কেন আমি ‘জেন্ডার এক্সপার্ট’ হতে চাইনা

নাজনীন শিফা

কয়েক বছর আগে এক পাবলিক জমায়েতে এক সহপাঠী বন্ধু আমার পরিচয় করে দিতে যেয়ে বলেছিল, “ও একজন ‘জেন্ডার এক্সপার্ট’”। মনে আছে এই পরিচয়ে সেদিন কানটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উন্নয়ন সংস্থায় জেন্ডার বিষয়ে কাজ করছি, কিন্তু ‘জেন্ডার এক্সপার্ট’ পরিচয়ে আমার অস্বস্তি আছে। অস্বস্তির একটা জায়গাতো এক্সপার্ট শব্দটি নিয়েই। জেন্ডার এক্সপার্ট শব্দটি একটি টেকনিক্যাল এক্সপার্টিজ/ জ্ঞানের কথা বলে। ফুকো নিয়ে আমাদের খানিকটা পড়াশুনা জ্ঞান ও ক্ষমতার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই এক্সপার্ট শব্দটি নিয়ে এমনিতেই আমার এলার্জি এবং এটি তাত্ত্বিক কারণে। তবে সেই বিশ্লেষণে এখানে যাচ্ছিনা। আমি বরং আরো মোটা দাগেই বাংলাদেশে জেন্ডার চর্চা নিয়ে কিছু কথা বলবো এই লেখায়।

নারীবাদী দর্শনের অনেক ধারা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বোধহয় এনজিও কার্যক্রমের কারণেই পশ্চিমের উদারনৈতিক নারীবাদই নারীবাদের প্রভাবশালী ধারা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, যা মূলত পশ্চিমা শেতাঙ্গ নারীর লড়াই এবং আশা আকাঙ্খা থেকেই উৎসারিত। অবশ্য উদারনৈতিক নারীবাদ (হেজেমনিক নারীবাদও বলা যেতে পারে এটিকে) কে সমালোচনা করে খোদ পশ্চিমেই নারীবাদের আরো অনেক শক্তিশালী ধারা (ব্ল্যাক ফেমিনিজম, লেসবিয়ান ফেমিনিজম, ইকো ফেমিনিজম) তৈরি হয়েছে। শক্তিশালী নারীবাদী কাজ দাঁড়িয়েছে। নারী আন্দোলন নানা ভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এই ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে শক্তিশালী কোন আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বরং বাংলাদেশে নারী আন্দোলন এই হেজেমনিক নারীবাদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। স্থানীক পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্ন করলেও লক্ষ্যণীয় যে, এই ধারা কখনো গ্লোবালাইজেশন, কর্পোরেটাইজেশন এবং ক্যাপিটালিজমকে প্রশ্ন করেনা, যা কিনা বর্তমান বিশ্বে বেশিরভাগ নারীর জন্য বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র নারীর জন্য পির্তৃতন্ত্রের চাইতেও শক্তিশালী নীপিড়নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ঠিক গ্লোবালাইজেশন, কর্পোরেটাইজেশন বা ক্যাপিটালিজম যেমন কোন বাস্তবতাকেই বিবেচনা করে না, মুনাফাই তার শেষ কথা। একইভাবে এই হেজেমনিক নারীবাদ (যাকে বাংলাদেশে এখন অফিসিয়াল নারীবাদ হিসেবেও আমরা দেখতে পারি) পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে প্রশ্নহীনভাবে এগিয়ে চলছে।

হেসটার আইজেস্টাইনের ফেমিনিজম সিডিউসড বইটি আমার এই বোঝাবুঝিকে খানিকটা পোক্ত করেছে। বিশেষকরে, কীভাবে বৈশ্বিক এলিট জনগোষ্ঠী নারীর শ্রম এবং নারীবাদী ধ্যান-ধারণা কে ব্যবহার করছে সারাবিশ্বকে শোষণ করার জন্য, পুঁজিবাদী ডিসকোর্স এবং কর্পোরেশন কীভাবে হেজেমনিক নারীবাদী ধ্যান-ধারণা কে ব্যবহার করেছে। একই সাথে হেজেমনিক নারীবাদ কীভাবে এলিট শ্রেণী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষেই কাজ করেছে যা শ্রমিক নারী, বিত্তহীন নারীর কথা, লড়াই এবং জীবনমানের উন্নয়নে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এপ্রসঙ্গে তিনি (আইজেস্টাইন) জ্যঁ এল. পাইল এবং ক্যাথরিন বি. ওয়ার্ড এর কাজের উল্লেখ করেছেন, যা এই বক্তব্যকে আরো স্পষ্ট করে। পাইল এবং ওয়ার্ড তাদের কাজে দেখিয়েছেন, গ্লোবালাইজেশনের ফলে তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ নারী এবং দরিদ্র্য নারীর জন্য চার ধরনের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেমন: শোষণমূলক পরিবেশে ইপিজেড এ কাজ করা বা গৃহশ্রমিক হিসেবে ধনী দেশে অভিবাসন করা বা দেশীয় ইনফরমাল খাতে কাজ করা এবং ক্ষুদ্র ঋণ নেয়া অথবা বেশ্যাবৃত্তিতে যুক্ত হওয়া । গুরুত্বপূর্ণ হলো যে এই ধরনের কাজের সুযোগকে তৃতীয় বিশ্বের বা আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্র্য নারীর মুক্তি এবং ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে (উদা: সরকার সাম্প্রতিক সময়ে সৌদিআরবে নারী গৃহশ্রমিক নেয়াকে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসাবে ব্যাপক ভাবে প্রচার করছে)।

এ প্রসঙ্গে একটি টকশোর আলোচনাকে তুলে ধরছি। নারী দিবসের প্রাক্কালে দেশ টিভিতে (যুক্তি, তক্কো, গল্প, ৪ মার্চ ২০১৫) নারীর অধিকার এবং অর্জন নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। আলোচনার প্রায় পুরোটা অংশ জুড়ে ছিল নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সম্পদে সমঅধিকার, মূল্যহীন গৃহশ্রম, ঘরে ও রাস্তাঘাটে নারীর উপর নির্যাতন ইত্যাদি প্রসঙ্গ। এর কোনটিই নারী অধিকারের জন্য অপ্রাসঙ্গিক নয় বরং প্রতিটিই নারী অধিকারের খুব মৌলিক জিজ্ঞাসা। তবে আলোচনাটা আগাগোড়াই এমনভাবে এগিয়েছিল যা পুরোপুরি মধ্যবিত্ত নারীর লড়াই, স্বপ্ন এবং বাস্তবের গল্প। আলোচনার শেষভাগে আলোচকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপকের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে নারী অধিকার আন্দোলনের অর্জন কী? আলোচকরা প্রায় সকলেই (আলোচক হিসেবে ছিলেন সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এ্যক্টিভিস্ট) বললেন বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়েছে, তার উদাহরণ টানতে গিয়ে বললেন অনেক নারী পোশাকশিল্পে কাজ করছেন, ঘরের বাইরের কাজ করছেন ও উপার্জন করছেন, হাজার হাজার নারী শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে অভিবাসন করছেন। দেখুন এই বক্তব্য একইভাবে বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি উহ্য রাখছে, যা নারীর জন্য ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর বাইরে নিপীড়নের নতুন কাঠামো তৈরি করছে। অথচ আলোচকরা এটিকে তৃতীয় বিশ্বের নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

ফুলবাড়ী আন্দোলন, ২০০৬ (উৎস: ইন্টারনেট)

ফুলবাড়ী আন্দোলন, ২০০৬ (উৎস: ইন্টারনেট)

টকশোর উদাহরণ টেনেছি বটে। কিন্তু এটা বিচ্ছিন্ন কোন আলোচনা নয়। এই হেজেমনিক নারীবাদের চর্চাই বাংলাদেশে এখন প্রতিনিধিত্বশীল। আমি নিজে যেহেতু উন্নয়ন ডিসকোর্সের সাথে পেশাগত ভাবে যুক্ত, আবার একই সাথে সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বাংলাদেশের ক্রম পরবর্তনশীল বাস্তবতার একজন সাক্ষী, তাই বলতে দ্বিধা নেই যে এই হেজেমনিক নারীবাদের প্রবল উপস্থিতি মধ্যবিত্তের বাইরে অন্যান্য নারীর লড়াই, সংগ্রাম, আকাঙ্খা এবং বাস্তবতাকে আড়াল করে। একইসাথে এই হেজেমনিক নারীবাদ নারীর লড়াইয়ের সর্বজনীন ভাষা তৈরি করে। এপ্রসঙ্গে একটি উদাহরণ উল্লেখ না করে পারছি না। একবার কাজের সূত্রে মধুপুর অঞ্চলের ভূমিহীন আদীবাসী নারীদের সাথে তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বসে কথা বলছিলাম। জানতে পারলাম সেখানে নারীরা মিলে সমিতি করেছে, তারা এনজিও থেকে ‘জেন্ডার ট্রেনিং’ পেয়েছে। শুনে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম. ‘তাই? কী ট্রেনিং?’ সাথে সাথেই একজন উত্তর করলেন, ‘এই যে নারী-পুরুষ সমতা, সংসারে নারী-পুরুষ সবাই সমান কাজ করবে।’ কথাগুলো শুনতে খানিকটা তোতাপাখির বুলি আওড়ানোর মত লেগেছিল আমার! এই ভূমিহীন নারীর ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘জেন্ডার ট্রেনিং’ কী সহায়তা করবে তা আমার আজও বোধগম্য নয়। বলা বাহুল্য, সেটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ‘কর্ম এলাকা’।

বাংলাদেশের কিছু ইস্যু ভিাত্তক বিষয়ই নারী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় জায়গাতে পরিণত হয়েছে। যেমন সম্পদে নারীর সমান উত্তরাধিকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সম্পদে উত্তরাধিকার প্রশ্নটি সমাজের কত অংশ নারীর প্রতিনিধিত্বকারী? যেখানে সম্পদের মালিকানাই আছে গুটিকতক মানুষের হাতে! যেখানে বেশিরভাগ নারীই ভূমিহীন বা বড় বড় উন্নয়ন এবং খনি প্রকল্পের কারণে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া নারী বা কোম্পানীর কৃষি প্রকল্প, চিংড়ী ঘেরের কারণে উচ্ছেদ হওয়া নারী বা পাহাড় এবং সমতলের আদীবাসী নারী যারা প্রতিনিয়ত আধিপত্যশীল রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট লুন্ঠনের কারণে ভূমি হারায়। এই বৃহত্তর প্রশ্নকে যদি আমরা নারী আন্দোলের কেন্দ্রে না নিয়ে আসি, তাহলে সম্পদে বেশিরভাগ নারীর সমঅধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? একইভাবে নারী আন্দোলনের আরেকটি কেন্দ্রীয় জায়গা ঘরের বাইরে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ। যাকে মনে করা হয় পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু এই যদি একমাত্র পথ হয়, তাহলে এর বাইরেও যে হাজার হাজার নারী জীবন যাপন করে তার লড়াই সংগ্রাম কি মিথ্যা? নাকি ধরে নেব তার জীবন পুরোপুরি পিতৃতন্ত্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ? যখন পোশাক শিল্পের হাজার হাজার নারী শ্রমিক কাজ করতে এসে নিমেষেই অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়, ভবন ধ্বসে প্রাণ হারায় কিংবা যারা বেঁচে থেকে কাজ করে তারা কী সবাই স্বাধীন বা ক্ষমতায়িত?

টানবাজার আন্দোলন, ১৯৯৯ (উৎস: ইন্টারনেট)

টানবাজার আন্দোলন, ১৯৯৯ (উৎস: ইন্টারনেট)

মধ্যবিত্তীয় ’আমার শরীর আমার’ বা ’অর্থনৈতিক মুক্তিই নারী মুক্তি’ মার্কা বুলি যখন তোতা পাখির মত আওড়াতে শুনি তখন অনেকক্ষেত্রেই অর্থহীন মনে হয়, হাসি পায়। আমরা কি আসলে জানি একজন হিজড়ার জন্য লড়াইয়ের জায়গা কোনটা? তেমনি করে একজন বেশ্যার (উন্নয়ন সংস্থার বদৌলতে বেশ্যা শব্দটির বদলে যৌনকর্মী ব্যবহার করা হচ্ছে; এবং কিছু নারীবাদী লেখক/ গবেষক আবার এটিকে নারীর জন্য একটি সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখছেন!) জন্য নারীবাদ কী? কিংবা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বড় শহরে নির্মাণ শ্রমিক হয়ে ওঠা নারীর নিপীড়ন কী? তার সংগ্রামের জায়গা কী? হেজেমনিক নারীবাদ এইসকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না। তাইতো নারীর জন্য ৯-৫টার চাকুরী, সম্পদে সমান অধিকার, ঘরে স্বামী-স্ত্রী একসাথে ঘর গৃহস্থালির কাজ করা বা ঘরে স¦ামীর হাতে নির্যাতনের শিকার না হওয়া- ভাও (ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন) মিঠাই হয়ে ওঠে নারীমুক্তির স্মারক। নারীবাদের এই উদারনীতিপনার সাথে আমি আর যুক্ত বোধ করি না। বরং এই আধিপত্যশীল নারীবাদকে আমি প্রশ্ন করতে চাই। নারী আন্দোলনের নতুন ভাষা তৈরি করতে চাই যা বৃহত্তর বৈষম্যমূলক কাঠামোকে চিহ্নিত করে এবং প্রান্তিক নারীর লড়াই সংগ্রামকে চিনতে পারে।



Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , , , , ,

1 reply

  1. Informative. Educative. Provocative too. Moved. Appreciated.

Leave a Reply to Reza Rahman Cancel reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: