কমলছড়িতে ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং অতঃপর: জাতীয়তাবাদী সহিংসতার লিঙ্গীয় স্বরূপ

কমলছড়িতে ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং অতঃপর:
জাতীয়তাবাদী সহিংসতার লিঙ্গীয় স্বরূপ

সমারি চাকমা

DSC00531

এই ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখ খাগড়াছড়ি সদর এলাকার কমলছড়ি এলাকাতে নিজ বাড়ীর কাছাকাছি বালু চরে সবিতা চাকমা (২৫) নামে এক পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করা হয়। সবিতা চাকমার স্বামী বাদী হয়ে একটা মামলা করেন খাগড়াছড়ি থানাতে। কিন্তু ধর্ষক আর খুনী হিসেবে যাদের নাম এজাহারে লেখার কথা ছিল তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকৌশলে বাদ দিয়ে দেন। আসামী হিসেবে এজাহারে লেখা হয় অজ্ঞাতনামা। উপরুন্তু এজাহারে সন্দেহ হিসেবে নাম লিখিত হয় ৭০ বছরের এক পাহাড়ির নাম। কেন ? পরে জানতে পারি, বয়স্ক যে জমিতে সবিতা চাকমার মৃতদেহ পাওয়া গেছে সে জমির মালিক এই ৭০ বছরের বৃদ্ধ। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দোষী ব্যাক্তিদের গ্রেফতারের দাবীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দুর্বার নেটওর্য়াকও পৃথক ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যায় সবিতা চাকমার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবীতে। দুর্বার নেটওর্য়াক কমলছড়ি নারীদের নিয়ে ঘোষনা দেয় ধষর্ণকারী ও হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত এই গ্রামে কোন ভারী যানবাহন চলতে পারবেনা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ভারী মালপত্র বহনকারী যানবাহন বন্ধ। এবং এই ঘটনাকে অন্য রূপ দিতে খাগড়াছড়ির সাম্প্রদায়িক মহল বাঙালী ছাত্র পরিষদকে সামনে রেখে ভুয়োছড়ি সেটলার বাঙালীদেরকে উস্কে দিয়ে পাহাড়ি গ্রামে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। প্রথমে গত ২৫ ফেব্রুয়ারী এবং ২য় দফা হামলা করা হয় তারপরের দিন, ২৬ ফেব্রুয়ারী সকালে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়। কমলছড়ির গ্রামবাসীদের অভিযোগ সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই বাঙালীরা হামলা করেছে পাহাড়িদের উপর।

এই ঘটনায় অনেক পাহাড়ি গুরুতর আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনা এবং আহতদের খোঁজ নিতে গত দুদিন ধরে হাসপাতাল যেতে হচ্ছে। ১ম হামলায় আহত হয়েছিল দুই জন: পান্ডব চাকমা এবং আনন্দলাল চাকমা। ২য় বারের হামলায় হাসপাতালে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন মামনি চাকমা, বিপ্লবজ্যোতি চাকমা, রমা দেবী চাকমা। এরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। গ্রাম বেতছড়ি বড়নালা গ্রাম। বিপ্লবজ্যোতি আর রমাদেবী মা-ছেলে। মামনি চাকমা তাদের রক্তের কেউ না হলেও রমাদেবীর মেয়ের মত। হাসপাতালে দোতলায় উঠেই বারান্দায় কয়েকজন পাহাড়ির সাথে দেখা হলো। আমাকে তারাই নিয়ে গেলেন মহিলা ওয়ার্ডের একেবারে মামনি চাকমার বেডের পাশে। এক ভাই দাড়িয়ে আছে মামনি’র এক হাত ধরে। আরেক হাতে স্যালাইন চলছে। মামনির চোখ দিয়ে পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। আপাতঃ দৃষ্টিতে মামনি’র কিছু হয়েছে বোঝার কোন উপায় নেই কারণ কোথাও সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো নেই। সব ঠিকঠাক। কিন্তু হয়েছে অনেক কিছু। বৃষ্টির মত বাঙালীরা তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে। হাত দিয়ে ঘুষি চর থাপ্পর মেরেছে। মেরুদন্ডে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে সে। একা উঠে বসতে পারছে না। একটা হাত আর পা নাড়াচড়া করতে পারছেনা মামনি।

