মাহমুদুল সুমন
১. ভাবনার শুরুটা একটা বুক রিভিউ থেকে। তারপর তত্ত্ব-পদ্ধতিতত্ত্ব নিয়ে খানিক পড়াশুনা। আমি সেই শুরুর ভাবনার সূত্র ধরে এগোতে থাকি। বইটি প্যাটরিসিয়া হিল কলিন্স লিখিত ব্ল্যাক ফেমিনিষ্ট থট। কলিন্সের নাম এই সময়ের আরো কয়েকজন নারীবাদীদের কাজের সাথে উল্লেখিত হতে দেখি। আর যে সব পদাবলীর সাথে কলিন্সকে উল্লেখিত হতে দেখি সেগুলো হল: ইন্টারসাব্জেকটিভিটি; উত্তরআধুনিকতা (উত্তরআধুনিক বলা মাত্রই এবসুলিষ্ট রিলেটিিিভষ্ট ভাবলে ভুল হবে। তবে এই মত দিয়েছেন কেউ কেউ) এমনকি ফেনমেনলজি। এই সকল পদাবলী-ই আবার আমার অগ্রহের বিষয়। এভাবে এই গ্রন্থসহ এই ধারার লেখকদের কাজের পদ্ধতি এবং এর পেছনে কী তাত্ত্বিক পূর্বানুমান ক্রিয়শীল তা অনুধাবন করাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। আসুন প্রথমে কলিন্সের ভাবনার কিছু দিকের সাথে পরিচিত হয়ে নেই। তারপর এর পেছনের জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুমিতি ও সম্পর্কিত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
২. কলিন্সের পাঠ ইঙ্গিত করে, পশ্চিমা নারীবাদী সাহিত্যে, দেরীতে হলেও একটু একটু করে জায়গা করে নিচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ, তার নানাবিধ প্রসঙ্গ ও তৎপরতা সমূহ। কলিন্স অধ্যাপনা করেন ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ ও নারীবাদ নিয়ে তাঁর আরো লেখালেখি আছে কিন্তু এই বইটির জন্য লেখকের দরদটা বেশী। বইয়ের প্রথম পরিচ্ছদেই তিনি সে’ কথা জানাতে চেয়েছেন এই বলে যে বইটা আমেরিকার সমাজে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বেড়ে ওঠার ইতিহাস, সেই লড়াই-সংগ্রামের বয়ান। এ প্রসঙ্গে কলিন্স তাঁর শিশুকালের কথা বলেছেন। বলেছেন, …পাঁচ বছরের শিশু কলিন্সকে স্কুলের প্রতিযোগিতায় বসন্ত কাল সাজতে হয়েছিল। আমেরিকান সমাজের আর পাঁচটা শিশুর মত কলিন্স সেই খেলায় মেতে উঠেছিল..মনে মনে তাঁর একটু গর্বও হয়েছিল..বসন্তকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে। তখন নিজকে নিয়ে সত্যি বলতে কী অনেক প্রশ্ন জাগেনি ওর..ও ছিল স্কুলের আর পাঁচটা শিশুর মতই..কিন্তু বয়ঃসন্ধির সাথে সাথে কলিন্স টের পেতে থাকলো পার্থক্যগুলো, যখন থেকে কলেজে, কর্মক্ষেত্রে ওকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে, ‘আলাদা’ হিসাবে, কখনওবা ‘একমাত্র অ্যাফ্রো-আমেরিকান’ হিসেবে দেখতে/ চিনতে বা বাছাই করতে শুরু করলো সবাই। কলিন্স বলছেনঃ দুনিয়াটা বড় হল ঠিকই, কিন্তু আমি কেমন যেন মিইয়ে যেতে থাকলাম:
I tried to disappear into myself in order to deflect the painful, daily assault designed to teach me that being an African American, working-class woman made me lesser than those who were not. And I felt smaller, I became quieter and eventually was virtually silenced.
এই গ্রন্থ সেই নিশ্চুপতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা সাহসী প্রয়াস, কিন্তু বিরুদ্ধাচারণের প্রোপাগান্ডায় এটি শেষ হয়নি। বইটিতে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের বয়ান ও ইতিহাসকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, কেবল একটু জায়গা নয়, সচরাচর পশ্চিমা লিবারেল নারীবাদী সাহিত্যে এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও যা করা হয়েছে বলেই লেখকের মত। এখানে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে, তাঁর অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্রে রেখেই নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে চেয়েছেন কলিন্স। এটি তাই কলিন্সের দিক থেকে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রচেষ্টাও বটে। এখানে আমরা তাই দেখতে পাই নানা পদ্ধতিতত্ত্বের ব্যবহার।
এক্ষেত্রে লেখকের উপলব্ধি অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের মত করে আরো নানা ধরনের মানহানিকর (ডেনিগ্রেটেড) ক্যাটাগরির মধ্যে বসবাস করবার যে অভিজ্ঞতা, তাদের ক্ষেত্রেও এই নিশ্চুপকরণ প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। এই পরিসরকে চিহ্নিত করা জরুরী মনে করেন তিনি। লেখকের মতে, এতে যেমন রয়েছে ব্যক্তিক আভিজ্ঞতা, তেমনি রয়েছে সামষ্টিকতার চিহ্ন, অর্থাৎ এমন একটি পরিসর যাতে লেখকের স্বতন্ত্র জীবন-চরিত আর বৃহত্তর ঐতিহাসিক সময় মিলেমিশে যায়। পাঠক লক্ষ্য করছেন নিশ্চয়ইঃ এই লেখক তার বয়ানে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে হাজির করেছেন এবং এই স্বতন্ত্র পরিসরকে কেন্দ্রে রেখে নিজের সময়কে, ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন। এটি দৈবাৎ নয়। তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরো একটু বিস্তারিত করা যাক কলিন্সের কাজকে।
৩. আত্ম ও সম্প্রদায়, বহু কন্ঠস্বর ইত্যাদি প্রসঙ্গঃ কলিন্স খুব উদ্দেশ্যপ্রবণ ভাবেই কিছু বিষয়কে প্রথম থেকেই সামনে রাখতে চেয়েছেন যা তার চিন্তামালাকে প্রকাশ করে। প্রথমত এমন একটি গ্রন্থ যা আফ্রিকান-আমেরিকান চিন্তার এক বড় পরিসরকে চিহ্নিত করতে পারে। তাঁর মতে, নিপীড়িতের কন্ঠস্বর অনেক ক্ষেত্রে শোনা হয় যখন তা প্রবল শ্রেণীর জন্য উপযোগী ভাষায় প্রস্তুতকৃত হয় বা উপস্থাপিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় আফ্রো-অমেরিকান ভাবনা বা চিন্তার মূল দিকগুলোই হারাতে বসে। একারনে কলিন্স এই গ্রন্থে বিশ্লেষণের কেন্দ্রে রেখেছেন অ্যাফ্রো-আমেরিকান নারীর চিন্তাকে। এবং এভাবে এই গবেষণা আহবান জানায় আমেরিকার মূলধারার নারীবাদী চিন্তা এবং অ্যাফ্রো-আমেরিকান পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি। এভাবে এই গবেষণা নানা ভাবনার মিল ও অমিল খুঁজবার একটা বিদ্যায়তনিক আয়োজন। এক্ষেত্রে লেখকের দাবী তিনি অ্যাফ্রো-আমেরিকান নারীবাদী চিন্তার পরিচিত এবং অপরিচিত নানাজনের দিকনির্দেশনামূলক কাজকে সামনে আনতে চেষ্টা করেছেন এই গ্রন্থে।
চলবে…
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply