নাসরিন সিরাজ এ্যানী
সম্প্রতি এক ঘরোয়া আলোচনায় পরিচিত হলাম এক সচেতন মানুষের সাথে। প্রথমেই কেন যে তার সাথে আমার মেয়েদের ভূমি সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন ও তার বাস্তবিক প্রয়োগ নিয়ে কথা আরম্ভ হল, ভুলে গেছি। জঘন্য সত্য যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সব নাগরিককে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, লিঙ্গ নির্বিশেষ সমান মর্যাদা দেবার ঘোষণা দিলেও মেয়েদের ভূমি সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকারের বিধান ৪০ বছরেও নিশ্চিত করতে পারেনি। মুসলিম বাংলাদেশে ‘মেজরিটি’। তো সেই ধর্মে বিধান আছে যে মেয়েরা স্বামী ও পিতা দুই দিক থেকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হবে। ইসলাম ‘এক্সপার্ট’-রা কিভাবে কিভাবে যেন হিসাব করেন যে এই বিধানের ফলে মুসলিম নারীরা পুরুষদের চেয়েও বেশী সম্পত্তির মালিক হয়ে পড়বে। ফলে পিতার সম্পত্তির দুইভাগের একভাগ কণ্যারা পাবার বিধানটি খুব আধুনিক বলে ‘এক্সপার্ট’-রা মিথ্যা প্রচারও চালিয়ে থাকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ধর্ম নাকি ইসলাম থেকে বেশী বৈষম্যবাদী। তারা নাকি তাদের মেয়েদের আরও কম সম্পত্তি দেয়। আরও জঘন্য যে বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ কোন ভুমি উত্তরাধিকার আইন পাশ করা যায়নি। কয়েক বছর পর পর ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ নামে একটি তামাশা করা হয় দেশের নাগরিকদের সাথে। সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোন উন্নয়নের দিক নির্দেশনা থাকে না, থাকে চর্বিত চর্বণ। ‘মৌলবাদী’ বলে কুখ্যাত দেশের একটি ‘রিজার্ভ ফোর্স’ এই নীতিমালা পাশ/ফেলের পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ তামাশার সিজনে এই ‘রিজার্ভ ফোর্স’ বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের রাস্তাকে বানিয়ে ফেলে কুরুক্ষেত্র। ‘সরকার’ তখন নাগরিক সমাজ তথা এনজিও তথা আন্তর্জাতিক মাতব্বরগোষ্ঠীকে এই কথা বলার বাহানা পায় যে, “দেখো আমাদের দেশের মুসলিমরা মেজরিটি। তারা নারীদের সমান সম্পত্তি পাবার বিধানের প্রস্তাবেই ইসলামের অবমাননা দেখতে পাচ্ছে। প্লিজ আমাদের মাফ কর। আমরা নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে পারবোনা”। বিষয়টা একটা রিচুয়ালের মত হয়ে গেছে। দেশের সাথে সাথে আমরও বয়স ৪০ হল। দেশের শাসকগোষ্ঠীর রিচুয়াল আমার মুখস্ত।
মুখস্ত বিষয়ে আমাদের আলোচনা হচ্ছিল না। আমরা আলাপ করছিলাম ব্যক্তিগত জীবনে মুখোমুখি হওয়া বাস্তবতা নিয়ে। ঘরোয়া আড্ডার সচেতন মানুষটি শেয়ার করছিলেন কিভাবে তিনি মেয়ে হয়েও তার বাবা-মায়ের সম্পত্তি নিজের আয়ত্তে এনেছেন। জানেন বোধহয় যে বাংলাদেশের আরেকটি জঘন্য বিধান আছে যে পুত্র সন্তান না থাকলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার চলে যায় পিতার ভাই ও তার পুত্রদের কাছে। কারণ, মেয়েরা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হলেও কারো না কারো তত্তাবধানে থাকার দরকার এই মীথ দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র চলে। আলোচনায় জানলাম যে রাষ্ট্রীয় এই ফাজলামি থেকে বাঁচার উপায় হল মেয়েদের নামে সম্পত্তি দানপত্র করে দেয়া। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু আমি তো শুনেছি দানপত্র করা থাকলেও সেটা মামা এবং মামাতো ভাইদের তত্ত্বাবধানে চলে যায়?”। “এটা থেকেও বাঁচার উপায় আছে। তারা জাস্ট ঘোষণা দেবে যে এই অধিকার তারা চায় না বা তুলে নিচ্ছে”, জানালেন তিনি আমাকে।
আমার এই সচেতন আলাপীর নাম হাওয়া। এরপর তিনি আমাকে জানালেন যদিও তাঁর বাবা মা তাদের দুই বোনকে সম্পত্তি দানপত্র করে দিয়েছিলেন এবং মেয়েদেরও সম্পত্তি রক্ষার বিষয়ে সচেতন করেছিলেন তারপরও বাস্তবে সম্পত্তি দখলে আনতে তাদের চাচা ও চাচাতো ভাইদের দাপটের, হুমকীর শিকার হতে হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক চাকরি করে, সংসার সামলে, ছয় বছরের একটি কণ্যাকে বড় করার ফাঁকে তিনি নানা বুদ্ধি বের করে সত্যিকারের জমিনে সেসব দাপট ও হুমকী সামলেছেন। কিন্তু সমাজের সামনে এতো কাজের মাতব্বর হিসেবে এগিয়ে দিয়েছেন স্বামীকে, কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমাদের সমাজকে যথেষ্ট নারী বিদ্বেষী, নারীকে অদৃশ্য করার হাতিয়ারে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশের সামাজিক বিচার আচার মজলিশে নারীরা উপস্থিত না থাকা, বা উপস্থিত থাকলেও কথা না বলাটা সবাইকে খুশী করে।
আলাপ আমাদের ভালই চলছিল। সম্প্রতি সময়ে পড়া তসলিমা নাসরিন ও বিদিশার বই নিয়েও আমরা আলোচনা করলাম। মনে মনে যখন আমি ভাবছি যে এই আকালেও প্রথম আড্ডাতেই একটা মানুষকে আমার বন্ধু মনে হচ্ছে ঠিক তখন তাঁর একটি কথায় আমি একেবারেই চুপসে গেলাম। কথাটি তিনি ঠিক কি প্রসঙ্গে এবং কিভাবে বলেছিলেন সেই বিস্তারিত আলাপে যাচ্ছি না। মন্তব্যটি আমার বহুবার শোনা বলে এবং এর পেছনের ভাবনাটা নিয়ে বিদ্যাজাতগিত তর্ক বিতর্ক সম্পর্কে ধারণা থাকাতে সরাসরি তার মন্তব্যের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় চলে যাচ্ছি।
হাওয়ার সাথে আমার আড্ডার বর্ণনায় খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই যে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ও সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গীয় বৈষম্য নিয়ে সচেতন এবং বাংলাদেশের নারী সমাজের কঠিন এক সমস্যা মোকাবেলায় তিনি তাঁর দৈনন্দিন জীবনে ব্যপক তৎপর। ফলে তার মন্তব্য, “আমি নারীবাদী নই। আমাকে কেন নারীবাদী বলে ডাকতে হবে? একজন সচেতন মানুষই তো এসব বৈষম্য বুঝতে পারবে, এটাই তো স্বাভাবিক ও কাম্য” আমাকে হতচকিত করে ফেলে।
আসলেই তো! কেন আমি হতচকিত? লিঙ্গীয় বৈষম্য দেখতে পেলেই কি সে নারীবাদী? নারীবাদী কি শুধু সমাজের লিঙ্গীয় বৈষম্যই দেখতে পায়? নারীবাদীই কি শুধু লিঙ্গীয় বৈষম্য দেখতে পায়? -জিজ্ঞাসা আমার।
পাঠক মহলে নারীবাদ নিয়ে আমি সবসময় ব্যপক আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। নারীবাদের আলামত দেখা যাচ্ছে এমন লেখায় বা আলোচনায় নারীদের চেয়ে পুরুষ পাঠকদের মন্তব্য দেখলে মনে হয় কেন আমি ‘নারীবাদী লেখক’ হলাম না তাহলে আমার লেখার অনেক পাঠক পাওয়া যেত। জব্বার হোসেন বলে এক ট্র্যাশ লেখক নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করে। আমার অনেক বন্ধু দয়া করে তাকে সম্মান করার চেষ্টা করে এই ভেবে যে “যাক পুরুষ হয়েও সে নারীদের বিষয় নিয়ে ভাবছে”। কিন্তু নারীদের মধ্যে সাহসী লোক খুব কমই আছে যারা নিজেদের নারীবাদী বলে দাবী করেন। “তুমি নারীবাদী” উপাধিটা যেন খানকি বা বেশ্যার মত। কলংকের মত, আলকাতরার মত। নারীবাদীরা যেন একটি বিচ্ছিন্ন বস্তিতে বসবাসকারী কিছু বেকুব যাদের দিন দুনিয়া সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। নারীবাদের বিপক্ষে সবচেয়ে কুযুক্তি –নারীবাদীরা মানবতাবাদের বিপক্ষে, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, তারা মানব জাত থেকে নারীজাতকে আলাদা করে দেখতে চায়।
নারীবাদ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অজ্ঞতার শেষ নেই। আমার বয়ফ্রেন্ড কয়েকমাস আগে আমার অজ্ঞতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে প্রশ্ন করলো, “বলতো নারীবাদ শব্দটা কবে থেকে প্রচলিত হল? ইংরেজী ফেমিনিজম এর বাংলা নারীবাদই বা কে করলো? অন্য কোন বাংলা কেন করলোনা?” খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিন্তু উত্তর আমার জানা নেই।
আমি শুধু জানি যে নারীবাদ একটি দর্শন। এর একক কোন দার্শনিক নেই। এটা একরৈখিকভাবে এগোয়নি। বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন সমাজে, সমাজের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে নারীবাদ বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। নারীর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, জীবনালেখ্য, আত্মজীবনী নারীবাদী তত্ত্বের রূপ নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নারীবাদ নারীর সাথে নারীর জৈবিক সংহতিকে প্রত্যাখ্যান করে। এবং নারী যে সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটাও প্রস্তাব করে। লিঙ্গীয় বৈষম্য ও যৌনতা নিয়ে নারীবাদ ব্যপক কাজ করেছে ঠিক। কিন্তু সমাজের অন্যান্য বৈষম্যের আন্দোলনে নারীবাদ দর্শন হিসেবে যুক্ত হয়েছে এমন নজিরও প্রচুর। নারীবাদ নিজেরা যেমন নিজেদের সাথে ব্যপক তর্ক করে করে এগিয়েছে আবার বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার অনেক ডিসিপ্লিনকেও প্রশ্ন করে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আমি প্রস্তাব করছি না যে নারীবাদ একটি শ্রেষ্ঠ মতবাদ তাই আসুন সবাই দলে দলে আজ নারীবাদে যোগদান করি, নিজেদের নারীবাদী বলে ঘোষণা করি। বরং উল্টো বলবো, নারীবাদ অন্যান্য বিজ্ঞানের মতই ধীর। ধীরে ধীরেই আমরা এগুতে পারি। নারীবাদ বুঝতে মোটা মোটা বই পড়ারও প্রস্তাব আমি করছি না। সমাজটাতে সামাজিক জীব হিসেবে অংশ নেয়ার পাশাপাশি, পর্যবেক্ষনের পাশাপাশি দার্শনিকদের কাছ থেকে আমরা আলো ধার করতে পারি। আমার প্রস্তাব – নারীবাদকে প্রাপ্য সম্মানটুকু করা হোক। যেমন ধরুন বেগম রোকেয়া। স্কুলে থাকতেই তার ‘রসনা বিলাস’ পড়েই কি আমরা দেখতে পাইনি যে বাংলার কুলীন মুসলিম সমাজের নারীদের কি বুদ্ধিহীন জীবন কাটাতে হয়েছে। আমরা কি শিহরিত হইনি মানব জীবনের এই অপচয় দেখতে পেয়ে। আজকে আমরা চট করেই হাসছি তখনকার কুলীন মুসলিম নারীদের অন্দরমহল দেখে। হয়তো আমাদের মহল নিয়ে ১০০ বছর পরে আমাদের সন্তানেরা হাসবে। আজকে নারী শিক্ষা কতই না সহজ অথচ বেগম রোকেয়াদের এই সহজটাকে সহজ করতে সারা জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাদের কাজকে অস্বীকার করা মানে তো সচেতন মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভিতকে অস্বীকার করা। যেটা ভূমিকায় আলোচিত আড্ডায় হাওয়া করেছেন বলে আমি মনে করছি।
লেখা শেষ করবো নারীবাদ ও মানবতাবাদকে বিপরীতার্থক বলে অপপ্রচারে চিন্তার যে দীনতা প্রকাশ পায় সেটা বলে। এই দীনতা আমি আবিষ্কার করিনি। আমি শুধু আবিষ্কার করেছি যে আজকাল বিদ্যাজগতে এই দীনতা নিয়ে দার্শনিকরা বেশ আলোচনা করছেন। সরলভাবে বললে এই দীনতা হল সবকিছুকে দুটি শাখায় বিভক্ত বলে চিন্তা করা। যেমন ধরুন আমি আমার কথা বলছি। তার মানে কি আমি অন্যদের কথা বলছিনা? ভেবে দেখুন তা কিন্তু নয়। অন্যের সাপেক্ষে নিজেকে বলতে গিয়ে বা নিজের সাপেক্ষে অন্যের কথা বলতে গিয়ে আসলে কি আমরা আমাদের কথাই বলছি না? যখন আমি বলছি পশ্চিমা দুনিয়া তখন মনে হচ্ছে যেন অপশ্চিমা দুনিয়া বলে বিচ্ছিন্ন কিছু একটা দুনিয়া আছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন তো। আমরা কি বিচ্ছিন্ন? যখন আমরা বলছি সভ্যতা। কল্পনায় আমাদের ভেসে উঠছে অসভ্য বলে কিছু একটার কল্পনা যেটার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে কখনই ছিল না। তেমনি নারীবাদ বললে কি আমাদের মনে ভেসে উঠছে পুরুষবাদ বলে কোন কিছুর? আর সেই অসম্ভব ভাবনাকে জোড়াতালি দিতেই কি আমরা মনে করছি মানবতাবাদ আসলে সম্পূর্ণ আর নারীবাদ আংশিক? ভেবে দেখুন।
ফুটনোট: আজকাল আমি ব্রুনো লাটুর দ্বারা প্রভাবিত।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply