শামীমা বিনতে রহমান, গেস্ট ব্লগার
ন্যুয়র্কে যখন ২০০৭ সালে বেড়াতে যাই, তখন যে জায়গাটা আমাকে সবচে আকর্ষন করসিল, উদ্দিপনাময় আর স্বস্থির জায়গা মনে হৈসিল, সেইটা ন্যুয়র্ক ইউনিভার্সিটির একদম পাশের একটা জায়গা, গ্রীনউইচ ভিলেইজ। ওয়াশিং টন স্কয়ারকে মাঝে রেখে চলে যাওয়া সোজা রাস্তার দুই পাশে পাব, লেসবিয়ান, গে স্পেশালাইজড পাব, ট্যাটু শপ, থিয়টার হল, বুক শপসহ গোটা ফুটপাত চারুশিল্পি, ভাস্কর শিল্পি, মিউজিশিয়ান, কবি, লেখক, সাংবাদিক, আরবান বোহেমিয়ান, স্টুডেন্ট, আ্যক্টিভিস্ট সবার হ্যাং আউট, ইন প্লেইস। মানে ওই জায়গাটা একটা ভাবনা-চিন্তার মুক্তাঞ্চল। এইটা ৬০’র দশকের আ্যামেরিকার কাউন্টার কালচার মুভমেন্টের ঔম্ব প্লেইস, আ্যালেন গিনসবার্গ, জ্যাক কেরুয়াকদের বিট জেনারেশনের হাই বিট প্লেইস। ওই জায়গার সাথে স্ট্রাকচারালি বা আ্যারেঞ্জমেন্টের দিক থেকে আমাদের ছবির হাটের কোন মিল নাই, কিন্তু আমার কাছে মনে হৈসে, মিলটা আসলে স্পিরিটের, নোশনের। ভারতে, ভারতীয় যাদের সাথে দেশ, শহর নিয়া কথা বলি বা আমার এইখানে অন্যান্য দেশের: নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিজি, ঘানা, নাইজেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, ত্রিনিদাদ-টোবাগোর ছেলে-মেয়েদের সাথে যখন এক্সচেইঞ্জ করি, তখন আমি সব সাধারণ ইনফরমেশনের সাথে ছবির হাটের গল্প করি। আমার কাছে ছবির হাট ঢাকার এক টুকরা মুক্ত জমিন, যেইখানে সংসারি, বিবাগি সংসারি, রক, আল্ট্রা-অল্টারেনেটিভ রকার, কবি, ফটোগ্রাফার, ফিল্ম মেকার, আ্যাড মেকার, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, ভাবুক, প্রান্তিক ভাবনাঅলা, সাংবাদিক, বামপন্থী, ক্যাপিটালিস্ট-কর্পোরেটের চাপে চাপিষ্ট হতে হতে দম নিতে চাওনেঅলা-সবাই এসে জমা হয়, জমা হৈতে পারে।
এই ছবির হাট ভেঙ্গে দেয়ার খবর যখন ফেইসবুকেই প্রথম দেখলাম, মাথায় বন বন করতে থাকলো “সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে”। একে একে সাটারের শব্দের মত মগজে ভিজ্যুয়াল জমা হতে শুরু করলো: গিটারের টান, হা হা হিহি মুক্ত হাসি, আড্ডার শব্দ, ইমনের চা, খোলা গলায় গান, কনসার্ট, কারো বসে এক মনে ছবি আঁকা, কারো একলা হাঁটা, চুল ঝাঁকানো, সহজ তাকানো, প্রতিবাদি জমায়েত, সহজ হাসি, মুক্ত গ্যালারি, একক প্রদর্শনী, যৌথ প্রদর্শনী, তর্ক-প্রতিতর্ক, নতুন সৃষ্টির নানা উন্মেষ; মানে ভিজ্যুয়ালে শুধু মুখ বা বস্তু না সৃষ্টিশীলতার টান টান ফিলিংটাও সঞ্চারিত হতে থাকলো।
ছবির হাটে ঢোকার মুখে আমার চোখ অবধারিত হবে প্রথমে ডান দিকে চলে যায়-হাটুরেদের আড্ডায়। ওইখানে স্বাধীন, মাসুদ, কনক, নিলয়সহ একঝাঁক হাটুরেদের আড্ডায়। চোখ স্বাভাবিকতায় একটু ওপরে উঠে এরপর ফ্রেমে বাঁধাই কোন পেইন্টিঙে আটকে যায়, তারপর ঘুরে ঘুরে মুক্ত গ্যালারির ছবি ঘুরে ঘুরে দেখি, এরমধ্যেই হয়তো কফিল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। আমি একা অথবা আমি-অন্য এবং আমি-এ্যানি ভিতরে ঢুকে দাঁড়ায় বা বসে ইমনের দোকানে চা খাই, এরমধ্যেই দেখা হয়ে যায় চেনাদের সাথে। নতুন গল্প, নতুন ছবি, নতুন গান, নতুন ইস্যুর তর্ক। ঢাকায় তো আড্ডা দেয়ার জায়গারই সমস্যা। গ্যারেজে, গলির মুখে, চায়ের দোকানে বা নতুন কনস্ট্রাকশন শুরু হওয়া বিল্ডিংয়ের ফাঁকা ঘরে, আসলেও কত আড্ডা দেয়া যায়! আর মেয়েদের তো আড্ডা দেয়ার জায়গাই নাই শহরে। অ্যাজ ইফ, মেয়েদের যেন আড্ডার দরকার নাই। এই ছবির হাটে মেয়েরা একটু ঠিকঠাক হাত পা মেলে হাসতে পারে, আমার তো এরকমই লাগে, এর জন্য যে ছাত্রলীগ নামধারি পোলাপাইনদের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নাই এমন না, সেইটা মোকাবেলা করার ধরনেই ওভারকাম করতে হয়।
২০০৮ সালে এয়ারপোর্টের সামনের লালনের নির্মিত হতে থাকা ভাস্কর্য যখন ইসলামী ঐক্য জোটের নেতা নুর হোসেন নূরানীর নেতৃত্বে ভাঙ্গা হয়, “মুসলমানের দেশে মুর্তি থাকতে পারবে না” এই জঙ্গী ইসলামী দাবিতে, তখন কিন্তু সরকার, তার দেশের সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়াইতে পারে নাই। ছবির হাট থেকেই বাংলা সংস্কৃতি আন্দোলন নামে প্রতিবাদের আওয়াজ তোলা হয়, প্রতিবাদ শুরু হয়। শাহবাগে গত বছর যে গণ জাগরণ হয় যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে, সেইখানেও শুরুকারিদের মধ্যে ছিল এই ছবির হাটের নিয়মিত আড্ডাঅলারা। গান, আড্ডা, চায়ের নিয়মিতার মধ্যেই গঠন হয় জাহানারা ইমাম স্কোয়াড। আসলে, এরকম অসংখ্য ছোট ছোট আ্যক্টিভিস্ট গ্রুপের শুরু এইখান থেকে।
খোলা চোখে বল্লে, ছবির হাট আর তার আ্যাক্টিভিজম, আর তার খোলা হাওয়া খুবই অবধারিত ঘটনা। সোসাইটি আর কালচার ডিসকোর্স থেকেও এটা অবধারিত। ন্যুয়র্কে যে সময়টা কাউন্টার কালচার আন্দোলন গড়ে ওঠে গ্রীনউইচ ভিলেইজের আড্ডায়, ওইসময় আ্যামেরিকা ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, আর যেই যুদ্ধে আ্যামেরিকানরা মার খাচ্ছিল ভিয়েতনামিজদের কাছে। আ্যামেরিকা তখন এখনকার মতো ক্যাপিটালিস্ট ছিল না, একলা রাজাও ছিল না। অর্থনৈতিক, সামাজিক কন্ডিশনগুলাও ছিল কাউন্টার কালচার তৈরির মতো, যেকারণে ২০০১ এর পর ইরাক যুদ্ধে আ্যামেরিকার সেই কাউন্টার কালচারকে অন্য কোন ফরমেটে ফেরত পাওয়া যায় নাই, কিন্তু তার রিপার্কেশনটা ঘটছে অন্যভাবে, অনলাইনে, টেকনোলজিতে। আমরা উইকিলিকস পাই কাউন্টার কারচারের অন্য অবতারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক যেই বাস্তবতা সেইখানে কোন খোলা হাওয়া নাই। এই বদ্ধ ঘরের বানতো ভাঙবেই। এইখানে ছবির হাট আর তার আ্যক্টিভিজম গড়ে ওঠা, বিস্তৃত হওয়া, ইনস্পিরেশন হিসাবে কাজ করা খুবি অবভিয়াস বিষয়। কিন্তু এই ইনইভিয়েট্যাবল বিষয়গুলা গড়ে উঠতে ব্যাপক ঝাক্কি লাগে, আমাদের সেক্যুলার তকমা দেয়া প্রতিক্রিয়াশীল এবং সরাসরি প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা সরকার চলে বলেই। তাই, ছবির হাটের মতো এরকম খোলা হাওয়া তৈরি করা এবং টিকায়া রাখাটা যেমন অনেক ঝাক্কি আর সচেতনতার লড়াই, এর ভাঙ্গনটাও বেদনারই। বেদনার না বলে বিরক্তিকরই বলবো। কারণ, ছবির হাটের ভাংচুর শেষ পর্যন্ত কেবল একটা সরকারি ইভেন্ট হিসাবেই রেকর্ডেড থাকবে, কোনভাবেই ছবির হাটের স্পিরিট এবং ইন্সপিরেশনকে ভাংতে পারবে না।
একদম অযথাই।
ঠিক পরেরদিনই ফেইসবুকে দেখি একটা পেইন্টিং ঘন ঘন নিউজ ফিডে আসতে শুরু করলো। পেইন্টিংটি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এঁকেছেন। ১৯৯৪ সালে। তখন তিনি বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। কী হাসির একটা ব্যাপার! আমি হাসি আটকায়া রাখতে পারি না। সরকারের ম্যাজিস্ট্রেট ছবির হাট ভাংচুর করার পর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আঁকা ছবি ভার্চুয়াল মিডিয়ার দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়াইতে থাকলো। পুরা একটা ব্রেকিং নিউজ। প্রধানমন্ত্রী যে চারুশিল্পী, আয়হায় জানিই না! এত বছর দেশ চালানোর পরও আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিভা টেরই পাইলাম না! শিট ম্যান!! প্রধানমন্ত্রীকে বিনিত অনুরোধ জানাচ্ছি, ছবির হাটের জায়গায় অচিরেই একটি একক চিত্র প্রদর্শনী করুন। তখন আমরা সেই গানটা গাইবো, ছবির হাটে যেরকম গলার সাথে গলা মিলায়ে আমরা গাই সেইভাবে, “আজব দেশের ধন্য রাজা/ দেশজোড়া তার নাম/ বসলে বলেন হাটরে তোরা/ চললে বলেন থাম/ থাম থাম থাম/ . . .এ্রই না বলে স্বপ্নে রাজা/ দেখেন সোনার ঘোড়া/ প্রজায় দেখে রাজার মুকুট/ কাগজ দিয়ে গড়া” (ছড়া গান/ শামসুর রাহমান)
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ, সংস্কৃতি-রাজনীতি
Leave a Reply