নাসরিন সিরাজ এ্যানী
আমার কাছে ব্রাত্য রাইসুর “বড়লোকদের সঙ্গে আমি মিশতে চাই” কবিতাটি বেশ ভাল লেগেছে। প্রথমত, কবিতাটিতে মধ্যবিত্ত (পুরুষের)-দের ধনীদের সাথে মিশে যাবার আকুল আকাঙ্খার দৃশ্যগুলো যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোয় বেশ সেন্স অব হিউমার আছে।ওর দেখানো আলামতগুলো পড়তে পাঠকের অপ্রীতিকর লাগতে পারে কিন্তু সেগুলোর বাস্তবতা আছে বলেই মধ্যবিত্তীয় গিদগিদা সে আকাঙ্খাগুলো পড়লে হাসি পেতে থাকে। এভাবে বাস্তবতাকে (আংশিক) বর্ণনা করে পাঠকের কাছে হাজির হওয়া একটা মাস্টারিই বটে। বড়লোকেরা খেতে ডাকবেনা, বসতে দেবে না, বাড্ডায় বাসা নিয়ে হাসবে, গাড়ীতে চড়ার কেতা জানা নেই বলে লজ্জা দেবে তারপরও বড়লোকেদের সাথে মিশতে না পারলে, তাদের বেডরুম দেখতে না পারলে সে মৃত্যুও চায়না-এমন এই মধ্যম শ্রেণীর প্রোটাগনিস্টটা। কবিতাটিতে মধ্যবিত্তীয় গিদগিদে আকাঙ্খাটি মূলত এ্যাড্রেস করা হয়েছে। এখানে প্রোটাগনিস্ট বিপ্লবী নয়। কবি যা নিয়ে কবিতা লিখেছে সেটাকে আমি সাধুবাদ জানাই।
এবারে আসি কবিতার শেষ অংশে। বড় লোকের সাথে মিশে যাবার মধ্যবিত্তীয় একই সাথে ঘিনঘিনে কিন্তু হাস্যকর আকাঙ্খাটি নিয়ে প্রোটাগনিস্ট বড়লোককে এতো ভালবাসে যে সে তাদের কুকুর/নারী বিয়ে করার বাসনা প্রকাশ করে (ভোগ করতে/ধর্ষণ করতে চায় বলেনি কিন্তু)। এখানে বড়লোকের মেয়ে আর কুত্তাকে কবি এক করে দেখেছেন, তাদের স্বত্তা আলাদা করা হয়নি বলে আমি পাঠ করেছি। বড় লোকের সাথে মিশে যেতে কবির প্রটাগনিস্ট বড়লোকের কুত্তারও (মানে নারীরও) অধম হয়ে থাকতে চেয়ে তার বড়লোকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে আমার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “কীটনাশকের কীর্তি” গল্পটি মনে পড়ে যায়। শ্রেণী বিদ্বেষ কিভাবে নারীকে তার শ্রেণী থেকে আলাদা একটা মানুষ বলে চেনায় না বরং শ্রেণীগত প্রতিশোধ নিতে একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে সেটা নিয়ে গল্পটি লেখা হয়েছে। রাইসু অবশ্য সেটা নিয়ে লেখেনি। কিন্তু মানুষ আর কুকুরকে আলাদা করতে না পারাটা লেখক (অথর)-দের দূর্বলতা তো বটেই। আর সে দূর্বলতা আমাদের (পাঠক বা পাঠিকা) চোখে আঙ্গুল দিয়েও দেখানো দরকার কারণ এর বাস্তব পরিণতি রয়েছে।
পরিশেষে, নারী তার নিজের শ্রেণী/সুবিধা ছেড়ে নারীমুক্তি তথা এই বিশ্বের সকল মানুষের/জীবনের মুক্তির জন্য নিজের শ্রেনী চরিত্র থেকে আলাদা করে নিজের কথা/লেখা/চিত্র/কর্তৃত্ব/মনুষত্ব প্রকাশিত করবে কি না সেটা নারীর নিজেরই (ইনডিভিজুয়ালিস্ট পড়বেন না) দায়িত্ব। তাই নারীবাদী কবিতার দিকেই তাকিয়ে আছি।
ব্রাত্য রাইসুর আলোচিত কবিতাটি নিচে দিলাম।পাঠ আমোদের হোক।
বড়লোকদের সঙ্গে আমি মিশতে চাই
ব্রাত্য রাইসু
যদি রুচিশীল তবু বড়লোক—এরকমই ভালো লাগে
ফরসা হলে বেশি। লুঙ্গি পরে না। কথা বলে স্পষ্ট ভাষায়
আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে মিশতে চাই।
সকালে দৌড়ায়। আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে দৌড় দেব
ধানমণ্ডি লেকের পাশে বাড়ি—
করতে পারব না কোনোদিন যারা ধানমণ্ডি লেকের পাশে বাড়ি
করেছেন, তাদের বারান্দায় গিয়ে বসে থাকব—
ছাদ থেকে লেক দেখব। লেকও আমাকে দেখবে—
সবাই বসতে দিতে রাজি তো হবে না
বিশেষত যাদের ড্রয়িংরুম বেশি বড়, লম্বা বেশি, সোফা বেশি
যাদের ড্রয়িংরুমে বসবার যোগ্যতা আমার নাই, হয় নাই, হবে নাই
তাদের বেডরুম কেমন তাতো কোনোদিন জানাই হবে না।
তবু বড়লোকদের বেডরুম না দেখেই মৃত্যু হলে সেটা খুব
অত্যন্ত খারাপ হবে। এমন মৃত্যু আমি চাই না তো।
পারি যদি একটি পছন্দসই বড়লোক বেডরুম সঙ্গে লয়ে
মারা যেতে চাই।
যদি মারা না গেলাম তবে বসে থাকতে চাই সেই বেডরুমে
তারা যদি বলে তবে সারাদিনই। কিন্তু যেদিনই ওদের বাড়ি যাবো
মানে যাই যাই, ওরা বলে বিদেশ থিকা এমেরিকা থিকা
ওদের দুই মেয়ে
দুইশ বছর পর আসতেছে, তাই এখন যাওয়া যাবে না—
পরে যাওয়া যাবে ওদের বাসায়।
বড়লোকদের সঙ্গে যৌন সঙ্গম ছাড়াই তবে এ জীবন যাবে!
তবে এইটা ঠিক যে, বড়লোকদের সঙ্গে পরিচয় হওয়াও কঠিন আছে।
ইংরেজি শিখতে হবে; নিজেকেও হইতে হবে অন্তত অর্ধেক, বড়লোক।
তবু আমি, তবু আমি মিশতে চাই বড় বড় লোকদের সাথে।
ওদের সঙ্গে যাব লং ড্রাইভে, জোরে দরজা গাড়ির
বন্ধ করলে ওরা হাসবে
তাতে আমি দরজা খুলে আস্তে করে লাগাব আবার দরজা যেন মোম
যেন আমি গাড়ি থেকে নামব আবার
যেন এই গাড়িই আমার বাড়ি, ভাড়া নিছি বড়লোক আব্বাজান থেকে।
ওদের ড্রয়িংরুমে বসে থাকব, হেসে থাকব, কার্পেটের উপ্রে
জুতা নিয়া বইসা থাকব, যতক্ষণ না খেতে ডাকে।
ডাকলে গিয়া খাব। যে ভাবে ওরাও খায়। ওরা কি চাবায়?
নিচের তলায়, চাকরেরা খাবার সাজায়।
ওদের বাসায় কত কার্পেট, বনমালি, লম্বা বাসা, লম্বা ঘাস,
সামনে বাগান।
চাকর অনেকগুলি, যেন ফুল ফুটে আছে, ভোর থেকে রান্নাবাড়া করে।
খায় না কিছুই।
বড়লোকদের সঙ্গে থাকে, নিয়মিত বড়লোক দ্যাখে তাই
কিছুই খাইতে হয় না। বেহেশতেই আছে।
বড়লোকদের বাচ্চাগুলি মোটা মোটা। ভাজা মুরগী খায়।
সাঁতরায়। বিনয়ের অবতার। বিকালবেলায়—
আমার তো ভালো লাগে এইসব। যত বেশি তত।
তবে বড়লোকদেরও শুনছি আব্বা আম্মা মারা যায়
ওরা তাতে অল্প অল্প কাঁদে।
বেশি দুঃখ পায় তাই কান্দে অল্প হাসে বেশি মদ খায়
আব্বা মারা গেলে।
ওদের সঙ্গে আমি মদ খাব। কান্তে হলে কানব।
বন্ধুর দুঃখে যদি না কান্দি তাইলে… ওরা আমাকে বাড্ডা পর্যন্ত
আগায় দিছে
টয়টা গাড়িতে।
ওরা হাসে, ‘তোমরা বুঝি গুলশানে থাকো!’
আমি বলি, ‘তাই।’ ওরা বলে গুডবাই—
আমি ওদেরকে ভালোবাসি—আই লাভ ইউ।
বড়লোকদের কুত্তা আর মেয়েগুলি মাখন খায়
তাই ওরা খুব সুন্দর
আমি ওদেরকে বিয়ে করতে চাই।
কলাবাগান, ঢাকা ১০/২/২০০২ (হালিকের দিন ২০১২)
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, সংস্কৃতি-রাজনীতি
Leave a Reply