মাহা মির্জা
১.
বন্যার পানি নামছে। কত চরাচর, ঘরবাড়ি, খেলার মাঠ, গাই গরু, স্কুলঘর, আমন ধানের রোয়া, ক্ষেতের আইল, দোলনচাপার বেড়া ভাসিয়ে দেয়া বন্যা। দেশে এত ভয়াবহ একটা বন্যা হচ্ছে, এতগুলো মানুষ পানিতে ভাসছে, ঘরের চালে গরু বাছুর আকড়ে ধরে রাত পার করছে, বাঁধের উপর সারি সারি মানুষ, অথচ শহুরে জীবনে তা এতটুকু আঁচর কাটলনা।।
পানি নামলে শুরু হবে আরেক যুদ্ধ। ডায়রিয়া, কলেরা, ঘা পাঁচড়া। .. ঘর নাই, দুয়ার নাই, উঠান নাই, গরু বাছুরের খাবার নাই, ফসল গেছে ভেসে, এরমধ্যেই শুরু হবে লোন রিকভারি কার্যক্রম। বানের জলে সব খোয়ানো, গাল থোবরানো, অভাগা, অভুক্ত মানুষগুলোকে সকাল বিকাল ত্যাক্ত করার প্রোগ্রাম। হুহু করে ঘরে ঢুকে যাওয়া যমুনার জলে জান পরান দিয়ে যেটুকু ঘটিবাটী আকড়ে ধরে রাখা গেছিল, সেগুলো বেচে পেট ভরাতে হবে আশা প্রশিকার।
২.

Photo Credit @ http://sheetalshundori.blogspot.com/
সিডরের কথা মনে পড়ে যায়। একটা গোটা জনপদ উপড়ে ফেলেছে ঝড়। পেটের ছাওয়াল গেছে ভেসে। বুকে পাথর বেঁধে রিলিফের চাল আনতে গেছে মা। ১০ কেজি চালের ৫ কেজি নিয়ে গেছে নোবেল বিজয়ীরা। শরণখোলার মলি বিশ্বাস। সেলাই মেশিন কিনতে লোন করেছিল। মেশিন ভেসে গেছে দশ ফুট উঁচু জলোচ্ছাসে। সরকারী নির্দেশে চারমাস কিস্তি তোলা বন্ধ। ওয়েভার-পিরিয়ড শেষে আড়াইশ টাকার কিস্তি বেড়ে দাড়ালো তিনশ টাকা। মলি বিশ্বাস ব্র্যাক থেকে টাকা তুলে আশায় দেয়। গ্রামীন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্র্যাকে দেয়।
মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা হয়ে সাউথখালি। রাস্তা গেছে ভেসে।
সেই রাস্তা মেরামত হবে। ঝরে লন্ডভন্ড এলাকায় শুরু হলো ক্যাশ ফর ওয়ার্ক। ডেইলি মজুরি একশ টাকা। সেই টাকায় কেবল পেটের হাঙ্গরকে ঠান্ডা করার চাল কেনা। বাকিটা চিলের মত ছো মেরে নিয়ে যায় ফিল্ড অফিসার। উত্তর কদম তলার পরীবানু। ঘর তুলতে টাকা দিয়েছে সুইডিশ সরকার। পরী বানুর ঘর তোলা হয়না। সেই টাকা চলে যায় কিস্তিতে। ধানসাগর ইউনিয়নের কুলসুম। স্বামী নিখোঁজ। সরকার দয়া করে নিখোঁজ মানুষ বাবদ দিয়েছে ৫ হাজার টাকা। কুলসুমের আঁচলে গিঠ মারা ক্যাশ। নোবেল পাওয়া ব্যাংক তাকে ছাড়ে?
এইসব ঘটনাগুলো ডায়রীতে টুকতে টুকতে একসময় ডায়রির পাতা ফুরিয়ে এলো। ছয় মাস ধরে বলেশ্বর পারের মানুষের অদ্ভুত সংগ্রাম দেখলাম । আর দেখলাম কিস্তি নামের এক দৈত্যকে।
৩.
কাল থেকে পদ্মা যমুনার পানি নামতে শুরু করেছে। নামবে তিস্তার পানিও। সবই উজান দেশের স্লুইস গেটের খেলা। টিভিতে দেখছি সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলছেন, ঘর তুলতে তিন হাজার করে টাকা দেবে সরকার। ঝড়বন্যায় টিকে থাকা মানুষ জানে, সেই টাকার এক অংশ খাবে সরকারী দলের মেম্বার, আর বাকিটায় হবে কিস্তি শোধ। কার তাতে কি? এইসব ফকিন্নিদের দুঃখ কষ্ট শহরকে ছোয়না।
তারপর একদিন, গঞ্জের মানুষ, তিস্তা পাড়ের মানুষ, যমুনা পাড়ের মানুষ গাও গেরামের শিকড় ছেড়ে, চাদরের পোটলায় সংসার ভরে এই শহরে আসে। ঘিনঘিনে আবর্জনা বাড়ে।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply