নাসরিন সিরাজ এ্যানী
টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে আদিখ্যেতা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সহ্য হত যদি খেলাধুলা করতে পারার সুযোগটা বাংলাদেশের সকল নাগরিক সমানভাবে ভোগ করতেন। কিন্তু আমার শিশু/কিশোর বেলার কথা মনে করলে এবং বর্তমান সময়ে আমাদের বয়সীদের পেট থেকে বেরুনো শিশু/কিশোরদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণের মানচিত্রের দিকে তাকালে আমার উপলব্ধি হয় যে নারী পুরুষ শ্রেণী নির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিকদের খেলাধুলা করার সুযোগ সীমিত থেকে সীমিততর হচ্ছে। উপরন্তু “জাতীয় ক্রিকেট দল” বলে একটি ধারণা আজকাল নাগরিকদের মধ্যে বেশ মোহাচ্ছন্নতা তৈরী করতে পেরেছে। যার ফলে খেলাধুলা বঞ্চিত বাংলাদেশের নাগরিকরা “জাতীয় ক্রিকেট দল” নামক একদল সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষদের খেলাধুলা করতে পারার সৌভাগ্যকে মনে করছেন নিজেদের সৌভাগ্য। আর রাষ্ট্রও বেশ প্রপাগান্ডা চালাতে পারছে- “বাংলাদেশ খেলা ধুলায় আজ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিতে পেরেছ”। কিছু কিছু গাড়ল তো আরও এক কাঠি সরেস। “বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল” পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের দলকে হারানোকে ধরে নিচ্ছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে/ধর্মীয় মৌলবাদকে হারানো। রাষ্ট্রপ্রধানরাও বুঝে গেছে নাগরিকদের চোখটি কানা তাই রাষ্ট্রের নাগরিকদের খেলাধুলা করার ব্যবস্থা না করেও তারা হাসিমুখে খেলার দর্শক সারিতে বসে পাচ্ছে শতশত বাহবা।
আমাদের ছোটবেলায় মানে ১৯৭০-৮০এর দশকগুলোতে বাংলাদেশে ক্রিকেটের বদলে “জাতীয়” উত্তেজনা বিরাজমান ছিল ফুটবলকে ঘিরে। সে সময়ে মিডিয়া এতো রমরমা অবস্থায় ছিল না তারপরও বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং পত্রপত্রিকার বদৌলতে আমি আবাহনি/মোহামেডান নামক পুরুষ খেলোয়াড়দের ক্লাবগুলোর ফুটবল খেলার সাথে পরিচিত হই। ওয়ার্ল্ড কাপ টেলিভিশনে দেখে দেখে খেলাটা নিজে খেলতে পারার আকাংখা তৈরী হল কিন্তু বাস্তবে খেলাটা খেলতে আমাকে শহুরে-চাকুরিজীবীদের গন্ডি ছেড়ে গ্রামে যেতে হল। উপলব্ধি করলাম খেলাধুলা বিষয়টা নিয়ে মিডিয়া আর বাস্তবতার সাথে মিলের বদলে অমিলই বেশী। পরিপাটি মাঠের বদলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বর্ষায় হালচাষ করে ফেলে রাখা ধানক্ষেত, ফুটবলের বদলে জাম্বুরা আর খেলার নিয়মকানুন জানা দক্ষ খেলোয়াড়ের বদলে আনাড়ি সব নানাবয়সী ভাইবোন/বাচ্চাকাচ্চা। কিন্তু রাত জেগে টিভিতে পরিপাটি খেলা দেখার সাথে গায়ে কাদামাটি মেখে সত্যিকার অর্থে খেলতে পারার মধ্যে আনন্দের ব্যবধান মেট্রিক্স সিনেমায় দেখানো বাস্তব জগত আর বাস্তবের অনুকরণে তৈরী সিমিউলেশন জগতের উদাহরণ থেকে কিছুটা অনুধাবন সম্ভব। সম্ভবত ১৯৮৬-৮৭ তে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা মিডিয়ার প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করানো শুরু হয়। কিন্তু তখনও আমরা, মানে মফস্বলের ছেলে-মেয়েরা/বাচ্চারা, ফসল তুলে ফেলার পর পড়ে থাকা ক্ষেতে বা পাড়ার পরিত্যক্ত খোলা জায়গায় নিজেদের মত করে ক্রিকেট খেলতে পারতাম। বালিকা উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে ড্রিল স্যাররা ফুটবল/ক্রিকেট না শেখালেও আমরা নিজেদের মত করে দাড়িয়াবান্ধা/গোল্লাছুট খেলতে পারতাম। শীতের সন্ধ্যায় পাড়ায় পাড়ায় তরুনী/মহিলারা ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতেন পুরুষদের খেলা শুরুর আগে।
অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম লগ্ন থেকেই নাগরিকদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা তৈরী করেনি, খেলাধুলায় লিঙ্গীয়, শ্রেণী ও স্থানিক (শহর-গ্রাম) বৈষম্য বাস্তবজীবনে লক্ষ্য করা যেত আর এতোসবের মধ্যেও নাগরিকেরা নিজেদের গরজে নিজেদের মত করে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা তৈরী করে নিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে রাস্তা ধরে চলা শুরু করেছিল সেই রাস্তায় চলতে চলতে আজ কোন পরিস্থিতিতে আমরা এসে পৌঁচেছি তার সাক্ষী দিচ্ছে আমাদের বর্তমান শিশু/কিশোররা।
এখন ঢাকা শহর তো বটেই মফস্বল শহরেও পরিত্যক্ত কোন জায়গা নেই বাচ্চাদের খেলার জন্য। খেটে খাওয়া মানুষ যারা সেই নাগরিকদের সন্তানদের শৈশব রাষ্ট্র খুন করেছে সিস্টেমেটিকভাবে অনেক আগে। মাঝে মাঝে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয় যে মধ্যবিত্তদের বুঝি নাগরিকের মর্যাদা আছে। সত্য হল তাদের জন্য মিউনিসিপালিটি যে খেলার মাঠগুলো বানায় সেগুলো জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল তো বটেই উপরন্তু সেগুলো ছেলেদের ক্রিকেট ক্লাবগুলো দখল করে রেখেছে। আর আছে ডায়বেটিস রোগীদের হাঁটার জন্য বাঁধাই করা রাস্তা। ব্যাস। বেশীরভাগ স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ নেই। যে স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ আছে সেখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হবার সুযোগ সীমিত। রাস্তাঘাটে সাইকেল চালানোর সেরকম খালি জায়গা নেই, নিরাপত্তাও না। নদী খালে বিলে নৌকাবাইচের চলনও কমতির দিকে। সম্প্রতি তো মাস দুয়েক হল বাচ্চারা স্কুলেই যেতে পারছে না রাষ্ট্রের চেয়ার দখলে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির কামড়াকামড়ির ঠ্যালায়। বাচ্চাকাচ্চা আছে এমন বন্ধুদের সাথে কথা হলে বোঝা যায় যে সবাই কার্টুন নেটওয়ার্ক, ভিডিও গেইম, জি বাংলা, পোকেমান, ডোরেমন নিয়ে গালিগালাজ করে ঠিকই কিন্তু নিরুপায় হয়ে শিশুদের শেষতক টিভি/কম্পিউটারের হাতেই সোপর্দ করছে। ঘরে সীমানায় খেলা যায়, একা একা খেলা যায় এরকম খেলনা দিচ্ছে বাচ্চাদের। যৌন নিপীড়নের ভয়ে মেয়ে শিশুদের তো মায়েরা চোখের আড়ালই করতে চাইছে না।
মূল কথা, বাংলাদেশর নাগরিকদের খেলাধুলা করার সুযোগ সীমিত, দিন দিন সুযোগ আরও কমছে। তারপরও “জাতীয় ক্রিকেট দল”-ই বাংলাদেশের নাগরিকদের, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পুরুষদের ব্যাখ্যার অতীত এক গরিমা ও আনন্দের অনুভূতি দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ডকাপের মত খেলাধুলার বানিজ্যিক প্রদর্শনে তারা শরিক হচ্ছে দর্শকের ভূমিকা নিয়ে। কিছু নারীও তাদের ভাগ নিচ্ছে হয়তো খেলোয়াড় বোদ্ধা হিসেবে। “সাবাশ বাংলাদেশ” বলে সাবাশ দিচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত থাকার দীর্ঘ পথপরিক্রমাকে, বাদ পড়ে যাবার পরও “আমি আছি” এই ভ্রান্ত কল্পনায় আশ্রয় নিয়েছে এক্সক্লুশানের পতাকা তলে।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply