উদিসা ইসলাম
আসলে কোন কোন বিষয়কে পবিত্রতা দিয়ে বিচার করা হয়? নারীর সাথে পবিত্রতা জুড়লো কবে থেকে? কারা জুড়লো? মাসিক হলে নারী অপবিত্র থাকে। আর বাকী সময় তার পবিত্রতা রক্ষা করতে হয় তাকে নিজে। নারীদিবসের রঙের বাহারে যোগ হয় সাদা- পিউরিটি অর্থে। কেন? কিন্তু খোদ নারীও কেন প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি যে, কেন তাকে পবিত্র থাকার দায়িত্ব নিতে হবে। সে এক সমাধান না হওয়া বিষয়। সমাজ সমাধান করতে দেয় না।
সমাধান হয় না আরও অনেককিছুরই। নারী আন্দোলনের নামে আমাদের দেশে যে অদ্ভুত জিনিস দাঁড়িয়েছে তা হলো এনজিও-গিরি। আমি নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত এ কথাটির ভিন্ন কোন মানে আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। ‘আমি নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত’ বলার সাথে সাথে আপনার অপ্রস্তুত মাথায় কোন কথাটি আসে? আপনার মাথায় আসে – আমি এনজিও করি। নারী আন্দোলন মানেই কি করে এনজিও করা হয়ে উঠলো? এনজিওরা একটা বড় সময় ধরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারীর অধিকার কথাগুলো এমন জোরেশোনে উচ্চারণ করেছে যে সেটাই আমাদের মাথায় গেড়ে বসেছে। গেড়ে বসেছে সেসময় যেসময় কিনা রাজনৈতিক কোন সংগঠনের মধ্যে নারী আন্দোলন নিয়ে কোন সরব অবস্থান নজরে আসার মতো করে বা এনজিও অবস্থানকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো হতে পারেনি।
সমাধান হয় না অনেককিছু। একটা সময় এসে মনে হতে থাকলো নারীনেত্রীরা অনেকবেশি আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর। নারীদিবসের রঙটাই যেন মূখ্য হয়ে ওঠে। বেগুনী রঙ এর উপস্থিতি আপনার উপস্থিতির চেয়ে কি বড়? একদা এক ‘বড় নারী’ নারীদিবসে আমার প্রতি খুব নরম হয়েছিলেন এই ভেবে যে আমার বেগুনি কিছু না থাকাতেই বোধ করি আমি সেইদিনে হলুদ কিছু পরেছিলাম। দেখা হতে নারীদিবসের বক্তৃতা দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে কানের কাছে জানতে চাইলেন: কেমন হলো, ভাল বলেছি? মনে মনে বললাম এটা যদি পারফর্মেন্স হয়ে থাকে তবে ভালই ছিলো, আর যদি সংগ্রামের পথ তবে তা কি ভাল-খারাপ দিয়ে বিবেচ্য!!
এরপরই তিনি জোরেশোরে যা বললেন তাহলো: ইশ!! তুমি হলুদ পরলে, আমার কাছে আরেকটা বেগুনী ছিলোতো!!জানলে তোমায় দিতে পারতাম। তার কথাগুলো কান আসছিলো না প্রায়। মুখ নাড়ানো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কবে থেকে বেগুনী হয়ে উঠলো নারীর রঙ? এই কর্পোরেট নারী আন্দোলনে আমরা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছি যত, আমাদের নারী সত্তা নিয়ে ভাবার জন্য নিজেদের সময় হারিয়ে ফেলেছি ততই।
সমাধানতো হয়না আজও। মার্চের ৭তারিখ কোন এক কালের। এক পুরুষ বন্ধু স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করে তাকে দু-একটা চরম পুরুষবাদী কথাঘাত করে ঘুমাতে গেলেন। সকালে উঠে তার সংগ্রামী কাজ- ৮ মার্চের ভাষণ দিতে হবে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে স্ক্রিপ্টও রেডি করেছিলেন। বলেছিলেনও ভাল। হাততালি। অনেক পড়েছিলো। কী সাংঘাতিক হাতে পড়েছে নারীআন্দোলনের ঝাণ্ডা। সামাজিক রাজনৈতিকভাবে যে পরিস্থিতির তৈরী হয়েছে সেটার পরিবর্তন হবে কোন পথে? সে পথে কাদের কাদের একেবারে বাদ ঘোষণা করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কি এখনও আসেনি? সমাধান হয় না আজও।
সমাধান হয় না কিছুই। এখনও আজকের দিনেও অফিসে সমাবেশে সেমিনারে নারী বক্তাকে কোটাতেই ফেলা হয়। কোন একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নারীর বিশেষজ্ঞ মতামতই দরকার তার নিজের সক্ষমতার কারণেই বিষয়টা এভাবে প্রতিষ্ঠা না করে এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন, আচ্ছা এবিষয়ে একজন নারী কি বলেন? বা আচ্ছা এবিষয়ে একজন নারীর বক্তব্য না নিলেতো জমে না। বা আচ্ছা তিনজন পুরুষ মিলে নারীর কথা বলছে সেটা ভাল দেখাবে না, একজন নারীও রাখো সাথে। আর একজন আদিবাসী। সে নারী হলেতো আরও ভালভাবে কোটাপূরণ হয়। সমাধান হয় না। সমাধান হয় না কারণ আমরা ভাঙতে ভাঙতে গড়তে জানি না। সমাধান হয় না কারণ আমরা বোঝাপড়া করে শেষ করতে জানি না। সমাধান হয় না কারণ আমরা পালিয়ে বাঁচি। সমাধান হয় না কারণ আমরা মুখোশেগুলো বাঁচিয়ে রাখি।
ফেসবুকে এক নারী বন্ধু স্ট্যাটাসে সেঁটে দিয়েছেন- বরাবরের মতো নারী দিবসে শাড়ি উপহার পেয়েছেন অফিস থেকে, সেটা পরতেও হবে। তিনি সম্মানিত বোধ করবেন কিনা কনফিউজড। এই পোশাকি আনুষ্ঠানিকতার নারীবাদের ঘোমটায় গতকাল ধর্ষণের শিকার হয়েছেন পাহাড়ি নারী। রাঙামাটির কাউখালিতে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া হয় না ততটা যতটা ই-িয়াস ডটার ডক্যুমেন্টারি দেখে হয়। পাহাড়ে ধর্ষণের এই সংবাদ শিরোনাম মাথায় নিয়ে বেগুনী রঙের শুভেচ্ছা বিনিময় করবো আমরা। সমাধান হয় না।
একবার আরেক নারীনেত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম দেশে কতজন নারী ধর্ষণের শিকার হয় বা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হয় তার হিসেব ব্যতিরেকে আপনারা এন্যুয়াল রিপোর্ট তৈরী করেন সেটা অসমাপ্ত কিনা বা পাহাড়ের নারীরা দেশের নারীদের বাইরে কিনা। তিনি আমাকে বেয়াদপ ভেবেছিলেন। তার চোখ বলছিলো আমি বেয়াদবি করেছি আর সেই চোখের ভিতর আমি বেগুনী রঙ এর আভা দেখে ভাবছিলাম- সমাধানতো হলো না।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Recent phenomena, Nice