সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যম দৃশ্যপটে সুখ্যাত একটি মতবিনিময় সভা বা টকশোতে ‘ফুলবাড়ীতে কয়লা উত্তোলন কোন পদ্ধতিতে হবে সে বিষয়ে সরকারের কি উচিত দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া?’ এ বিষয়ে আলোচনার অবতারনা করা হয়। আমি সেখানে অংশগ্রহণ করি, কৌতুহল নিয়ে লক্ষ্য করি যে ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ বলতে ঠিক কোন চুক্তিটি নির্দেশ করা হচ্ছে সেটা নিয়ে রয়েছে পরিষ্কার বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তিটি যে শুধু সেদিনকার আলোচনায় অংশগ্রহণকারী প্রশ্নকর্তাগণ, অন্য তিন প্যানেলিস্ট আর আলোচনা সঞ্চালকের মধ্যে সীমাবদ্ধ সেটাও নয়। বরং ফুলবাড়ী বিষয়ে সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় যে সব খবরাখবর এসেছে এবং স্থানীয়, জাতীয় ও রাষ্ট্রউত্তর পর্যায়ে এশিয়া এনার্জি বা জিসিএম-এর পক্ষে ও বিপক্ষে যে সব তৎপরতা চলছে সেগুলো পুন:পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হল এই বিভ্রান্তিটি আরও ব্যপক। তাই এনিয়ে পুন:আলোচনা জরুরী হয়ে পড়েছে। অবশ্য সাধারণ মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি সমৃদ্ধ মতামতকে যদি ‘এক্সপার্ট’ মতামত না মনে হয়, ‘উন্নয়ন বিরোধী’ মনে হয় তাহলে কোন কথা আর বলা চলে না। কিন্তু যদি জনপ্রিয় আন্দোলন এবং সেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণ আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি তাহলে শিরোনামে উল্লেখিত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অতীব জরুরী।
প্রথমে লক্ষ্য করি ‘ফুলবাড়ীতে কয়লা উত্তোলন কোন পদ্ধতিতে হবে সে বিষয়ে সরকারের কি উচিত দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া?’ এভাবে প্রশ্ন উত্থাপনের সমস্যায়। এভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করলে মনে হতে পারে এশিয়া এনার্জি বা জিসিএম এর প্রস্তাবিত ‘ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্প’র বাস্তবায়ন যেন ঝুলে আছে ঠিক কোন্ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে সেই প্রশ্নে। জেনে রাখা জরুরী যে ‘ফুলবাড়ী কয়লা খনি প্রকল্প’ বাস্তবায়নে সমস্যা কিন্তু কয়লা উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে নয়। আমার মতে ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা’ প্রসঙ্গটি বিবেচনায় আনলেই কেবল মাত্র এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আসল সমস্যাটি বোঝা যাবে। খনি এলাকা হিসেবে যে দশ হাজার হেক্টর এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ফুলবাড়ী সহ দিনাজপুর জেলার আরও তিনটি উপজেলা, যথা – বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ অন্তর্ভুক্ত, যেখানে হাজার বছর ধরে বিরাজ করছে মূলত গ্রামীণ কৃষি ভিত্তিক জনপদ, স্থানীয় হিসাবে যেটা সরাতে গেলে উচ্ছেদ হতে হবে পাঁচ লাখের মত মানুষকে, সেই মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখা ও তার বিকাশ জরুরী কি না সরকারের কাছে এই প্রশ্নটা উত্থাপনই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দেখা যাচ্ছে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে সরকার ও জনগণের নজর ভিন্নখাতে প্রবাহের অপপ্রয়াস চলছে।
ভুল প্রশ্ন উত্থাপন করলে আলোচনা ভুল পথে এগুবে এ আর বিচিত্র কি! ফলে টকশোটিতে যা হবার তাই হল। গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ সময় ও জায়গা নষ্ট করে পুরোনো ও বাতিল যুক্তিগুলোই পুন:প্রচারিত হল। যেমন: ১. বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার বিকল্প কোন জ্বালানীর অস্তিত্ব এ দুনিয়াতে নেই ২. যেহেতু কয়লার বিকল্প নেই তাই কয়লা মাটির নীচে ফেলে রেখে বাংলাদেশের উন্নয়ন এগুবে না ৩. একমাত্র পুনর্বাসনই হতে পারে ‘ফুলবাড়ী কয়লা খনি’র কারনে বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবনের ক্ষতি সামলানোর উপায়। অন্যভাবে বললে শেষ পরামর্শটা মাথায় রেখেই যেন প্রথম প্রশ্নটা উত্থাপন। জ্বালানী হিসেবে কয়লা যে ‘সেকেলে’ ও ‘নোংরা’ বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং বিশ্ব যে নবায়নযোগ্য জ্বালানী- যেমন সৌরশক্তি, হাওয়া, আবর্জনা-এর দিকে চলতে শুরু করেছে এ কথা যেন কেউ কষ্মিককালেও শোনেনি! ‘জনসাধারনের জান মালের স্থায়ী ধ্বংস’ নিয়ে উৎকন্ঠার মানে ‘আপনি উন্নয়ন চান না’! পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সেখানকার বাস্তুচ্যুত মানুষদের যে এখনও পুনর্বাসিত করা যায়নি সেটাও সকলে মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বেমালুম ভুলে গেলেন! আসলে মাত্র আট বছর আগে সংগঠিত ‘ফুলবাড়ী গণ অভ্যুত্থানটাই’ যেন ভুলিয়ে দেবার অপতৎপরতা চলছে।
ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে এশিয়া এনার্জি বা জিসিএম এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের যে পাকাপোক্ত কোন চুক্তি নেই সেটা জাতীয় দৈনিকগুলোতে ইতিমধ্যেই প্রকাশ হয়েছে। যে চুক্তিটি নেই সেটার ভিত্তিতে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে চলছে কোটি কোটি টাকার বেআইনী ব্যবসা আর দেশী-বিদেশী লবিস্টদের ওকালতি। অথচ ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট ‘বাংলাদেশের কোথাও কোনদিন উন্মুক্ত কয়লা খনি করা চলবে না’ এই মর্মে সচেতন নাগরিকদের মোর্চা ‘তেল, গ্যাস, কয়লা-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ এর সাথে স্বাক্ষরিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিটিই চলে গেল নাই এর খাতায়? ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কারের দাবী নিয়ে প্রায় সত্তর হাজার স্থানীয় কৃষক-ক্ষেতমজুর-দিনমজুর-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে তারা বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে তিনজন বাচ্চাকে মেরে ফেলা হয়, চিরতরে পঙ্গু করা হয় এক যুবককে, আহত করা হয় দুই শতাধিক নারী পুরুষকে। কার নির্দেশে বাংলাদেশ সীমানা রক্ষার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই হত্যকান্ড চালালো তার জন্য দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলা নিয়ে স্পিকটি নট?
যে চুক্তিটি আছে সেটা ভুলিয়ে দিতে যে চুক্তিটি নেই সেটা নিয়ে তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী, জননেতা আর নিরপেক্ষ নাগরিকদের আলোচনা দেখে শুনে একটিই উপলব্ধি হয় – দুনিয়াটা আজবই বটে। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মানে আজকাল দাঁড়িয়েছে উন্নয়ন আর উন্নয়নে সবার প্রথমে খরচের খাতায় আর অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা’। আর মানুষগুলো যদি হয় খেটে খাওয়া কৃষক-ক্ষেতমজুর-দিনমজুর-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানদার তাহলে তো কথাই নেই। জানিনা উন্নয়ণ বনাম মানুষের নিরাপত্তা এই ভারসাম্যহীন আলোচনা আর কতদিন চলবে। জানিনা সরকার ও ‘নিরপেক্ষ নাগরিকদের’ কত দেরী হবে ফুলবাড়ী কয়লা খনি এলাকার তিন মায়ের নাড়ী ছেড়া ধনের জীবন দিয়ে পাওয়া ‘ফুলবাড়ী চুক্তিকে’ সঠিকভাবে চিনতে ও সম্মান করতে।





Leave a comment