নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, অত:পর একটি মামলা

দীঘিনালায় বাবুছড়া গ্রামে জোরপুর্বক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জায়গা দখল করে বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপনের কারণে ২১ টি বৌদ্ধ পরিবার ঘর-বাড়ি হারিয়ে এখন একটি স্কুলে এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে । কখনো আর্মি, কখনো বিজিবি, কখনো সেটলারদের দ্বারা নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকাই যেন পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাগ্যলিখন ।

দীঘিনালায় বাবুছড়া গ্রামে জোরপুর্বক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জায়গা দখল করে বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপনের কারণে ২১ টি বৌদ্ধ পরিবার ঘর-বাড়ি হারিয়ে এখন একটি স্কুলে এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে । কখনো আর্মি, কখনো বিজিবি, কখনো সেটলারদের দ্বারা নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকাই যেন পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাগ্যলিখন ।

বাবুই চাকমা

গত এক মাস ধরেই দিঘীনালায় বাবুছড়ার যতন মোহন কার্বারী পাড়ার বিজিবি ৫১ ব্যাটেলিয়ন ক্যাম্প বসানো নিয়ে এলাকার পাহাড়িদের মধ্যে উত্তেজনা আর আতংক বিরাজ করছে। যতন মোহন কার্বারী পাড়ার পাহাড়ি অধিবাসীদের নিজ গ্রাম বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে তাদের জায়গা জমির উপর এই ব্যাটেলিয়ন বসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০০৫ সাল থেকে সরকার এইখানে বিজিবি ক্যাম্প বসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে পাহাড়ি গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করে দিয়ে। এবং স্বাভাবিক ভাবে এই গ্রামবাসীরা এর প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এরই ভিতর এই এলাকার কেউ কেউ নিজের বাস্তু ভিটা রক্ষা করতে হাইকোর্টে রীট আবেদন করেছেন। এবং কোর্ট এই রীটের প্রেক্ষীতে স্থিতি অবস্থার আদেশও জারী করেছেন। অন্যান্য গ্রামের মতন এই গ্রামেও স্কুল আছে, প্রার্থনার জন্য মন্দির আছে, আছে ঘরবাড়ি জায়গা জমি, মাঠ।

বেশকিছুদিন চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ করে ১০/০৪/২০১৪ ইং তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়-এর এল এ শাখা থেকে নোটিশ প্রদান করা হয় সেই গ্রামের ভূমি মালিকদের। ভূমি মালিকরা এসে যেন ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে যায়। কিন্তু গ্রামবাসীরা সে নোটিশ প্রত্যাখান করে। এরই ভিতর রাতের অন্ধকারে বিজিবি সদস্যরা গিয়ে সেই গ্রাম লাল পতাকা এবং কাটা তারের বেড়া দিয়ে পুরো এলাকা বেদখল করে নেয় আর গ্রামবাসীদের তাদের বাস্তু ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে। এর প্রতিবাদ করতে গেলে বিজিবি সদস্যরা গত ১০ জুন তারিখে বিকেলে প্রতিবাদরত পাহাড়ি নারীদের উপর হামলা করে। যার ফলে ২০ জনেরও অধিক পাহাড়ি নারী আহত হয়, মারাত্মক আহত অবস্থায় ৪ পাহাড়ি নারী খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ভর্তি হয়। ঘটনার একদিন পর বিজিবির পক্ষ থেকে গ্রামবাসী ও আহত নারীদের নাম অর্ন্তভুক্ত করে ১১১জনের নাম দিয়ে আরও অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জন উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ বিজিবি সদস্যদের উপর গ্রাম বাসীরা, মানে পাহাড়ি নারীরা ভোতা ও ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করেছে। এখন দেখা যাক বাস্তবে কি ঘটেছে??

এই মামলার এজাহার পড়ে দেখা যায়- এই মামলায় যতন মোহন কার্বারী পাড়ার সবাইকে তো আসামী করা হয়েছে এমনকি বাবুছড়া এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি কার্বারী, হেডম্যান, চেয়ারম্যান এমনকি আইনজীবিকেও আসামী করা হয়েছে। যদিও আসামী হিসেবে অর্ন্তভুক্ত আইনজীবি বাবুছড়ায় থাকেন না, পেশাগত কাজের জন্য তিনি খাগড়াছড়ি থাকেন। শুধু তাই নয় কয়েকজন মৃত ব্যাক্তি এজাহার ভুক্ত আসামী হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। এবং এই মামলার অর্ধেক আসামী হচ্ছেন পাহাড়ি নারী। যা হোক। ১৩ তারিখে জানা গেল খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসারত ৪ পাহাড়ি নারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জাির হয়েছে। এবং পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে এই আহতদের তাদের হেফাজতে নিয়েছে আসামী হিসেবে। এখন শুধু অপেক্ষা কবে হাসপাতাল-এর ছাড়পত্র।

১৬ তারিখের দিকে জানা গেল আজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহতদের ছাড়পত্র দিবে। তাই সবার অপেক্ষা কোর্টের বারান্দায় কখন তাদেরকে পুলিশ কোর্টে বিচারকের সামনে হাজির করে। বিকেল সাড়ে ৪ টা দিকে তাদেরকে কোর্টে আনা হয়েছে জেনে তাড়াহুড়ো করে কোর্টে চলে এলাম। দেখি খাগড়াছড়ি কোর্ট বারান্দায় ৪ পাহাড়ি নারীকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে ঘিরে আছে বেশ কয়েকজন নারী এবং পুরুষ পুলিশ। এই ৪ জন নারীর মধ্যে একজনের বয়স মাত্র ১৭ বছরের কাছাকাছি। সবে মাত্র এসএসসি পাস করেছে। কলেজে ভর্তি হতে হবে সে চিন্তায় ব্যস্ত। আর অন্য দুই নারীর বয়স ৫৫ এর কাছাকাছি । শীর্ণ দীর্ণ মধ্য বয়সী নারী। আর একজনের বয়স ৪৫ এর কাছাকাছি। অনুমতি নিযে আমি কাছে গেলাম ভাবছিলাম কিভাবে কথা শুরু করি। কেমন আছেন দিয়েই শুরু করলাম। এই ৪ পাহাড়ি নারীর নাম মায়ারানী চাকমা, ফুলরানী চাকমা, গোপা চাকমা আর কিশোরীটির নাম অপ্সরী চাকমা। এখান থেকে গোপা চাকমা এবং অপ্সরী চাকমা মা মেয়ে। গোপা চাকমার একটা হাত ভেংগে গেছে তাই সাদা প্লাষ্টার দিয়ে মুড়ানো আর গলার সাথে ঝুলানো। বাকী ৩ জনের মাথায় আঘাতের কারনে ফেটে গেছে এবং প্রত্যেকের মাথায় সেলাই পড়েছে। এখনো সেই সেলাই কাটা হয়ন্।ি মায়ারানী চাকমা আমাকে ডেকে কাছে নিয়ে গিয়ে দেখালো তার সারা শরীর কালশীটে দাগ। এক সপ্তাহ পরেও সে দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোথায় নেই সেই দাগ- হাতে, বাহুতে, কোমড়ে, পিঠে। সবখানে কালশিটে দাগ (আমরা বলি মরা রক্তের দাগ) জানান দিচ্ছে তাকে কোন এক জিনিস দিয়ে বেদম পেটানো হয়েছে।

আমি তার হাত ধরে জানতে চাইলাম – এগুলো কিসের দাগ? “বিজিবির সদস্যরা তাদের বন্দুকের বাট দিয়ে এভাবে মেরেছে আমাকে।” “জানো আমাকে বন্দুক দিয়ে মারতে মারতে তাদের বন্দুকের বাট ভেঙ্গে গেছে। আমি সেই বিজিবির সদস্যকে চিনি। তারা আমাদের উঠোনে তাদের জিনিষপত্র প্রতিদিন রেখে আসতো। তাই চিনি। সেই চেনা লোকটি আমাকে এভাবে মেরেছে। আচ্ছা আজকে কি আমাদের জেলে যেতে হবে? ওরা আমাদের জায়গা জমি ঘর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো , প্রতিবাদ করতে গেলাম , তারা আমাদের মেরে হাসপাতাল পাঠিয়ে দিলো। আবার আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিলো। এই কেমন নিয়ম? মাথা ফেটে এতো রক্ত গেছে এতদিন হাসপাতালে ছিলাম এত দুর্বল , আমাদের কি জামিন হবেনা? ” তার এই একরাশ প্রশ্নে আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। শুধু বললাম- আপনাদের আইনজীবিরা এসেছে। ওরা তো বলেছে জামিন হবে। চিন্তা করেন না। একটু পরে ম্যাজিষ্ট্রেট আসবেন। দেখা যাক কি হয়- বলে আমি চলে এলাম। কারণ ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে আসামী হাজির করানোর সময় এসে গেছে।

বিকেল ৫ টার দিকে ম্যাজিষ্ট্রেট এলেন। শারীরিক ভাবে গুরুতর আহত আর মানসিক ভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ৪ পাহাড়ি নারীকে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে হাজির করানো হলো। বিচারকের অনুমতি ছাড়াই ৪ নারী মাটিতে বসে পড়লেন(যদি বিকেলের দিকে কোর্ট বসে তাহলে প্রায় সময় ম্যাজিষ্ট্রেটরা বাইরে বসে এজলাস বানিয়ে বিচার কার্যালয় সমাধা করে থাকেন) কারন দাড়িয়ে থাকার মত তাদের শরীরে কোন শক্তি আর অবশিষ্ট ছিলনা । এই বিকেলেও কোর্টে অনেক লোক , আমরাও দেখতে এসেছি আজ আসামীরা সঠিক বিচার পাই কিনা। আমরা বিশ্বাস করতে চাই বিচারকরা স্বাধীন। আর আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। আসামীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বিচারকও আর কিছু বললেননা। এই অভিযুক্ত ৪ নারীর পক্ষে জামিন প্রার্থনা করলেন ৪ আইনজীবি।

ফৌজদারী কার্যবিধি ৪৯৭ ধারার কথা উল্লেখ করে আইনজীবিরা ৪ নারীর জামিন প্রার্থনা করলেন। সংগে ৪ নারীর মেডিকেল রির্পোট সহ সবকিছু দাখিল করা হলো। সব কিছু মিলিয়ে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবিদের দৃঢ় বিশ্বাস জামিন হবে। কেননা ফৌজদারী কার্যবিধিতে ৪৯৭ ধারা আছে এই অবস্থায় অভিযুক্তরা যাতে ন্যায় বিচার পেতে পারে। এখন দেখা যাক এই ধারায় কি আছে -“ জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যখন জামিন মঞ্জুর করা যাইবে (When bail may be taken in case of non-bailable offence )”–জামিন অযোগ্য অপরাধে কোন ব্যাক্তি অভিযুক্ত হইয়া গ্রেফতার হইলে বা আটক থাকিলে বা আদালতে হাজির হইলে বা তাহাকে হাজির করা হইলে, তাহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যাইতে পারে- তবে শর্ত থাকে যে, এইরুপ অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি ১৬ বৎসরের কম বয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত বা অক্ষম হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দিবার নির্দেশ দিতে পারিবেন।”

আসামীর পক্ষের আইনজীবিদের যুক্তি হচ্ছে- এই অভিযুক্তরা সকলেই নারী, মারাত্মক আহত, বয়স্ক, কম বয়স্ক। তাই তারা জামিন পেতে হকদার। তাছাড়া এফআই আর অনুসারে যদি দেখা হয় তাহলে পাহাড়ি নারীরা যদি আক্রমণ করে থাকেন তাহলেতো আহত হবার কথা বিজিবির সদস্যদের। মাথা ফেটে যাবার কথা তাদের। কিন্তু এখানেতো উল্টো ঘটনা।

দীর্ঘ শুনানী করার পর বিচারক রাষ্ট্র পক্ষের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুনলেন। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি বিচারকের বক্তব্য। কিছুক্ষন পর জানা গেলো গুরুতর আহত গোপা চাকমা ছাড়া বাকীদের জামিন হ্য়নি। গোপা চাকমার হাত অপারেশন করতে হবে এই বিবেচনায় এনে বিচারক শুধু তাকে জামিন দেন। বিচারক বাকী ২জনকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। আর যেহেতু অপসরি চাকমা এখনো আইনমত সাবালক নয় সেহেতু তাকে সেফ কাষ্টডিতে পাঠিয়ে দিলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে আইনজীবিরা প্রার্থণা করলেন যেহেতু অভিযুক্তরা অসুস্থ আহত, হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার আদেশ দিতে। না- আমাদের বিচারকের কোন কিছুতেই মন গললোনা।

আজ ২৭ তারিখ। ১০ দিন ধরে আহত নারীরা জেলে। আইনজীবিদের কাছে খবর নিয়ে জেনেছি এরই ভিতর আরও দুবার জামিন প্রার্থনা করা হয়েছে এবং যথারীতি জামিন আবেদন নাকচ। গত দুদিন আগে খবর এলো অপসরি চাকমাকে চট্টগ্রাম ফতেয়াবাদে অবস্থিত সেফ কাষ্টডি হোমে পাঠানো হয়েছে।

এরই ভিতর জেল গিয়ে দেখে এলাম কেমন আছেন আমাদের আহত নারীরা। না ভালো নেই। ভালো থাকার কথা না। মাথায় ইনজুরি হবার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। হাসপাতালে ঠিকমতো সেবা ছিলনা। যেসময়টা বাড়ীতে বসে বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন সেসময়টা তাদের থাকতে হচ্ছে আলো বাতাস বিহীন জেলে। ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার নেই, পানি নেই। ঔষধ খাবার আগে যে খাদ্য খেতে হবে ডাক্তার প্রেসক্রিপসনে লিখে দিয়েছেন। সেই সেবা টুকু না মিললে কিভাবে ভালো থাকবেন আহতরা। তাই জেল খানায় তাদের অবস্থা এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে বসে বসে হাটা। শরীর এমন দুর্বল যে স্বাভাবিক ভাবে হেটে চলা ফেরা করা তাদের জন্য ভীষন কষ্টকর। আর দিন গুনা জামিন কবে হবে?  আর বাইরে যারা আছেন তারা কেমন আছেন? খবরে জেনেছি শরনার্থী হয়ে কোনমতে বেঁেচ আছেন। আছেন ভয়ে কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়।

 

 



Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , ,

1 reply

  1. The Chittagong Hill Tracts Accord (clause 26b) states, “Notwithstanding anything contained in any other law for the time being in force, no land, hill or forest under the controlled and within the jurisdiction of the Council shall be acquired or transferred by the Government without consultation with or the consent of the Council”.

    Is the above mentioned procedure followed by DC Masud Kaim when ordering acquisition of this land?

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: