নাসরিন সিরাজ এ্যানী
বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন-কানুন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নানা রকম প্রস্তাব ও চুক্তি অনুযায়ী নারীকে নানা রকম অধিকার দেয়া আছে। কাগজে কলমে নারীর জন্য আছে নানা রকম সুযোগ সুবিধা। এখন, ফর্মূলা অনুযায়ী নারীর কর্তব্য এই সব তথ্য জানা এবং তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হওয়া। কিন্তু উন্নয়ন কর্মীরা অনেকাংশেই হতাশ কারণ, “নারীরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে কি তারা তো জানেইনা তাদের জন্য কি কি অধিকার দেয়া আছে”। এই সব “আনএওয়্যার”, “আনএডুকেডেট”, “ভালনারেবল”, নারীদের নিয়ে উন্নয়ন সংগঠনসমূহের উত্কন্ঠার শেষ নেই। নারীদের ‘এওয়্যার’, ‘এডুকেটেড’, ‘এমপাওয়ারড’ করার উন্নয়ন তত্পরতারও শেষ নেই। এই ধরনের কর্মকান্ড অনুযায়ী তথ্য হচ্ছে নারীর জন্য শক্তিশালী এক হাতিয়ার। নারীর কাছে তথ্য সরবরাহ, নারীকে সচেতন করার প্রকল্প রয়েছে এন্তার। কিন্তু আদতেই সরবরাহিত তথ্যগুলো নারীর কোন কাজে লাগছে কি না বা নারীর জন্য এই তথ্য গুলো জানার প্রয়োজন আসলেই আছে কি না বা নারী নিজে কোন্ তথ্য জানতে আগ্রহী, নারী নিজেই বা কি জানে বা যে তথ্যগুলো বর্তমান কালে নারীকে দেয়া হচ্ছে সেগুলো কারা দিচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যে কি এই প্রশ্নগুলো নারী ও তথ্য বিষয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমেই আসি ভোটের অধিকারের প্রসঙ্গে। বিংশ শতাব্দির ষাট এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী আন্দোলনের যে জোয়ার তৈরী হয়েছিল তার মাধ্যমে নারীর ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল পশ্চিমা নারীমুক্তি আন্দোলনকারীদের কাছে এক বিরাট সফলতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও ভোটাধিকার সাংবিধানিকভাবে নারী ও পুরুষ ভেদে সমান কিন্তু ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা নারীর জন্য এবং নারীবাদী আন্দোলনকারীদের এবং উন্নয়নকর্মীদের এক জটিল অভিজ্ঞতা। কারণ, এ শুধু সাংবিধানিকভাবে ভোটের অধিকার থাকা-না থাকা কিংবা এ সম্বন্ধে তথ্যগুলো নারীদের জানা-অজানার ওপর নির্ভর করে না। বাংলদেশের কোন কোন গ্রামে নারীদের ভোট কেন্দ্রে আসা বা ভোট দেয়া সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। আবার যদিও বা নারী ভোট কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে কিন্তু কাকে ভোট দেবে না দেবে এই সিদ্ধান্ত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর নয়। স্বামী বা পরিবারের অন্য মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তে নারীরা প্রার্থী পছন্দ করেন। এখন, “আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব” এ সচেতনতাও নারীর জন্য ফলপ্রসূ নয় কেননা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর তেমন কোন অবস্থান নেই। ভোটের সময় নারী প্রার্থী প্রায় থাকেই না। যদিও বা থাকে তিনি নারী স্বার্থ সংরক্ষণের চেয়ে তার দলীয় স্বার্থ রক্ষা করতেই বেশী আগ্রহী বা বাধ্য হন। আর আমাদের রাজনৈতিক ধারার পাল্লা নারী বান্ধবের চেয়ে নারী বিদ্বেষের দিকে বেশী ঝুঁকানো।
এখন, নারীর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৃণমূল থেকে জোয়ার তৈরী করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করণ একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। কিন্তু দেখা গেল বেশ কয়েকজন ইউপি সদস্যদের ধর্ষিত হওয়া, বেশীরভাগ ইউনিয়ন পরিষদে নারী সদস্যদের কাজ করতে না দেয়া, নারী সদস্যদের বিপক্ষে চেয়ারম্যানদের প্রতিশোধপরায়ণ অবস্থান নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে “এক্সপেরিমেন্ট” টি নস্যাত করে দেয়। এবং এর মধ্য দিয়ে গ্রামের কিছু সম্ভাবনাময়, সাহসী ও শক্তিশালী নারীদের পুরুষের রোষানলের বলি দেয়া হয়। এখন অনেকে বলতেই পারেন যে আন্দোলনে ঘাত প্রতিঘাত আসবেই আর তার জন্য কারো কারো জীবন বলি দিতেই হয় কিন্তু আপত্তিটা সেখানেই হয় যখন আমরা দেখি যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইটা বাংলাদেশের নারীদের চেয়ে পশিচমা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া ফর্মূলা, টাকা ও আগ্রহের উপর বেশী নির্ভরশীল ছিল।
নারীর বিয়ে আর বাচ্চা তথ্য প্রদানের আরেকটি বড় বিষয়। কখনও “আপনি জানেন কি সাংবিধানিকভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮?” কিংবা “বাল্যবিবাহ একটি অপরাধ” কখনও “বাল্য বিবাহ মানে কাঁচা বাঁশে ঘূনে ধরা” এভাবে বাল্যবিবাহ রোধে তথ্য দেয়া হচ্ছে। সেই যে উপনিবেশিক আমলে বিদ্যাসাগর এবং আরও অনেকে বাল্যবিবাহ বন্ধের বা বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রকল্প শুরু করেছিলেন তারই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি এটাও বুঝি আমাদের নারীদেরই লড়াই। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা বাল্যবিবাহের চর্চা করে যাচ্ছে বা বাল্যবিবাহের পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে তাদের যুক্তিখন্ডনের জন্য কোন সমাধান আসলে রাষ্ট্র বা সমাজ দিতে পারেনি। অল্প বয়সী মেয়ে ঘরে রাখা মানে বাবা-মায়ের জন্য বিপদ-এতো অমোঘ সত্য। আর মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে পড়ালেখা করানোর ভবিষ্যত কি? “ছেলেরা না হয় উপার্জন করবে কিন্তু মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে করবে কি? আর তাছাড়া পড়াশোনা করা মেয়েদের পরে বিয়ে দিতে অসুবিধা হয়”-এই যুক্তি গুলি এখনও ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক। অনেকে বলতে পারেন যে এখন তো মেয়েরা চাকরী বাকরিতে এগিয়ে এসেছে। গ্রামীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত নারীরা গার্মেন্টসের শ্রমিক-সুপারভাইজার হিসেবে, এনজিওর মাঠকর্মী হিসেবে, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে স্বাস্থ্য কর্মী বা জন্ম নিয়ন্ত্রনের বড়ি বিলি করার কাজ হয়তো পেয়েছেন কিন্তু পুরুষতন্ত্র, সমাজ, রাষ্ট্র নারীর কাছে মা-স্ত্রী, বোন বা গৃহশ্রমিক হিসেবে তাদের নিজ নিজ চাহিদা থেকে একচুলও নড়েনি। বরং তাদের বাড়তি লাভ হয়েছে যে বাইরের কাজগুলো করার জন্য নারীকে দক্ষ করা গেছে। কাজের ধরন ও মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা তো বাদই দিলাম। অর্থাৎ, বিয়ের বয়স বাড়িয়ে, বিয়ে বন্ধ করে শিক্ষা ও চাকরির নতুন জগৎ উন্মোচন করে নারী যা পেয়েছে তার চেয়ে পুরুষেরা, এবং তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাষ্ট্র-সমাজ-আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছে অনেক বেশী। নারীর তুলনায় সস্তা, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান শ্রমিক আর কে হতে পারে?
সীমিত সম্পদ আর ব্যাপক জনসংখ্যার যে সংকট সত্তর এর দশকে আবিষ্কৃত হয় তারও ভার নারীকে পুরোপুরি বহন করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সম্পদ সীমিত হোক আর অফূরন্তই হোক সম্পদের মালিকানা যখন পুরোপুরি পুরুষের হাতে তখন নারীকেই কেন জনসংখ্যার ভার কমানোর জন্য জীবনপাত করতে হবে সেটা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন আছে। বিষয়টি কি পুরুষের সম্পদের উত্তরসূরী কমানোর জন্য সন্তান জন্মানোর যন্ত্রটিকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বন্ধ রাখা? কতক ক্ষেত্রে নারীর যৌন অধিকার, প্রজনন পছন্দ, প্রজননের বাইরে যৌন সুখ, শরীরী স্বাধীনতা এবং সন্তান লালন পালনের সীমানার বাইরের জগৎ দেখার সুযোগ হয়তো হয়েছে কিন্তু সম্পদের মালিকানার মূল প্রশ্ন যদি সমাধান না হয় আর সমাজ যদি সমতার না হয় তাহলে এই অধিকারগুলোর কি অর্থ? সংসার “সুখের” করতে কয়টি সন্তান নেবেন না নেবেন, জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা নিয়ে যত তথ্য নারীকে দেয়া হয়েছে এই তথ্যগুলোর পেছনে কার কি উদ্দেশ্য সেগুলো নারীকে কোনদিনই জানানো হয়নি। যেমন এই তথ্যগুলো ব্যাপকভাবে আমরা জানি না যে কেন পুরুষদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছেনা বা করানো হচ্ছে না? কোন দেশ থেকে কত টাকা দিয়ে বাংলাদেশের নারীদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি কেনা হচ্ছে? সেই টাকা দিয়ে আমাদের দারিদ্র কতটুকু দূর হত? বাংলাদেশের নারীদের শরীরের ওপর জন্মনিয়ন্ত্রণের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার জন্য দায়ী কে ? কে এ থেকে পরিত্রাণ দেবে? নারীর প্রশ্নের শেষ নেই কিন্তু সেই প্রশ্নগুলো উপেক্ষিত বা শুনেও না শোনার ভান করে আছে এই শোষণবাদী পুরুষতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং বিশ্বব্যবস্থা।
আসলে, নারী জাগরণের বিষয় বর্তমানকালে অনেকখানিই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশ মাত্র। অনেকখানি আবার সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকে মুখোশ পরানোও। এ প্রসঙ্গে সারা সি হোয়াইট এর Arguing with the crocodile বইয়ের উল্লেখ করা যায়। বইটির প্রকাশনা পর্যালোচনা পর্বে বাংলাদেশের জ্ঞানকান্ডে এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে জেন্ডার বিষয়টি কিভাবে আসলো এবং তার গতিপ্রকৃতি কি সে বিষয়ে তিনি চমত্কার আলোচনা করেছেন। তিনি দেখান যে বাংলাদেশে জেন্ডার নিয়ে যাবতীয় তর্ক বিতর্কের আদি পূর্ব পুরুষ হল সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থা বিষয়ক আলোচনা। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ক্যাথরিন মেয়োর Mother India এবং ঐ বইটির সমালোচনা করে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত ফ্রিডা হাউসউইর্থ দাসের Purdah: The status of Indian Women নিয়ে হোয়াইটের আলোচনায় বোঝা যায় যে, ভারতীয় নারী বা নারীর জগতকে বোঝার আগ্রহ নারীর নিজের চাইতে অন্যান্যদের ছিল বেশী। এদের মধ্যে কারও উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সমাজে “নারীর অবস্থা” কে ব্যবহার করে ব্রিটিশদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং উপনিবেশ শাসনকে বৈধ ও যুক্তিযুক্ত করা। Mother India বা এই ধরনের আলোচনায় সতীদাহের মত বর্বর ঘটনা কিংবা নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিা দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা কিংবা জনজীবনে টেক্কা না দিয়ে অবরোধবাসিনী হয়ে থাকা হচ্ছে ভারতীয় নারীর আসল চিত্র। অন্য পক্ষ (যেমন দাস) বলে যে, আসলে ভারতীয় নারীর চরিত্রকে নির্মাণ করা হয়েছে পশ্চিমা নারীর সাথে তুলনা করে এবং তাদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা বিশ্লেষিত হয়েছে পশ্চিমা মূল্যবোধের দ্বারা নির্দেশিত পথে। যার ফলে ভারতীয় নারী চিত্রিত হয়েছে প্রতিবাদহীন, পরনির্ভরশীল, নাজুক, দূর্বল, নির্যাতিত হিসেবে। যে নারীর জন্য শুধু করুনার উদ্রেক হয় আর পশ্চিমাদের ভারতে নাক গলানোকে মনে হয় মহিমান্বিত রক্ষাকর্তা। অথচ দাসের বইতেই আমরা উল্লেখ পাই যে, ১৯৩০ সালে বোম্বেতে প্রায় ৫ হাজার আপাত: অসহায়, দূর্বল আর ভীরু ভারতীয় নারী মিছিল করেছিল আর তাদের প্রতিবাদ ছিল নির্যাতনকারী ভারতীয় কোন পুরুষের বিরুদ্ধে নয় বরং উপনিবেশবাদের শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
উন্নয়নের ছদ্মবেশে পশ্চিমের নাক গলানো আর নারীকে অসহায় প্রমাণ করার এই ঐতিহাসিক প্রকল্প এখনও পুরোমাত্রায় চালু রয়েছে। শুধু বাংলাদেশই না আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা উন্নয়নের এই ধারার শিকার এবং বিশেষ করে নারীরা এর মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে ‘ওমেন ইস্যু’ বাংলাদেশ সরকার ও এনজিওদের জন্য এক বিরাট ‘রিসোর্স’। নারীদের জন্য কাজ করার জন্য ‘ফান্ডের’ সহজলভ্যতা বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, নারী আন্দোলনের আদর্শ, লক্ষ্য, সংগঠক ও সংগঠন রূপান্তরে একটা ব্যপক প্রভাব রেখেছে। আর তাই নারীর জন্য সমতার লড়াই, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হয়েছে আরও কঠিন।
প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ২০০৪
http://www.meghbarta.info
লেখাটি “মেঘবার্তা বাছাই ১৯৯৯-২০০৮” বই থেকে সংগৃহিত
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply