কীছুই করতে পারবি না
উম্মে রায়হানা
একলোক একটা খেতের আইল ধরে হাঁটছে।
হঠাৎ অন্য একজন সেখানে হাজির হয়ে বলল- ‘এই এটা আমার জমি, তুমি এখানে হাঁটাহাঁটি করছ কেন?’
‘অপরাধী’লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বলল- ‘ভুল হয়ে গেছে ভাই’
‘না,ভুল হতে পারবে না।’
‘তাহলে কি ডান দিকে যাবো?’
‘না,ওই দিকেও আমার জমি।’
‘বাম দিকে যাই?’
‘না,ওইটাও আমার জায়গা।’
‘সামনে যাবো?’
‘না,ওইটাও আমার।’
‘পিছনে?’
‘না’
‘তাহলে আমি এখন কী করব?’
‘চুপ,তুই ‘কীছুই করতে পারবি না।’
মধ্যবিত্ত নারীর জীবন কাটাতে গিয়ে দারুণ মজার এই গল্পটা মনে পড়ে প্রায়ই-
আপনি যদি স্লিভলেস পরেন তাহলে আপনি সুড়সুড়ি দিচ্ছেন,আপনি যদি হিজাব পরেন তাহলে আপনি মৌলবাদী/রক্ষণশীল।এর কোনটাই না করে আপনি যদি সাধারণ পোশাক পরেন তাহলে আপনি ব্যাকডেটেড।
আপনি যদি সন্তানের সকুলের সামনে বসে থাকেন তাহলে আপনি একজন ‘ভাবী’, আপনার কোন কাজ নেই, সারাদিন বসে বসে কুটনামী করছেন। যদি না বসে থাকেন তাহলে আপনি যথেষ্ট যত্নশীল মা নন।
আপনি যদি সাংবাদিকতা বা সিনেমাটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেন তাহলে আপনি পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন/পুরুষ হতে চাইছেন। যদি না নেন তাহলে আপনি এসবের জন্য অযোগ্য।
আপনি যদি লিপস্টিক/নেলপালিশ পরেন তাহলে আপনি নিজেকে পণ্য করে তুলছেন। যদি না পরেন তাহলে আপনি সাজতে জানেন না।
আপনি যদি চাকরি করেন তাহলে আপনার চাহিদা বেশি, বাবার/স্বামীর রোজগারে আপনার চলে না কেন?আপনি বিলাসী,যদি চাকরি না করেন তাহলে আপনি অলস,অকর্মণ্য,সিরিয়াল দেখে দিন কাটান।
আপনি যদি চুল লম্বা রাখেন,চুলের যত্ন করেন, তাহলে সাজগোজ করা ছাড়া আপনার অন্য কোন কাজ নেই, আপনি ডাম্ব হেডেড। যদি চুল ছোট রাখেন তাহলে আপনি পশ্চিমা ফ্যাশনের দাস অথবা নারীবাদী।
আপনি যদি জিনস/কেডস পরেন তাহলে আপনি পুরুষালী,আপনি যদি লেগিংস/হাইহিল পরেন তাহলে আপনি আপস্টার্ট।এর কোনটাই না করে যদি সাধারণ সালওয়ার কামিজ/ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরেন তাহলে আপনি আনস্মার্ট।
আপনি যদি বিয়ের সময় মোহরানা নেন তাহলে আপনি নিজেকে বিক্রি করছেন। আপনি যদি বিয়ের পর শাঁখা-সিঁদুর পরেন তাহলে আপনি পুরুষের দাসত্ব মেনে নিচ্ছেন। এর কোনটাই যদি না করেন তাহলে আপনি ধর্মকে অবমাননা করছেন।
আপনি যদি ধূমপান/মদ্যপান করেন তাহলে আপনি অসামাজিক,যদি না করেন তাহলে আপনার এসব গ্রহণ করার মত সাহস/সামর্থ্য/ক্ষমতা নেই, আপনি আসলে পারেনই না। এর কোনটাই না করে আপনি যদি পান খান তাহলে আপনি গেঁয়ো।
আপনি যদি বিয়ে করতে চান তাহলে আপনি বিয়ে পাগলা, কামুক;যদি বিয়ে করতে না চান তাহলে আপনি উদ্ধত,সমাজের নিয়মনীতি মানেন না অথবা নষ্টামি করে নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাচ্ছেন।
যদি এ বিষয়ে আপনার কোন বক্তব্যনা থাকে তাহলে আপনার জীবন নিয়েকোন প্ল্যানিং নেই, দূরদৃষ্টি নেই।
আপনার রেজাল্ট যদি ভালো হয়, তাহলে আপনি সারাদিন পড়ালেখাই করেছেন, সাজগোজ, রান্নাবানা শেখেননি। যদি এসব করেও রেজাল্ট ভালো হয়, তাহলে স্যারেরা আপনার রূপ গুন দেখে ভালো নম্বর দিয়েছে।
আপনার রেজাল্ট যদি খারাপ হয়, তাহলে আপনি সারাদিন সাজগোজ আর শপিং নিয়েই ছিলেন, পড়ালেখা করবেন কখন? যদি ঐসবও না করেন তাহলে আপনি গুড ফোর নাথিং, পড়ালেখায় তো খারাপই, সাজগোজ করতেও শেখেননি।
আপনি যদি সন্তান নিতে চান তাহলে আপনার স্বামীর উপর অর্থনৈতিক চাপ দিচ্ছেন, বাস্তব জীবন সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই, সন্তানকে খাওয়ানো পরানোর দায়িত্বও আপনার ভাগাভাগি করতে হবে।
আপনি যদি সন্তান নিয়ে ডাবল বার্ডেন নিতে না চান তাহলে আপনি পলায়নপন্থী, মাতৃত্বের বেদনা ও দায়িত্ব নেওয়ার সাহস আপনার নেই। মাতৃত্বই নারীজন্মের সার্থকতা, আপনি নারীই নন অথবা আপনার জন্মই বৃথা।
আপনি যদি ফুটবল/ক্রিকেট না দেখেন তাহলে আপনি আঁতেল, যদি দেখেন তাহলে আপনি কোনদিন ব্যাট হাতে নেননি/ফুটবলে লাথি দেননি, আপনি আসলে খেলা দেখছেন না খেলোয়াড় দেখছেন।
আপনি যদি নারীজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন তাহলে আপনি আংশিক সত্য বলছেন, আপনি যদি কারো রেফারেন্স দিয়ে কথা বলেন তাহলে আপনি থিওরি কপচাচ্ছেন।
আপনার যদি মেয়েবন্ধু বেশি থাকে তাহলে আপনার ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগ/যোগ্যতা নেই। আপনার যদি ছেলেবন্ধু বেশি থাকে তাহলে আপনি ‘পুরুষচাটা’।
যদি সমান সমান থাকে তাহলে -এত বন্ধু কেন? আপনি আসলে ‘সস্তা’,আপনার পছন্দের বালাই নেই, সবাই আপনার বন্ধু।
আপনি যদি অফিসে সময় বেশি দেন তাহলে আপনি পরিবারকে বঞ্চিত করছেন,আপনার বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে, তারাই আপনাকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করেছেন, তাদেরতো দাবি আছে।
অথবা আপনার স্বামী-সন্তানের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করছেন।আপনার সন্তানের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে, স্বামী বহির্মুখী হয়ে পড়ছে।
যদি বাসায় বেশি সময় দেন তাহলে আপনি ফাঁকিবাজ কর্মচারী। অফিসে কাজে ফাঁকি দেন। মেয়ে বলে পাড় পেয়ে যাচ্ছেন।
আপনার যদি ঐশ্বরিয়া/ এঞ্জেলিনা/ সালমা হাইক কে ভালো না লাগে তাহলে আপনি ওদের হিংসা করেন। যদি ভালো লাগে তাহলে, নারীর সৌন্দর্যের আপনি কী বোঝেন? সে ক্ষেত্রে পুরুষের রায়ই চূড়ান্ত।
আপনার যদি ব্রাড পিট/ মিলিন্দ সুমন কে ভালো না লাগে তাহলে আপনার রুচি খারাপ, সৌন্দর্য বোধ নেই। যদি ভালো লাগে তাহলে আপনারা চেহারা দেখেই মজে যান, অভিনয়ক্ষমতা বিচার করেন না।
আপনি যদি বাবার সম্পত্তির ভাগ চান তাহলে আপনি লোভী। যদি না চান তাহলে আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন।
আপনি যদি নিচু গলায় কথা বলেন তাহলে আপনি লাজুকলতা/ মেয়েলি,যদি উঁচু গলায় কথা বলেন তাহলে খাণ্ডারনি/মুখরা।
আপনার রান্না যদি ভালো হয় তাহলে মেয়েরা জন্মগতভাবেই ভালো রান্না করে, এটা তাদের শিখতে হয়না অর্থাৎ এতে আপনার কোন কৃতিত্ছু
নেই।
আপনার রান্না যদি ভালো না হয় তাহলে আজকাল ছেলেরাও অনেক ভালো রান্না করে, আপনি পারেন না কেন? আপনি কেমন মেয়ে?
আপনি যদি নিজের লেখা/কথা/চিন্তায় নারী প্রশ্নকে সামনে না আনেন তাহলে আপনার মানসিক দাসত্ব ঘোচেনি অথবা আপনি ‘স্বাধীন’হতে চান না।
আপনি যদি নিজের লেখা/কথা/চিন্তায় নারী প্রশ্নকে সামনে আনেন তাহলে আপনি ‘মানুষ হয়ে উঠতে’ পারেননি অথবা অকারণে গলাবাজি করছেন, আপনি একজন ‘নারীবাদী’।
এর কোনটাই না করে যদি সাধারণভাবে লেখালেখি করেন তাহলে আপনি পুরুষের কলম দিয়ে লিখছেন।
আপনি তাহলে কী করবেন?
আপনি আসলে কীছুই করতে পারবেন না। কারণ আপনি নারী। আপনি যে পৃথিবীতে বাস করছেন সেটা আপনার নয়।
Categories: যাপিত জীবন
Leave a Reply