
তাজরিন ও তুবা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক দেলোয়ারকে নিয়ে এই ঈদে শ্রমিকদের প্রতিবাদী পোস্টার। ছবি: সুস্মিতা পৃথা
নাসরিন সিরাজ এ্যানী
আমার বাবা-মা সন্তানদের সাথে রোজার ঈদ পালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ঢাকা আসা। রওনা দেয়ার আগে খাগড়াছড়িতে আমার মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় বেলায় “ঈদ মুবারক” বলাটা আমার নিজের কানেই বেখাপ্পা ঠেকছিল। তাদের সংসার চলে মূলত নির্মাণ শ্রমিক আর দিনমজুরের কাজ করে। এখন বর্ষাকালের কারণে তাদের কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের এই “সাময়িক” বেকারত্বের আরেকটি কারণ হল জুলাই মাস। এ সময় নাকি নতুন বাজেট বরাদ্দ হওয়া ও নতুন কাজের অর্ডার রিলিজ হওয়ায় বিলম্ব হয়। অতএব অনাহারে অর্ধাহারে তারা অপক্ষো করছে কবে এই রোজা শেষ হবে, কবে সরকারি অফিসগুলো আবার পূর্ণ সচলতা পাবে। আসলে তাদের এরকমই সারা বছর চলে। এই রোজগার থাকে তো এই থাকে না। আমার বর্গের মুসলিমদের মত তাদের কাছে ঈদ মানে নতুন জামা কেনা আর বিপুল রান্নার আয়োজন নয়। “গরীবের ঈদ নেই” এ তো আমাদের সকলেরই জানা। এটাও জানা “বড়লোকদের” ঈদ আছে। আসলেই ঈদ আছে কি? কোথায় আছে?
ঢাকায় আসার জন্য এবার দিনের বাস ধরলাম কারণ ঈদের আগে আগে মহাসড়কগুলোতে ডাকাতি বেড়ে গেছে বলে আমি লক্ষ্য করেছিলাম। “চোর ডাকাতদেরও তো ঈদ আছে” বলে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রবোধ দিই রোজার মাসে আর রাষ্ট্রের কাছেও আমরা এর সুষ্ঠু প্রতিকার আশা করি না। অত্রএব “নিজের বেডরুম নিজেই রক্ষা করুন” প্রধানমণ্ত্রীর এই উপদেশ শীরোধার্য করি। প্রায় একবছর ধরে প্রায় প্রতিমাসে খাগড়াছড়ি-ঢাকা যাতায়াতের জন্য রাতের বাস ভ্রমন বাছাই করলেও এবার অন্যথা করলাম। তাছাড়া যদিও প্রায় বছর ১৬ বছর ঢাকায় সেটেল্ড আমি কিন্তু বহুদিন পর ঢাকায় এলে নতুন করে ঢাকাকে দেখা হয়। তাই ভাবলাম দিনের আলোর সুযোগটা নেয়া যাক, “নতুন” করেই না হয় “পুরোনো” কে দেখা যাক, আবিষ্কার করা যাক ঢাকার ঈদকে।
দেখলাম কাঁচপুর ব্রীজ থেকেই ঢাকা মেগাসিটির অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে। লক্ষণ: রাস্তায় অজস্র মানুষের ঢল আর শীতের পুরু কুয়াশার মত ধুলা। ঢাকা চেনার আরও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ আকাশ ঢাকা বিক্ষিপ্ত বিলবোর্ড যেখানে শোভা পাচ্ছে ফ্লাই এ্যাশ মুক্ত সিমেন্ট, জান মালের নিরাপত্তা, অর্থ সাশ্রয়, পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যজ্জ্বল-হাসিখুশি জীবন, সবুজে ঢাকা আবাসন আর মানুষের সাথে মানুষের “যত খুশী” আলাপের বিজ্ঞাপন। এই সব বিলবোর্ডের আধিপত্যে নীচে চোখ নামানোই আমার মুশকিল হচ্ছিলো, অসচেতনভাবেই। দেখতে দেখতে সায়দাবাদ বাস ডিপোতে চলে আসলাম বিকাল সাড়ে পাঁচটায়, কোন ট্রাফিক জ্যাম লক্ষ্য করলাম না মহাসড়কে, এমনকি যাত্রবাড়িতেও না। ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগলো সাড়ে সাত ঘন্টা, যেখানে দু’সপ্তাহ আগেও খবর পেয়েছি যে ঢাকা থেকে-খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে বারো ঘন্টা লাগছে।
ঢাকায় ঢুকলাম আর ঢাকার পীড়াদায়ক ট্রাফিক জ্যাম এর কথা বলবোনা তা হয় না। কারণ ট্রাফিক জ্যামটাও ঢাকা মেগাসিটির আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আমার এই পীড়া শুরু হল এই ভাবে: দিনের বেলা ঢাকা মেগাসিটিতে লং রুটের বাস বা কোচ ঢোকা নিষেধ তাই যাদের গন্তব্য গাবতলী তাদের ছোট বাসের ফ্রি সার্ভিস পাওয়ার কথা। ফলে সায়েদাবাদ পৌছেঁই বাসের সুপারভাইজারের মিথ্যা দাবড়ানি খেলাম: “নামেন নামেন। আপনাদের জন্য ছোট বাস দাঁড়ায়া আছে”। কোচ থেকে ব্যাগ বস্তা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে দেখি আমরা “মেরামত চলছে” এরকম একটা রাস্তায় দাঁড়ানো। বিপরীতপাশে আমাদের অপেক্ষা করার কাউন্টার কিন্তু আমাদের মাঝখানে দড়ি টাঙ্গিয়ে ইট বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখা হয়েছে। প্রতিবন্ধকতাটা তৈরী করেছে ট্রাফিক পুলিশ যেন কোচগুলো অবৈধভাবে গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তার অপর পারে যেতে না পারে এবং এস্থানে জ্যাম তৈরী করতে না পারে। এপারে দঁাড়িয়ে থাকা অর্থহীন অগত্যা ব্যাগ-বস্তা টেনে হিঁচড়ে প্রতিবন্ধকতা টপকালাম। একটা সিটি সার্ভিসের বাস দ্রুত গতিতে আসছিল বলে সেভাবেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। বলা যায় না, আমাকে বাস চাপা দিলে লোকে এসে হয়তো আমাকেই দুষবে, আইনভঙ্গের জন্য না বরং রোজার মাসে নারী জাতি কি কাপড় পরলো কিভাবে চুল বাঁধলো সেটাই হবে বিবেচ্য বিষয়। এই যে রাস্তাঘাটে প্রতারণা করা, নাজেহাল করা এবং অপরকে সহ্য করতে না পারা এগুলোও বলে দেয় ঢাকা মেগাসিটিতে আছি আমি। ঈদ এগুলো নিয়েই করবো আমরা। ঈদ এসেছে বলে পাল্টাবে না কিছুই।
ছোট বাসের জন্য আধাঘন্টা অপেক্ষা করতে হল সায়েদাবাদ বাস ডিপোতে। কিন্তু এই অপেক্ষা ছিল অনিশ্চয়তা নিয়ে উৎকন্ঠায় ভরপুর। এটাও ঢাকা মেগাসিটি চেনার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ বলা যায়। সাড়ে সাতঘন্টা জার্নি করে এসেছেন বলে আপনি বাথরুমে যাবেন, ফ্রেশ হয়ে আপনার জন্য অপক্ষেমান বাসে উঠে বসবেন এসব স্বাভাবিক আশা এখানে অস্বাভাবিক। কাউন্টারে অন্তত পাঁচজন লোক ল্যান্ডফোন মোবাইল ফোনে চেঁচামেঁচি করে বাস এর খবরাখবর নিচ্ছিল, কাউন্টারের আশে পাশে আরও জনা দুয়েক ছোটাছুটি করছিল কিন্তু কেউ আমাকে নিশ্চিত করতে পারছিল না ছোট বাসটা কতক্ষণে আমাদের নিতে আসবে। কেউ বললো এক মিনিট, কেউ একঘন্টা। অতএব আমি বাস কাউন্টারের অপেক্ষমান যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ প্লাস্টিকের চেয়ারে বসলাম। আর আমার সাথে একই বাসে ভ্রমন করেছে এরকম কয়েকজন পুরুষযাত্রী তাদের পুরুষালী আচরণ প্রয়োগ করে, হুমকি ধামকি দিয়ে বাস আসার অনিশ্চয়তাকে পাল্টানোর চেষ্টা করতে লাগলো। তাদের ভাষা : “মাইর একটাও আজকে মাটিতে পড়বে না”।
অপেক্ষা করতে করতে আমার পাশে বসা এক তরুনি আর তার ছয় বছর বয়সী কণ্যার সাথে আলাপ জমালাম। কণ্যাটি খোলামেলা আর সেক্স এ্যাপিলিং একটা টিউনিক পরেছিল আর তরুনিটি সালোয়ার কামিজ। পিচ্চিটা মহা আল্লাদ করে মোবাইল ফোনে তার বাবাকে জানালো যে তারা ঢাকায় পৌঁচেছে কিন্তু তরুনিটি স্বামীর সাথে কথা বলার অনাগ্রহ দেখিয়ে “অমানুষ” বলে চাপা একটা মন্তব্য করলো। ও আগে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো কিন্তু রোজার মাস শুরু হতেই সে সহ অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। ছাঁটাইয়ের শিকার হয়ে মেয়েটি চট্টগ্রামে গিয়েছিল বোনের বাড়িতে বেড়াতে। স্বামীকে সে তালাক দিয়েছে বেশ কয়েক বছর হল, কারণ “হ্যায় খেতে তো দেয়ই না উল্টা মারধর করে”। উপরন্তু লোকটি বিয়ে করেছে ৫/৬টি। মেয়েটি ছিল লোকটির তৃতীয় স্ত্রী। কণ্যাটি অবশ্য থাকে বাপের সাথেই নইলে মা’টি গার্মেন্টস এ কাজ করবে কিভাবে! “বুঝলেন আপা ড্রাইভারের জাতটাই খারাপ” উপসংহার টানলেন শ্রমিক তরুনিটি।
আমার বাসার কাছেই তার বাসা জেনে এবং ছোট বাস আসতে একঘন্টা লাগবে তথ্য পেয়ে ভাবলাম সিএনজি অটোরিক্সা ধরি। যথারীতি ছোটাছুটিই সার হল। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা আসতে আমার খরচ হয় ৫২০ টাকা আর সায়েদাবাদ থেকে মিরপুর অটোরিক্সা ভাড়া চাইলো ৪০০ টাকা। বুঝুন ঠ্যালা! বাপ-মায়ের সাথে ইফতার করার বাসনা ত্যাগ করে আবার চেয়ারে ফেরত আসলাম। বসতেই শুনি ছোট বাস এসে গেছে। আবারও ছোটাছুটি সার হল। বাস ড্রাইভার বললো সে যাবে না। পুরুষযাত্রীদের সাথে কাউন্টারের লোকের ঝগড়াঝাটি থেকে অনুমান করলাম যদিও আমাদের শোনানো হচ্ছে যে বাসটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি আছে আসলে সম্ভবত বাসের স্টাফদের ওভারটাইম খাটানো হচ্ছে। ঢাকা মেগাসিটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বাস ড্রাইভাররা কিভাবে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকে এটা নিয়ে আমি আগেও ভেবেছি। “অমানুষ” না হলে এদের টিকে থাকার কথা না। বাসে যান্ত্রিক ত্রুটির তথ্যটাও ঠিক হতে পারে। যন্ত্র হলেও বাসটার নিশ্চয়ই তেল পানি সার্ভিসিং লাগে।
বাসে ওঠার পর নিজ দায়িত্বে আমাদের উৎফুল্ল করার দায়িত্ব নিয়ে নিল বাসের হেল্পার। নাটকীয় ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ইসলামি ব্যাংক এর সৌজন্যে ফ্রি ইফতার বাক্স। তবে সেটা পেতে আমাদের ইফতারের আগে আগে কারওয়ান বাজার পৌঁছাতে হবে। হেল্পার নিজের কথাতে নিজেই কৌতুক বোধ করছিল কারণ গাবতলী থেকে আসতে তাদের তিন ঘন্টা লেগেছে। তবে ইফতার বাক্সে কি কি থাকে সেটার বর্ণনা দিয়ে আমাদের চাঙ্গা রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলো সে। কারওয়ার বাজার থেকে বিজয় সরনী পর্যন্ত সবার জন্য ইফতার বাক্স বিতরণ করা হয়। বাক্সের ভেতর বিশাল আর ভাল একটা বনরুটি আর পানির বোতলের কথাটা আমার কানে বিশেষভাবে ধরা পড়লো। ভাজাপোড়া আইটেম ছাড়া স্বাস্থ্যকর কোন আইটেম ইফতারে বিতরণ করা হয়, শুনিনি আগে।
সুখের কথা তিন ঘন্টা না, দেড় ঘন্টা লেগেছিল আমাদের। এই সময়ের মধ্যে আরও কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হল আমার। যেমন, আমার কয়েকজন সহযাত্রী। তারা সীমান্তরক্ষী জওয়ান । তারা আমার সামনেই বসলেন বলে তাদের খেয়াল করলাম, তাছাড়া তারা হেল্পারের চেষ্টায় উৎফুল্ল্ও হয়েছিল। হতে পারে ইফতার ঘনিয়ে আসছিল বলে বা ছোট বাসটি তাদের হম্বিতম্বিতে রওনা হয়েছিল বলে তারা খুশি। তাদের চিক্কন গাল দেখে মনে হল তারা সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছে। হতে পারে ২০০৯ এর বিডিআর বিদ্রোহ তাদের জন্য এই “চাকরির সুযোগ” তৈরী করেছে। এই বিদ্রোহের পর একটি “আনফেয়ার ট্রায়ালে” ১৫২ জন এরকম জওয়ান মৃত্যু পরোয়ানা পেয়েছেন, যাবজ্জীবন কারাদন্ড পেয়েছেন ১৫৯ জন এবং ২৩৫ জন নানান মেয়াদের কারাবাস- এটা মনে পড়ে গেল আমার। গাবতলী গিয়ে ওই তরুনরা উত্তর বঙ্গের বাস ধরবেন বলে মনে হল।
ফাঁকা বাস দেখে আমাদের বাসে জনা কয়েক “বাইরের” লোক উঠলো কমলাপুর, ফকিরাপুল থেকে। হেল্পার মহাশয় তাদের কাছ থেকে টু পাইস কামিয়ে নিল। আমার পেছনের সীটে বসে একজন মোবাইল ফোনে আলাপ করলো তাতে মনে হল সে পুলিশে চাকরি করে এবং সে কোন এক ইফতার পার্টিতে যোগ দিতে যাচ্ছে। এর কাছ থেকে হেল্পার টাকা নিল না। পুলিশদের রাস্তায় খোলাবাজারে এসব শুভেচ্ছা ছাড় প্রায়ই পেতে দেখি আমি।
কচ্ছপের গতিতে চলতে চলতে আমরা মিন্টো রোডে এসে একেবারেই দাঁড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর রমনা পার্কের গেইটে রং সাইডে বড় বড় জিপগাড়ি পার্ক করা আছে দেখে অনুমান করলাম এদের কারণেই আমরা জ্যামে পড়েছি। মাগরিবের আজান তখন পড়বে পড়বে করছে। বিডিআর জওয়ানরা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কৌতুক করল: “এরা কি ইফতার করবে না? এই সময়ে লোকে জগিং করে! এরা হল ডায়বেটিস রোগী তাই রোজা রাখে না”। একটু পরে আমাদের বাসের পাশে আটকে থাকা একটা সিডান গাড়ির ভেতরে টিস্যু পেপার বক্সের পাশে আর্মির একটি ক্যাপ রাখা দেখে কয়েকজন জওয়ান আনন্দে জানালা দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, হয়তো তাদের পরিচিত বা প্রিয় কোন কর্মকর্তা ছিল সে গাড়িতে।
রূপসী বাংলা পর্যন্ত ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা চললাম। ফ্রি ইফতার আমাদের কপালে জুটলো না। ট্রাফিক সিগনালে পণ্য ফেরি করে এরকম একজন আট/দশ বছর বয়সী ছেলে এক বালতি ঠান্ডা পানির বোতল বিক্রি করতে উঠলো আমাদের বাসে। হেল্পার যেন কোন কৌতুক বলছে সেই ভঙ্গিতে বললো: “এইটারে নামতে দেয়া যাবে না”। ছেলেটার বিক্রি করা পানিই হল জওয়ানদের ইফতার। ওরা ছাড়া অন্য যাত্রী কেউ রোজদার বলে মনে হল না। আমি আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থেকে সদ্য ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক তরুনিটি তো নয়ই। আমার পাশের সীটে একজন “পাহাড়ী” নারী আর কিশোরী ছিল তারা মুসলিম নয় বলেই প্রতিয়মান হচ্ছিল।
ইফতারের আজানের পর পর ভিআইপি রোডে একটু গতি আসলো। জওয়ানরা বাংলামোটরের আগে বাংলাদেশ নেভির বিজ্ঞাপনটি দেখে মহাখুশী হয়ে বাকবাকুম শুরু করে। ওরা পানি খেয়ে রাস্তায় খালি বোতল ফেললে সেটা অনুসরণ করে দেখি ভিআইপি রাস্তায় শত শত প্লাস্টিকের পানির বোতল। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে সেগুলো চ্যাপ্টা হয়ে আছে আর চলন্ত গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এক তরুন সেগুলো তুলে নিয়ে বস্তায় ভরছে। এরকম “টোকাই” ঢাকায় সাধারণ। তাদের গাড়ীর নীচে চাপা না পড়াটা শুধু আমার কাছে লাগে অসাধারণ। রান্নাঘরে বাতিল হয়ে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতলের কে.জি ২০ টাকা করে কয়েকদিন আগে আমি নিজেই বিক্রি করেছি। রাস্তার ময়লা সংগ্রহ ও বিক্রিই হয়তো এই তরুনটির মূল পেশা।
ধীরে ধীরে গাড়ির গতি বাড়ছিল। ফার্মগেট থেকে এক তরুন উঠলো বাসে, বসলো ঠিক আমার পেছনের সিটে। পুলিশটি কখন নেমেছে খেয়াল করিনি। নতুন তরুনটি ঢাকা মেগাসিটির পক্ষে অস্বাভাবিক ধীর ও ভারি কন্ঠে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল, রাস্তায় বেশ জ্যাম তাই তার (গন্তব্যে) পৌঁছাতে ৮/৯ ঘন্টা লাগবে জানাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আরও বেশ কয়েকটা ফোন কল সে রিসিভ করলো যার মধ্য দিয়ে আমার কাছে পরিষ্কার হল যে তার মা কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে এবং সে তাকে শেষ দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছে, বলছে: “জ্যাম অনেক। আমার পৌঁছাতে দেরী হবে। আপনারা মাটি দিয়ে দেন”।
ঘড়ি দেখলাম আমি- পিতৃদেবের অনুমান সত্য হতে যাচ্ছে, আমি সাড়ে সাতটাতেই বাসায় পৌঁছাতে যাচ্ছি। ঈদ করতে ঘরে ফিরছি কিন্তু ঈদ শুরু হবার আগেই আমি বার্তা পেয়ে গেছি ঈদ আসছে না অনেক নাগরিকের জীবনে। এরা সেই নাগরিক যারা এমন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী যেটা তাদের ভাবায়- “আমরা মুসলিম, আমরা দেশের ৯০ ভাগ, আমাদের উৎসবই সবচেয়ে বড় উৎসব”। তাদের অবাস্তব ভাবনাটাই একটা ব্রেকিং নিউজ হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় শোভা পায়। প্রতিদিনের বাস্তবতাটা খুব সাদামাটা আর গৎবাঁধা। যতই চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেটা দেখাকনা আমাদের স্তরায়িত সমাজের কদর্যতা, নিজেরাই নিজেদের (বা অপরের) অস্তিত্বকে অস্বীকার করার প্রবণতা আমাদের প্রবল।
ঈদ কি হচ্ছেনা তাহলে? ২৪/৭ টিভি চ্যানেল কি মিথ্যা দেখাচ্ছে? পত্রিকার হেডলাইন কি তবে মিথ্যা বলছে- মহা সমারোহে ভাব গাম্ভীর্যের সাথে ঈদ-উল ফিতর পালিত?
মাতৃদেবীর দেয়া ঈদের বাজেট পাঁচ হাজার টকা পার্সে ভরে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে গিয়ে আমি ঈদ উৎযাপনকারী নাগরিকদের দেখা পেয়েছিলাম বটে। ঢাকায় পৌঁছানোর দু’দিন পরে ইফতারের সময়ে সেই মলের ফুডকোর্টে গিয়ে প্রথম তাদের সাথে আমার দেখা হল। হাজারে হাজারে তারা সেখানে ফ্রাইড রাইস, নুডল্স, কোক-পেপসি, ফ্রাইড চিকেন সহ অপেক্ষা করছিল, সময় খুন করছিল স্মার্ট ফোনে/আই ফোনে ক্যান্ডিক্র্যাশ ধরণের গেইম খেলে খেলে। কিন্তু তারা সময় নষ্ট করছিল না। ইফতার আর মাগরিবের নামাজ এর বিরতি কাজে লাগিয়ে আবার তারা বিভিন্ন ফ্লোরে ফ্লোরে বন্টিত হয়ে গেল আমদানীকৃত অথেনটিক ভাল পোষাক, জুতা ইত্যাদি কেনায়। লক্ষ্য করলাম আমার মা আমার জন্য ঈদের বাজেট প্রতি বছরই বাড়াচ্ছেন বটে কিন্তু তার নির্দেশমত ঈদ উপযোগি পোষাকটি আমার বাজেটের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত আমি ভেবেছিলাম ৯০ ভাগে হয়তো আমি আছি। এখন দেখছি সেখানে আমারও জায়গা হয়নি।
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply