মির্জা তাসলিমা*
আমার ফে বু ওয়ালে এক বন্ধুর পোস্ট করা জা, বি ছাত্রী-হল প্রশাসনের একটা নোটিশের স্ক্যান্ড কপি ঝুলতে দেখে, বেশ স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েছি। ১৯৯৩ সালেও জা, বি ছাত্রী-হল প্রশাসন একই ধরনের একটা চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রীদের বাড়িতে ডাক যোগে পাঠিয়েছিল। বলাই বাহুল্য তখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, ফলে এই চিঠির একটা কপি আমার অভিভাকরাও পেয়েছিলেন। যদিও আমি তখন সে খবর আমার অভিভাবকদের কাছ থেকে জানতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে বাবার কাছে এমন চিঠি এসেছে কিনা জানতে চাওয়াতে যে উত্তর শুনেছিলাম, তা এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তিনি বললেন, পেয়েছেন এই চিঠি। আমকে কেন বলেনি জিজ্ঞাসা করলে ঘৃণাভরে বলেছিলেন, “এমন অশ্লীল চিঠি যে কি বলব তোমাকে, সামনে [তোমার] পরীক্ষা” [তখন এম এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, সেটাই আমার প্রথম মনোযোগ হওয়া উচিৎ]। আমার বন্ধু বান্ধবেরা প্রশাসনের এহেন ভূমিকার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল যা সূর্যাস্ত আইন বিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
কারণ ওই চিঠি লেখা হয়েছিল অভিভাবকদের হল প্রশাসনের সাথে একটা সভায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানোর জ্ন্য, যে সভার উদ্দেশ্য ছিল তখনকার সময়ে প্রচলিত সূর্যাস্ত আইনকে জোরালোভাবে বলবৎ করার আকাঙ্খার বাস্তবায়ন। ঐময় সূর্যাস্তের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের (কেবলমাত্র ছাত্রীদের) হলে প্রবেশের আইন ছিল। এই আইনের জোরালোভাবে প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাকে যুক্তিযুক্ত করতে গিয়ে প্রশাসন ঐ চিঠিতে বলেছিল যে “বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ঝোপে ঝাড়ে পাওয়া যায়”। এমন অশোভন-অশালীন চরিত্র হননকারী ঈঙ্গিত সকল ছাত্রীর বাড়িতে লিখিতভাবে পাঠিয়ে,বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাঁচা কাজ করেছিল । ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল। ছাত্রীছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ও আমাদের অভিভাবকেরা আন্দোলনে উপস্থিত হয়ে ক্ষোভ জানানোর ফলে প্রশাসন সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়। সাথে সাথে সূর্যাস্ত আইন বাতিল না হলেও ক্রমান্বয় এই আইনের কার্যকারিতা আর ছিল না।
একুশ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় যখন একই ধরনের নোটিশ ছাত্রী হলগুলোতে আবার ঝুলিয়ে দেয় তখন প্রশ্ন জাগে সময় কি আসলে খুব একটা পেরিয়েছে?
নোটিশটির ভাষা বিশ্লেষণ করে পাঠক বলতে পারেন- এখানে তো সূর্যাস্তের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে “প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ী রাত দশটায় হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। গেট বন্ধের পর কোন শিক্ষার্থী হলের বাইরে যেতে পারবে না বা বাইরে থেকে ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না”। কোন ছাত্র হলে নয়, কেবল ছাত্রীদের হলেই এমন নোটিশ দেওয়া হয়েছে, ফলে শিক্ষার্থী বলতে এখানে শুধু ছাত্রীদেরই বোঝানো হয়েছে, এটা স্পষ্ট বুঝতে হয়েছে। রাত দশটাই হলে ছাত্রীদের জন্য শেষ সময় সীমা বের হওয়া ও ঢোকার, এমন বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে চাওয়া হয় কোন ধরনের চিন্তা কাঠামো থেকে?! অনুমান করছি অনেকেই এপ্রসঙ্গে ছাত্রীদের নিরাপত্তার ওজর তুলবেন। রাত দশটার পর কেবল ছাত্রীরাই অনিরাপদ? এই সময়ের আগ পর্যন্ত কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র নারীদের জন্য অভয়ারণ্য? এছাড়া বেশী রাত পর্যন্ত ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পথঘাট মাঠ নিরাপদ? তা যদি না হয় কই তাদের জন্য তো এমন কোন নোটিশ ইস্যু হয়নি/হয় না! বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর নিরাপত্তার প্রসঙ্গটিকে কি ব্যক্তি, কি পরিবার, কি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সকলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়, তা কোনভাবে আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করছি না। কিন্তু এইরকম নোটিশ দেওয়া ও নোটিশের ভাষা ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতাকে বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না, বা এই নোটিশ সরাসরি তা বলেও না। যদি তা করতো তো বুঝতাম প্রশাসন জা,বি ক্যাম্পাস নারীর জন্য নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয়েছে তা স্বীকার করে নিচ্ছে। তাছাড়া ছাত্রীরা রাত দশটার পর আর হলে প্রবেশ করতে পারবে না এই ঘোষনা দিয়ে প্রকারান্তরে প্রশাসন দেরী হলে ছাত্রীদের নিরাপদ আশ্রয়ই কেড়ে নেবে বলে শাসালো। তবে প্রশাসন দেশ সমাজের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্যাম্পাস বা ঢাকায় ছাত্রীদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কি করা উচিৎ আর কি উচিৎ নয় তার পরামর্শ দিতে পারতো এবং তা দেওয়াও দরকার বলেও মনে করি।
নোটিশটি পড়ে আরো মনে হয়েছে, প্রশাসন আন্দাজ করে যে, রাত দশটার পর ছাত্রীদের হলের বাইরে নানান কাজে থাকবার প্রয়োজন হতে পারে। তবে তাদের কল্পনার দৌড় বেশী নয়, ফলে তারা একটা মাত্র জায়গা চিহ্নিত করেছে, যেখানে ছাত্রীদের কাজ থাকতে পারে। সেটা হলো ছাত্রীদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ফলে বলা হয়েছে, দশটার পর হলে ঢুকতে হলে, ছাত্রীদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সভাপতির সুপারিশসমেত একদিন পূর্বে হল প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে হবে। এর অর্থ আগু বেড়ে করা যায় যে, প্রশাসনের ধারণা ছাত্রীদের বিভাগে শুধু লেখাপড়াই কাজ। সামাজিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছাত্রীদের জন্য নয়। আরে বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীগুলোও তো রাতে দিনে খোলা থাকে, ছাত্রীছাত্ররা যে কোন সময় সেখানে জ্ঞানচর্চা করে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া তো উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেই দুর অর্জন। অথচ আমরা ছাত্রীদের হল বন্দী করার ব্যবস্থা পোক্ত করছি।
আবার বিভাগীয় সভাপতির সুপারিশকে এই নোটিশে অন্তর্ভূক্ত করার মধ্য দিয়ে হল প্রশাসন ছাত্রীদের উপর খবরদারিত্বে আরো আরোদের অংশিদারীও করতে চাচ্ছে। অর্থাৎ ছাত্রীদের সার্বক্ষণিক নজরদারী/প্রহরায় রাখার প্রশাসনিক অভিলাষই এখানে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রীরা সকলেই আঠারো বছর উত্তীর্ণ পরিপূর্ণ নাগরিক, তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক এই আচরণ /প্রচারণা/নির্দেশ যে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তা আমার সহকর্মীরা অনুধাবন করছেন না বলে অত্যন্ত পীড়া অনুভব করছি।
কোন পথ অনিরাপদ হয়ে উঠলে, সে পথ বন্ধ করার কোন নজির নেই, বরং পথটি নিরাপদ করবার প্রয়াসই শ্রেয়।
জাহাঙ্গীরনগর সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে, অস্রের ঝনঝনানী, মাস্তানী/সন্ত্রাসীকে জারী রেখে ছাত্রীদের দশটার মধ্যে হলে প্রবেশের নিবর্তনমূলক নির্দেশ আর যাই হোক ‘বিশ্ব’-বিদ্যালয়ের চৈতন্যের সাথে যায় না, তবে এখানকার কর্তাব্যক্তিরা আদৌ এই চৈতন্য ধারণ করেন কিনা- প্রশ্ন সেখানেই।
* Associate Professor, Department of Anthropology, Jahangirnagar University
Image I & II : Images of anti sexual harassment movement in JU (1998), photo credit: Mahmudul Sumon, photo digitization: Fabiene Gama
Image III: Recent notice which was circulated by Jahanara Imam Hostel Authority of JU (collected from facebook)
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply