সািমনা লুৎফা
-“ফুলবাড়ি, ফুলবাড়ি, ফুল কই তোমার?
– বাংলাদেশের পথে পথে আগুন ফুল আমার”
আগুনফুলের সূতিকাগার ফুলবাড়ি জনপদের প্রতিরোধের এই দিন ধ্বংসাত্মক উন্নয়নভাবনার বিরুদ্ধে জনতার জয়ের দিন। নিজের পাওনা বুঝে নেওয়ার প্রশ্নে, দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য সাধারণ মানুষ কতদূর প্রতিরোধের সংগ্রামে নামতে পারে ২৬ আগস্ট আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। প্রাণ ও প্রকৃতি বিনাশী ‘উন্নয়ন’ মানে বড়লোকের পকেটের ‘ উন্নয়ন’। ফুলবাড়িসহ চার থানার অগণিত খেটে খাওয়া মানুষ যারা ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লাখনির বিরোধিতা করেন তাঁরা এ সহজ সত্যটা খুব সহজে বুঝে নিয়েছেন বলেই খুব সহজ করে বলতে পারেনঃ
“কয়লা খুনি হামরা চাই না। তোমাদের বাবার কবরের নিচে হীরার খুনি পালি কি তোমরা তা তুলতি দিবেন? দিবেন না তো না? তো হামরা দিব কেন? হামরা যে ধান ফলাই তাতে না তোমরা এক্সপোট করেন, কয়লা তুললি, ধান আসবি কত্থি? আর কয়লা তুললি তাতেতো দেশের বিদ্যুৎ হচ্ছে না … সব নিয়ে যাবি ওই এশিয়া এনার্জি। দেশেরও তো কুন লাভ নাই। কার জন্যি কয়লা তুল্যে এত্ত মানুষ রে উচ্ছেদ করবু? কয়লা খুনি হতি দিব না। জান গেলেও না। ”
২৬ আগস্ট ২০০৬ ফুলবাড়িতে আমিন, তরিকুল ও সালেকিনের জীবন দিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা এ প্রান-প্রকৃতি বিনাশী উন্নয়নের বিরুদ্ধে। তাঁদের রায়, জনতার রায়। তাঁরা আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে বেছে নিয়েছেন তাদের জনপ্রতিনিধি। বিগত প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে চুক্তি সই করেছেন যে ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনি হবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাদের জানিয়েছিলেন লাল সালাম, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এ খনি হবে না।
কিন্তু এশিয়া এনার্জি নাম পালটে ভোল পালটে জিসিএম হয়ে লন্ডনের অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে এ খনির মালিকানা নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে আজো। সেই ব্যবসায় যারা শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করেছেন তারা বাংলাদেশ, এদেশের মানুষ, এমনকি রাষ্ট্র প্রধান সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেন, পড়লে আঁতকে উঠতে হয়। সহজেই বোঝা যায় কোন উন্নয়ন, কার উন্নয়নের জন্য তাদের এত দরদ/কষ্ট। ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনি হলে লাভ কেবল ওইসব ভুঁইফোড় বিনিয়োগকারীর। বাংলাদেশের কোটি মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো তাদের মাথাব্যাথা নয়, দ্রুত কয়লা তুলে নিয়ে ভারতে রপ্তানির মাধ্যমে নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাতে এদেশের পরিবেশের, মানসম্পদের, কৃষির বা দূর ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা ইত্যাদির কি ক্ষতি তা তাদের দেখার সময় নেই। কিন্তু যারা সরকারে বসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদের তো থাকার কথা!! কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখি যে সরকারের ভেতরেও এদেরই দাপট বেশি। টাকার বিনিময়ে দেশের স্বার্থ বিক্রি করা ‘বিশেষজ্ঞ’, ‘সাংবাদিক’ আর নেতারা ১ লক্ষ মানুষের উছহেদ, পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি, পুরো পানির উৎসকে দুষিত করে ফেলার সব রকমের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় শুধুই স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। ইদানীং দেখতে পাই এরা বড় পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনি নিয়ে অতিতৎপরতা চালায়, পত্রপত্রিকা ও টিভিতে খনির সপক্ষে মিথ্যাচার ও বিকৃত তথ্য মিশ্রিত অপপ্রচার এর মাধ্যমে চক্রান্ত করে চলে। তবে জনতা বসে নেই। জনপ্রতিরোধ চলমান ।
এবারের ফুলবাড়ী দিবসের মূল শ্লোগান তাই, ‘শহীদের খুনে রাঙা পথে দালাল বেঈমানের ঠাঁই নাই।’ তেল- গ্যাস- খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ – বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাথে মিলিয়ে তাই আমরাও বলি ঃ- “জাতীয় সম্পদের ওপর শতভাগ জাতীয় মালিকানা, খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ করে শতভাগ দেশের কাজে লাগানো এবং জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য সামগ্রিক উদ্যোগই কেবল জনস্বার্থে দেশের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন করেই এই পথে অগ্রসর হতে হবে।”
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply