কিসে এগিয়েছি? বাজারে যেসব স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায় সেগুলো স্বাস্থ্য সম্মত কি না সেই প্রশ্ন করার, বৈজ্ঞানিক ভাবে পরীক্ষা করার যোগ্যতা কি হয়েছে আমাদের?
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যাপিত জীবন
Leave a Reply