আরেকটা মহিলা ওয়ার্ডে রমাদেবী চাকমা (৭০) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেডে শুয়ে আছেন। বুকের একেবারে নীচে দায়ের কোপ লেগেছে। ১০ টা সেলাই দেয়ার পর ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। আমি যখন গেলাম তখন তার ঠোট শুকিয়ে কাঠ। ডাক্তার বলেছেন ঠোটে তুলা দিয়ে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দিতে। অথচ হাতে তুলো পানি কিছুই নেই। তার সাথে কথা বলে গেলাম রমাদেবীর ছেলে বিপ্লবজ্যোতি চাকমার কাছে, পুরুষ ওয়ার্ডে। ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন বেঁেচ আছেন এই জন্যে। বিপ্লব চাকমা মনে করেন, তার বাঁচার কোন আশা ছিলনা, তারতো মরে যাওয়ার কথা ছিল। বিপ্লবজ্যোতি চাকমার স্ত্রী সুমোরানী চাকমার বলেন “ভগবান যদি সে সময়ে হাত না পাততো আমার স্বামী,শাশুরী,ননদ এবং আমরা কেউ বাঁচতে পারতামনা। আমার স্বামীর গলা ছুড়ি দিয়ে কাটা হয়েছে, সেখানে সাত সেলাই লেগেছে জোড়া লাগতে, মাথায় কাটা হয়েছে, সেখানেও সেলাই দিতে হয়েছে। পায়ে। শরীরের কোথাও তো বাদ যায়নি। যারা হামলা করেছে তাদেরকে আমরা সবাই মুখ চেনা চিনি। আমরা তাদের সাথে এক ঘাটে পানি খাই। ভেবেছিলাম তারা আমাদের মারবে না। তাই আমরা গ্রামে ফিরে এসেছিলাম।” এই তিনজনকে ঘটনার দিন দুপুরের দিকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করায় মারাত্মক আহত অবস্থায়। আর এই তিনজনকে দেখাশুনা করছেন ভাগ্যক্রমে বেঁেচ যাওয়া বিপ্লবজ্যোতি চাকমার স্ত্রী সুমোরানী চাকমা। সেও আমাদের সাথে হাসপাতাল ঘুরছিল তার দুই শিশুপুত্র নিয়ে। সবার ছোট ছেলেটার বয়স ৪ বছর আর বাকপ্রতিবন্ধি।

তাদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শোনা গেল। কমলছড়িতে ২৫ ফেব্রুয়ারী বাঙালী সেটলাররা হামলা করার পর সারা এলাকা জুড়ে পাহাড়িদের গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কখন কোনদিকে কোন গ্রাম এই বার হামলা করে বাঙালী সেটলাররা? সে প্রশ্ন সকলের মনে। তাই বেতছড়ি বড়নালা গ্রামের লোকেরাও রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল। এদিকে বাঙালীরা আতংক ছড়াতে এলাকায় সারারাত গুজব আর সাজানো নাটক চালাতে থাকে। ভুয়োছড়ি বাঙালী সেটলাররা গ্রাম থেকে রাতভর পাহাড়ি গ্রাম বেতছড়ি বড়নালা, চাকমা খ্রীষ্টান পাড়ায় পাহাড়িদের ফোনে ফোন দিতে থাকে এই বলে- তাদের এক বাঙালী রাখাল ছেলে হারিয়ে গেছে। তাদের গ্রামে আছে কিনা খোঁজ করতে। বেতছড়ি বড়নালা, চাকমা খ্রীষ্টান পাড়ার গ্রামবাসীরা বাঙালীদের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে সকলেই সর্তক অবস্থান নেয়। কিন্তু সকালে বেতছড়ি গ্রামের কিছু গ্রামবাসী ফিরে এলে শুরু হয় বাঙালীদের আক্রমণ। ফিরে আসা এই চাকমা পরিবাররা ভেবেছিল যেহেতু ভুয়োছড়ি গ্রামের বাঙালীদের সাথে তারা এক ঘাট থেকে পানি পান করে সেহেতু তাদের মারবেনা। কিন্তু তাদের সে বিশ্বাসের মূল্য দিতে হয় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে। এই হামলায় ভুয়োছড়ির শতশত সেটলার অংশ গ্রহণ করে। ভুয়োছড়ি সেনাবাহিনীর পোষ্ট এই গ্রাম থেকে বেশী দূর নয়। সেটলার বাঙালীরা বেতছড়ি বড়নালা গ্রামে সকাল ৯ টা বা ১০ টার দিকে আক্রমণ করলে সবাই পালাতে পারলেও মামনি এবং রমাদেবীর পরিবার পালাতে পারেনি কারণ, যাকে মামনি নিজের মায়ের মত বলে মনে করেন, তিনি নাতিকে নিয়ে কাছের ছড়ার গোসল করতে গেছেন। এরই মধ্যে হামলাকারীরা তাদের উপর আক্রমণ শুরু করলে শিশুটি পাহাড়ের উপরে উঠে আসতে পারলেও রমাদেবী চাকমা সেটলারদের দায়ের কোপে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হন মাকে বাচাঁতে ছেলে চলে যায় পাহাড়ের নীচে। কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীরা নারায়ে তকবির করতে করতে বিপ্লবজ্যোতি চাকমাকে হামলা করে। এইবার মায়ের পালা ছেলেকে বাচাঁনোর। হামলাকারীদের দায়ের কোপে মায়ের পেট কেটে রক্ত ঝড়ে পড়ছে। মা দেখেন- বাঙালীদের দায়ের কোপে ছেলের মাথা থেকে রক্ত বের হলো, গলা কেটে গেলো এরপর শুধু রক্ত আর রক্ত। ঐদিকে পাহাড়ের ওপর থেকে চিৎকার, ওখানে চার পাঁচজন বাঙালী মামনি চাকমাদের মারতে ছুটে গেছে। একজন হামলাকারী শিশু রমেল চাকমাকে মারতে গেলে মামনি চাকমা তাকে এক ধাক্কায় পাহাড়ের খাদে ফেলে দিলে শিশুটি বেচেঁ যায়। এরপর মামনি চাকমা দৌড় দিয়ে মাকে আর ভাইকে বাচাঁতে ছুটে এলে চার পাচঁজন সেটলার তাকে ঘিরে ধরে লাঠি সোটা দিয়ে পেটাতে থাকে। মা রমাদেবী রক্তাক্ত অবস্থায় হামলা কারীদের কাছে ছুটে যান বলেন,‘তাকে মেরোনা, আমাকে মেরে ফেল। আমাদের কি দোষ যে এভাবে আমাদের মারতেএসেছো। মেরে ফেলো কেটে ফেলো’ বলতে থাকলে বাঙালী সেটলাররা ‘সব পাহাড়ি কেটে ফেলব’ বলতে বলতে চলে যায়।

2014-02-26 15.49.09

সুমোরানি চাকমার ভবিষ্যৎ এখন কালো অন্ধকারে ঢাকা। শাশুড়ী আর স্বামী মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে। দুটো শিশু পুত্র নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া এই মুহুর্তে অসম্ভব ব্যাপার। একমাত্র উপার্জনকারী হিসাবে স্বামী বিপ্লবজ্যোতি চাকমাতো চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেলো। কিভাবে সংসার চলবে, নিরাপত্তা কে দেবে, গ্রামে কবে ফিরতে পারবে এই নিয়ে তার দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই।
এতো গেল ২৬ ফেব্রুয়ারীর ঘটনার কথা। এর আগের দিন ২৫ শে ফেব্রুয়ারীতে সংঘটিত ঘটনার তদন্তে জানা গেল-
সন্দেহভাজন অপরাধী ট্রাকের ড্রাইভার আর হেলপারকে গ্রেফতারের দাবীতে কমলছড়ি এলাকাবাসী সহ সর্বোস্তরের জনগণ আন্দোলন করার কারণে খাগড়াছড়ির সাম্প্রদায়িক শক্তি বাঙালী সেটলারদের নিয়ে মাঠে নামে অপরাধীদের বাচাঁতে। বাঙালী ছাত্র পরিষদের ব্যানারে তারা মানব বন্ধন করে এই দাবীতে যে সবিতা চাকমার ধর্ষণকারী আর হত্যাকারীরা বাঙালী নয়। সবিতা চাকমা হত্যাকন্ডের ঘটনা বাঙালীদের উপর দায়চাপানো ষডযন্ত্র বন্ধ করে ঘটনার সুষ্ট তদন্ত করতে হবে। ২৫ তারিখ মানব বন্ধনে বক্তব্য দেন খাগড়াছড়ির পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম। এইটা উল্লেখ করার বিষয় যে- বাঙালী ছাত্র পরিষদ সেদিনই মানব বন্ধন করে যেদিন সবিতা চাকমার অন্তোষ্টক্রিয়া মানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল। পাহাড়ি সমাজের নিয়ম মতে মৃত্যুর পর ৩ বা ৫ বা ৭ বা ১০ দিন এর মধ্যে মৃত ব্যাক্তির আত্মার সদগতির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হবে। তো সেদিন ছিল সেই দিন- গ্রামের সবাই ব্যস্ত ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে। সেই সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল গ্রামের নেতৃত্বস্থানীয়দের সাথে বাঙালী পাহাড়ি ব্যবসায়ীদের। যেহেতু ভারী যানবাহন অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে- সকলের সমস্যা হচ্ছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এই মিটিং। এবং মিটিং এ গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তও হয়েছিল। ঠিক সেই মুহুর্তে সেটলার বাঙালীরা উস্কানীমূলক শ্লোগান দিতে দিতে চলে যায় এবং শশ্মানে গিয়ে জড়ো হয়।
তারপরের ঘটনাতো সবার জানা। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পাহাড়িদের উপর হামলা হয়। দুজন আহত হয়। গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়ি লুটপাত, কৃষি জমি নষ্ট করে দেয়া সহ তামাকের ক্ষেত কেটে ফেলে দেয়া হয়।

