সমারী চাকমা
অাজ পাহািড়দের প্রাণের উৎসববৈসাবি। চাকমাদের িবঝু উৎসব। ২০১৪ সাল শুরু হবার পর পরই র্পাবত্য চট্টগ্রামে বিশেষকরে খাগড়াছড়িতে এতো বেশী ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, না ঘটনা বলা ঠিক হবে না-র্দুঘটনাঘটছে এরই মধ্যে কখন জানুয়ারী শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারী আসলো, আবার ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ের্মাচ-রক্ত ঝরা মাস ঢুকলো এখন আবার শেষ হয়ে যাবে যাবে করছে আমি টেরও পাইনি। এইতোআগামী মাসতো এপ্রিল মাস। আমাদের এপ্রিল মাস। উৎসব আনন্দের মাস। বছরের এই একটিমাসের জন্য আমাদের কতই না অপেক্ষা আর মনে মনে প্রোগ্রাম ঠিক করা। কেউ কেউ বিঝুতেস্পেশাল কিছু তৈরী করতে এই র্মাচ মাস থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। যা হোক প্রত্যেকবছর ফাল্গুন মাস শুরু হওয়া মানেই আমাদের জুম্মোদের সকলের মন বিঝু বিঝু, সাংগ্রাইসাংগ্রাই, বৈসু বৈসু করতে থাকে।
সেই আমি জানতেও পারলামনা ফাল্গুন শেষ হয়ে গেছে কবে। এইসেদিন এক গ্রামে গেলাম কাজে। কাজ করছি কথা বলছি, কোন রং ঢং এর কথা না, খুবই কাজেরকথা হঠাৎ করে কানে এলো বিঝু পেক্কু কুহু কুহু করছে, বিঝু বিঝু বলছে। এত চাপেরমধ্যেও কান দুটো নিজের অজান্তে খাড়া হয়ে গেলো। কিন্তু পর মুহুর্তে আবার ভূলেগেলাম। কেউ একজন জানাচ্ছে খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি ভালোনা। এই খবর পেয়ে আবার ভূলেগেলাম যে সামনের মাসের নাম এপ্রিল মাস।
আজ ৭ র্মাচ ২০১৪। পাশের বাড়ীতে বিয়ের উৎসব চলছে তাই সকালথেকে উচ্ছ শব্দে গান বাজছে। হিন্দি বাংলা মাঝে মাঝে ইংরেজী গান বাজছে। আবারকিছুক্ষণ পর পর শুনতে পাচ্ছি চাকমা গানও বাজছে। বিঝুর গান। ভারতের ত্রিপুরারাজ্যের চাকমারা বিঝু গান নামে একটা গান বানিয়েছে। সেই গান। তারপর একে একে সবচাকমা গান। গানগুলো শুনতে লাগলাম আর মনটা ভীষণ খারাপ করে বসে থাকলাম। আর মনে মনেধণ্যবাদ জানালাম যাদের বাড়ীতে বিয়ের উৎসব চলছে তাদেরকে। যে অন্তত এই বিয়ের বাড়ীআমাকে বিঝু খুবই কাছে সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে বিকাল বেলা পর্যন্ত বিঝুকেনিয়েই কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যাবেলায় হুয়াংবোই ও বা লাইব্রেরীতে গেলাম। আজ বই মেলার শেষ দিন। ৮ দিন ধরে বই মেলা চলছে। এবংখুব ভালোই চলছে। ঠিক তখনই সাংবাদিক বন্ধু চিংমে জানালো মন খারাপ করে, “মানিকছড়ি ওজালিয়া পাড়ায় রাস্তায় তিনজন বাঙালী মিলে একটা মারমা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, এখনমানিকছড়ি থানায় বসে একটা আপোষ মীমাংসার চেষ্টা চলছে।”
আমি চিংমে কে বললাম-এক্ষুণি মানা করে দাও, আর মামলা করতেবলো।
রাতে সিএইচটিনিউজ জানালো-মামলা হয়েছে আর হাসপাতালে পাহাড়িমেয়েটিকে পাঠানো হযেছে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু আমিতো জানি খুব ভালো করেজানি ডাক্তারি পরীক্ষার রেজাল্ট কি আসবে। ‘না ধর্ষনের আলামত পাওয়া যায়নি।’ বেশীহলে লিখবে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে। কি আজব দেশে আমরা জন্মেছি আমরা। আচ্ছা এইটাকি সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশতো! এইযে এখানে এই পাহাড়ে প্রতিদিন কোথাও না কোথাওকোন না কোন পাহাড়ি মেয়ে ধষর্নের শিকার হচ্ছে কই কেউ তো কোন কথা বলছেনা। যেখানেঘটনা ঘটছে সেখানেই বিক্ষোভ হচ্ছে মামলা হচ্ছে কিন্তু ওই টুকুই। আর কিবা করা যেতেপারে! দেশের আর সব জায়গা চুপ করে আছে।
এবছর পুরো ফেব্রুয়ারী মাস আমাদের জন্য খাগড়াছড়ি বাসীর জন্য ভয়ংকরছিল। ৩০ বছরের সবিতা চাকমাকে ধরষণের পর গলা টিপে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনার দোষীব্যাক্তিদের শাস্তির দাবী চাইতে গিয়ে, মামলা করতে গিয়ে এজাহারে সুকৌশলে আসামীদেরনাম বাদ দেয়া, মামলায় সুর্নি্দিষ্ট আসামীদের নাম ঢুকানো, তাদেরকে গ্রেফতার করারদাবীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক শক্তি নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতিতে পাহাড়ি গ্রামেএকের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে এই ভাষা আন্দোলনের মাসে। এই ঘটনায় এক পরিবার থেকে মাছেলে দেওরের মেয়ে মারাত্মক আহত হয়ে তিনজনেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীণ। এই ঘটনার রেশখাগড়াছড়ি শহরেও গিয়ে পড়ে। শহরের সকল পাহাড়ি গ্রামে হামলার আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কী কঠিনসময়। আমরা নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা কিভাবে দেবো ?আমাদের হাতে যে কোন বাহিনী নেই।যারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
এমনই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নানা ধরণের চিন্তা ভাবনা আসে যায়।মনে খেলা করে। আচ্ছা ঐ সময় এবং এখনো কি আমরা মনে মনে কারোর অপেক্ষা করে ছিলাম বাআছি যে সরাসরি ঘটনাস্থলে এসে সংহতি জানাবে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। যারা শুধুবিবৃতি মানববন্ধনে বিশ্বাস করেন না! তাদের! হ্যাঁ ছিলামই তো। থাকাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশেবিশেষ করে ঢাকা শহরে এতো মানবাধিকার কর্মী,নেতা, নেত্রী যারা সারাক্ষণ সমতার কথাবলেন, যারা বিশ্বাস করেন এই দেশ শুধু বাঙালীদের না , এই দেশ স্বাধীন করতে গিয়েশুধুমাত্র বাঙালীরা যুদ্ধ করেনি, যারা বিশ্বাস করেন সকল জাতিসত্তার মুক্তি সম্ভবনা হলে বাঙালীদেরও মুক্তি আসবেনা তাদেরতো আমরা, আমাদের কঠিন সময়ে যেসময় মোকাবেলাকরার জন্য সত্যিকারের বন্ধু দরকার হয় সেময়ে পাবার আশা করতেই পারি।কিন্তু– না কেউআসেনি। আমাদের আশা আশাই থেকেছে।
আর একমাসের মধ্যে বিঝু। বৈসাবি। যদি এরই ভিতর কোন র্দুঘটনানা ঘটে তাহলে পাহাড়, পাহাড়ি জুম্মো গ্রাম গুলো উৎসবের আমেজে মেতে উঠবে। এবং আমিনিশ্চিত জানি-এই সময় আমরা অনেক বেশী সমতলের মানুষজনকে দেখতে পাবো। আমার অভিজ্ঞতাবলে দু:খের সময় কাউকে কাছে না পাওয়া যায়না। কিন্তু আনন্দের সময় ঠিকই ওরা নিজেরানিজেরা কাছে চলে আসে বা আসতে চাই, সেই আমরা চাই বা না চাই। উৎসব বলে কথা। পাহাড়িদেরবৈসাবি উৎসবে যেতে হবে তো। কতকিছু খাওয়া দাওয়া নাচ গান হয়ে থাকে। এই সময় না গেলেকি চলে! না হলে গল্প ফেসবুক এ ষ্টাটাস লিখবো কিভাবে!
আমি এবং আমরা সবাই তখন জানতে চাইবো সেসব আনন্দের সময়েরসমতলের বন্ধুদের কাছে – আপনারা কেউ কি ভেবে দেখেছেন আমরা আপনাদের কখন পেতে চাই?আমরা আমাদের বন্ধুদের সুখে দু:খে আন্দোলনেউৎসবে সমানভাবে পেতে চাই। আমাদের পাহাড়িদের, এই পাহাড়ের মানুষদের এমন বন্ধুপ্রয়োজন, যাদেরকে হাত বাড়ালেই কাছে পাওয়া যাবে। যারা বন্ধুর প্রয়োজন বুঝবে। যেপাহািড়দের চোখ দিয়ে পাহাড় দেখবে। শুধু উৎসবের পাহাড় না, দু:খের আর রক্তের পাহাড়ওতাকে কাঁদাবে – মায়া কান্না না, সত্যিকারের কান্না যে কাঁদবে। যে বন্ধুরা বুঝবে-এই পাহাড়ের পাহাড়ি জুম্মো জনগণ বেঁচে থাকলে তাদের অধিকার ফিরে পেলেই তবেতো উৎসবকরা যাবে!
চলুন বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্নের’ মত আমরাও একটাস্বপ্ন দেখি–
র্পাবত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় পাহাড়িদেরগ্রামে বাঙালী সেটলাররা গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়িরা আতংকে গ্রামছেড়ে পালাচ্ছে। গুলতি বিয়ং দিয়ে নিজেদের বাড়ী গ্রাম শিশুদের রক্ষা করার চেষ্টাকরছে। কিন্তু পারছেনা। রক্তাক্ত হচ্ছে আহত হচ্ছে শুধুই পাহাড়িরা। তাদের পাশে তোকেউ নেই। পুলিশ সেনাবাহিনী সদস্যরা বাঙালী হবার কারণে তারাও হামলাকারীদের সাহায্যকরছে। দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। মাঝে মাঝে হুইসেল বাজিয়ে সতর্ক করার চেষ্টায়আছে। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক বলছেন-‘ আমি নিরুপায়, পাহাড়িরা অসহায়’ আর তার নিজের দায়িত্বএড়িয়ে যাচ্ছেন। চারিদিকে কান্না আর কান্না। ঢাকায় পাহাড়ি জুম্মো ছাত্র ছাত্রীরামিছিল করছে, মানববন্ধন করছে আর সেই মিছিলে, মানববন্ধনে কয়েকজন মানবাধিকার নেতানেত্রী সংহতি প্রকাশ করে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাঙালী বন্ধুদের যখন ফোনে জানানোহচ্ছে তখন সে বন্ধুরা হাল ছেড়ে দিয়ে বলছেন-‘ যদি ভগবান থাকে তাহলে তোমাদের বাঁচাতেপারবে। আর কেউ পারবেনা। ভগবান ভগবান করো।’ যখন জুম্মোরা বুঝলো তাদের বাচাঁনোর আরকেউ নেই ঠিক তখন, হ্যাঁ তখন – ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে সত্যিকার অর্থে মানবতা বিশ্বাসীকিছু বাঙালী ছাত্র ছাত্রী এবং ব্যাক্তি নিজেরা নিজেরা সংঘটিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেনএই বার নিজেদের ঘটনাস্থলে গিয়ে র্নিযাতিতদের পক্ষে কাজ করতে হবে। সে যে কেউ হোকহামলাকারীদের রুখে দিতে হবে। যেই ভা্বা সেই কাজ। রাতের ভিতরে যেখানে ঘটনা হচ্ছেসেখানে হাজির হলো পাহাড়িদের হাত শক্তিশালী করতে। যেখানে সেটলার বাঙালীরা হামলা করছেসেখানেই তারা সবার আগে গিয়ে পাহাড়িদের সাথে মিশে হামলাকারীদের রুখে দাড়াচ্ছে। আরসবাই শ্লোগান দিচ্ছে জয়ের, মানবতার।
স্বপ্ন আসলেই মধুর।
আর তা কখনো কখনো সত্যিও হয়।
Categories: প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ
নোটটিতে টুকরো দৃশ্যপট ও ভাষার সাবলীলতায় তুলে ধরা হয়েছে বেশ কিছু বাস্তব সত্য, বিশেষ করে অন্তত তিন দশক ধরে পাহাড়ে চলমান সেনা-সেটেলার পাকিপনা।
কিন্তু একই সঙ্গে এই নোটে বেমালুপ চেপে যা্ওয়া হয়েছে হয়েছে পাহাড়িদের আন্দোলনে বরাবরই জোরালো সমর্থন যোগানো প্রগতিশীল, মুক্তমনা বাঙালি জনগোষ্ঠিকে, নয়ের দশক থেকে যাদের সমর্থন ও কন্ঠস্বর ক্রমেই বাড়ছে। উপরন্তু এতে আজগুবি এক খোয়াবনামায় তৈরি করার চেষ্টা রয়েছে নতুন কল্পলোকের সৃষ্টি। বিষয়টি পাহাড়িদের আন্দোলনের শক্তিগুলোর জন্য তো বটেই, প্রগতিমনা বাঙালি শুভাকাংখিদের জন্যও চরম অপমানজনক।
শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউডিপিএফ নেত্রি সমারী চাকমার এই চাতুরিটুকুর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
ঠোঁটকাটা ব্লগ সত্যিকার অর্থেই ”ঠোঁটকাটা” হয়ে উঠুক। কোনো বিশেষ গোষ্ঠির কলমবাজীর পকেট নয়।
আমরা অধিকাংশ মানুষ গা বাঁচিয়ে চলি। নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষাতে ব্যস্ত বৃহৎতর মানবতাকে ভুলে যায়। ভোঁতা অনুভুতি নিয়ে চলতি ফিরতি লাশের মত জীবন যাপন করতে থাকি। পাহাড়ে সকল বিচারের উর্ধে থাকা সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে লড়াইটা সহজ নয় ভেবে এগিয়ে আসে না অনেকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কর্মী বাহিনী যত ছোট হোক না কেন মনের দৃঢ়তা ও অটলতা নিয়ে যদি সংগ্রাম চালিয়ে যায় অন্যরা এসে যোগ দেবে। একজনের অটুট মনোবল, কর্মক্ষমতা কখনো গোটা জন গোষ্ঠীকে জাগিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আপনার সাথে এই সংগ্রামে আমরা সত্যি আছি।