এলাকাবাসী এবং আহত ব্যাক্তিদের সংগে কথা বলে জানা যায় যখন বাঙালী আর পাহাড়ি রা মুখোমুখি অবস্থান করছে কিছুক্ষণ পর ভুয়োছড়ি সেনাবাহিনী পোষ্টের কমান্ডার তার বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এতে পাহাড়িরা গ্রামের একটু ভিতরের দিকে সরে আসে। কিন্তু সেনাবাহিনীর উপিস্থিতিতেই তখন বাঙালী সেটলাররা পান্ডব চাকমাকে লাঠিসোটা দিয়ে আঘাত করে। ফলে পান্ডব চাকমা মাথায় হাতে কাঁেধ আঘাত প্রাপ্ত হয়ে গুরুতর আহত হয়। পান্ডব চাকমা একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। একই সাথে আনন্দলাল চাকমা নামে আরেকজনকে সেনাবাহিনী ঝাপটে ধরে রাখে আর একজন আনসার বাহিনীর সদস্য তাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে আহত করে। ফলে আনন্দলাল চাকমার হাত ভেঙে যায়। সেদিনের ঘটনায় এলাকাবাসী অভিযোগ করে যে, পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট,সেনাবাহিনী আর হামলাকারী সেটলাররা একসাথে দাড়িয়ে থেকে গল্পগুজব করছিল। একদিকে প্রশাসন সহ বাঙালী সেটলাররা আরেকদিকে নিজেদের আর গ্রামকে রক্ষার জন্য সকল গ্রামবাসী। তাদের মতে পুলিশ সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করলেই বাঙালী সেটলাররা কমলছড়ি পাহাড়ি গ্রামে হামলা করতে পারতো না।

এই দুটো ঘটনায় বাঙালী ৪ জন আহত হয়ে একই সাথে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তারা কিভাবে আহত হয়েছে, পাহাড়িরা বাঙালী গ্রামে গিয়ে হামলা করেছিল কিনা-এই প্রশ্নের উত্তরে মোঃ রিপন তরফদার বললো- “না না পাহাড়িরা আমাদের গ্রামে হামলা করেনি। আমি রিক্সা চালাই। সারাদিন রি´া চালিয়ে বাড়ী ফেরার পর আমি শুনলাম আমার ভাগনে হারিয়ে গেছে। তাই আমরা লাঠি সোঠা নিয়ে তাকে খুঁজতে পাহাড়িদের গ্রামে যায়। তখন পাহাড়িরা আমাদের হামলা করলে আমি আহত হই।”

“ আপনার ভাগনের নাম কি?”

রিপন তরফদার তার স্ত্রী আফরোজাকে ডেকে জীজ্ঞেস করলেন “ভাগনের নাম কি যেন?”
স্ত্রী আফরোজা উত্তর দিলেন “আমি জানিনা।” অবশ্য কিছুক্ষণ পর আফরোজা বললো নাম- শহীদূল।

আরেকজন আহত ব্যাক্তি নাম রাশেদূল- সেও উত্তর দিলো, “না না পাহাড়িরা আমাদের গ্রামে হামলা করতে যাবে কেন? মানব বন্ধন থেকে ফেরার পথে পাহাড়িরা গুলতি মারে এতে আমার কপালে আঘাত লাগে।”

বাংলাদেশে ভাষার মাস হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাস। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে নিজেদের ভাষার মর্যাদার অস্তিতের¡ জানান দিতে নিজের জীবন দিতে দ্বিধা করেনি রফিক সালাম জব্বার। সেই ফেব্রুয়ারী মাসে এই অহংকারী জাতি নিজেদের দেশের অন্য জাতিসত্তা সমূহকে খুন জখম করতে কোন দ্বিধা বোধ করছেনা। রাষ্ট্র লেলিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনীকে, পাহাড়ি জাতিকে নিজ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়োগ করছে। সেই একই কাহিনী। স্বাধীনতার আগে আমাদ্রে এই দেশ পাকিস্তানের অধীনে ছিল। পাকিস্তানিরা এদেশের জনগণকে দমিয়ে রাখতে উর্দু ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। পারেনি। অর্থনীতি সামাজিক রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা তৎকালীন পূর্ব বংগকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে। সেটা পাকিস্তানিরা পেরেছে কিনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার জবাব।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা এটা সকলেই জানে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরই এই অঞ্চলে পাহাড়িদের বাঙালীত্তে উর্ত্তীণ করানোর ঘোষণা দেয়া হয়। নিজ জায়গা থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে শুরু হয় সামরিকীকরণ আর সংখ্যালঘু বানানোর উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালীদের এখানে বসতি করানো শুরু হয়। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সব বাঙালীদের রেশন আর সকল সুবিধা প্রদান করে গুচ্ছগ্রামে রাখা হয়। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেকটি গুচ্ছগ্রামে সেনাবাহিনীর পোষ্ট বসানো হয়। যদি অন্যভাবে আমরা দেখি সেনাবাহিনী নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বাঙালী সেটলারদের নিজেদের ক্যাম্পের আশেপাশে বসায়। একধরণের মানবঢাল হিসেবে বাঙালী সেটলারদেরকে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যবহার করছে রাষ্ট্র। গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী পাহাড়ি গ্রামে হামলার ঘটনা শুধুমাত্র সবিতা চাকমার হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য ঘটানো হয়নি। এর পিছনে রয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা এবং রাষ্ট্রের অবহেলা। এখানকার সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি তথাকথিত পাহাড়ি -অপাহাড়ি দ্বন্দকে কাজে লাগাতে এই হামলা চালানো হয়েছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারীতে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নির্বাচন এ ক্ষমতাসীন দল এর প্রার্থীকে হারিয়ে ইউপিড্এ্ফি এর সর্মথিত প্রার্থী চুঞ্চুমনি চাকমা জিতে গেলে খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলতে থাকে ভিতরে ভিতরে। এর আগেও নির্বাচন এর আগে আবু তাহের নামে এক ব্যাক্তিকে পাহাড়িরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে শহরে আতংক সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক শক্তি। কিন্তু প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের কারণে সে অপহরনের নাটক শেষ মেষ শেষ হয় আবু তাহেরকে গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে। আবু তাহের সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছেন ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে পাহাড়ি বাঙালী দাঙ্গা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তাকে ভাড়া করা হয়। সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সেই শক্তি কমলছড়ি আর বেতছড়ি বড়নালা, বেতছড়ি চাকমা খ্রীষ্টান পাড়ার বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা করে তাদের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করলো।

কিন্তু এখন প্রশ্ন — আমরা পাহাড়িরা নিজেদের অস্তিত্ব কিভাবে টিকিয়ে রাখবো নিজের পূর্ব পুরুষদের জায়গায় ? আমাদের কি আর করার কিছুই নেই শুধু ধ্বংশ হতে দেখা ছাড়া?

আর সমতলের আপনারা-যারা বিশ্বাস করেন এই দেশ বাংলাদেশ জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সকলের তারা জাতিগত লড়াইয়ে কিভাবে শরীক হবেন? আপনারা কি এইভাবে নির্লিপ্ত থেকে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই পাহাড়ি জাতিসত্বাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হতে দেবেন , চেয়ে চেয়ে দেখবেন?

সময় এখন আপনার আমার সামনে দাড়িঁয়ে। সিদ্বান্তও আপনার হাতে, আমার হাতে।



Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , , ,

2 replies

  1. Very true story. I do hope liberal, educated and intellectual Bengalees will definitely extend their helping hands.

Trackbacks

  1. কমলছড়িতে ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং অতঃপর: জাতীয়তাবাদী সহিংসতার লিঙ্গীয় স্বরূপ | chtnews.com

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: