লাশের হাজতবাস ও কারখানা পিতৃতন্ত্রের উপাখ্যান

পারুল, ২০১২, আব্দুল্লাহপুর, আশুলিয়া

পারুল, ২০১২, আব্দুল্লাহপুর, আশুলিয়া

শহিদুল ইসলাম সবুজ

মে ১১, ২০১৩।
রানা প্লাজার ধ্বসে পড়া ইট-বালি-সুড়কির নিচে তখনও উদ্ধার কাজ চলছে। অধরচন্দ্র স্কুলের বারন্দায় লাশের মিছিল। সাভার এলাকার সকল দেয়ালে চলছে নিখোঁজ শ্রমিকদের ছবির হাহাকার। বাতাসে লাশ, এয়ার ফ্রেশনা আর কর্পুর মিলে এক অজানা গন্ধ। আমি অধরচন্দ্র মাঠে স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে লাশ সংরক্ষণের কাজ করছি। লাশ সনাক্ত হলে কফিনের বাক্সে চাপাতা বরফের যোগাড়যন্ত্র করা। এরই মধ্যে নিশ্চিন্তপুর থেকে একজন ফোন করে জানালো, হামীম গার্মেন্টসের একজন শ্রমিক, পারুল তার নাম, ডিউটিচলাকালে আত্মহত্যা করেছে। ছুটে গেলাম আশুলিয়া। কিন্ত ততক্ষনে দেরী হয়ে গিয়েছে।

হামীমের পেছনে সোনা মিয়া মার্কেটের সাথে হাজী পাড়ায় একটা ঘরে পারুল তার মা, বোন, দুলাভাই থাকত। বাড়িতে কেউ নেই। ঘরে গিয়ে প্রতিবেশীর কাছে জানলাম, পারুলকে নারী ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আশ্বস্ত হলাম। ভাবলাম, এখনও আশা আছে, দরকার হলে ঢাকায় নিয়ে যাবো। আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল আমার জন্য অপরিচিত জায়গা নয়। তাজরীন অগ্নিকা-ে আহত শ্রমিকদের খোঁজে বহুবার এসেছি এখানে। হাসপাতালে পৌছে মুল ফটক পুলিশ পাহাড়ার বহর দেখে ভড়কে গেলাম। আমাকে ঢুকতে দেবে না। কত নম্বর বেডে রোগী, রোগীর নাম, কবে ভর্তি হয়েছে — হাজার কথা জানতে চাইল। মূল কথা ঢুকতে দেবে না। তখনই বুঝে নিলাম পারুল মারা গিয়েছে। রাগের চোটে চোখে পানি এসেছিল এই কথা ভেবে, এই রাষ্ট্র জীবিত পারুলের নিরাপত্তা দেয়নি, এখন লাশের খবরদারীর জন্য পুলিশ টহল বসিয়েছে। অবশেষে হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তারের নাগাল পেলাম, ডিউটি ডাক্তার বলল, “লাশতো ঘন্টাখানেক আগে কারখারনার একজন কর্মকর্তা, জনৈক পি.এম রিপন আশুলিয়া থানায় নিয়ে গিয়েছে।” থানায় গিয়ে একই হেনস্থা। আশুলিয়া থানা পুলিশ লাশ দেখতে দিল না। দায়িত্বরত পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম, লাশতো পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠানোর কথা? উত্তরে তিনি জানালেন, “সব কালকে জানতে পারবেন।”

আবার পারুলের বাসায় ফিরে গেলাম। পারুলের সহকর্মী ও প্রিয় বান্ধবী গার্মেন্টস শ্রমিক সুমি ও জেসমিনের সাথে দেখা। দিনের ঘটনা শুনলাম বিস্তারিত, “পারুলকে আমরা সবাই ভাল জানি। সবাই ওকে ভাল চোখে দেখত। কারখানার জি.এম (জোনারেল ম্যানেজার), হক সাহেবের ভাগনা, মেকানিক্স রুবেলের সাথে কিছুদিন হল সম্পর্ক হয়েছে। এই জন্যই হক সাহেব সন্ধ্যা ৬টার দিকে পারুলকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে যায়। আধাঘন্টা পরে পারুল কাঁদতে, কাদঁতে বের হতে দেখেছি। ওখান থেকে বেরিয়েই ও বাথরুমে যায়। আর সন্ধ্যা ৭.২০-এর দিকে কারখানার ইন্টারকম মাইকে ঘোষণা করা হয়, পারুল নামে একজন শ্রমিক বাথরুমে আত্মহত্যা করেছে।” পারুলের মৃত্যুর খবর শুনে সবাই পারুলের আত্মীয় ও প্রতিবেশী সকলে নারী শিশুকেন্দ্রে ছুটে যান। কিন্তু পুলিশ কাউকেই লাশ দেখতে দেয় না। অনুমান করি কারখানা কর্তৃপক্ষ লাশ প্রথমে নারী শিশুকেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল। অনেক অনুনয়-বিনয় করে রাতে নারী শিশু কেন্দ্রে একঝলক পারুলের লাশ দেখতে পেরেছিলেন তার মা, “আমার ডাঙর-জোয়ান মেয়ে, ডান দিকের চোয়ালে জমাট রক্ত আর গলায় কালো দাগ।” রাত ৯টার দিকে পোস্টমর্টেমের কথা বলে লাশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সারা রাত পারুলের লাশ আশুলিয়া থানায় আটকে রাখা হয়। পারুলের মা ও দুলাভাই লাশের খোঁজ নিতে গেলে, কারখানার এ্যাডমিন শহিদুল্লাহ, পি.এম রিপন তাদেরকে গালাগালি করে। এই কথাগুলো যখন, পারুলের মার কাছ থেকে শুনছিলাম, মনে মনে ভাবছিলাম, শ্রমিকের মরেও শান্তি নেই, লাশেরও হাজতবাস হয়। ঘটনা শুনে মনে হয়, পারুল লাশকে যেন গ্রেপ্তার করে রাতভর হাজতবাসের সাজা দিল!!!

১২ মে, ২০১৩।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে লাশ দেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তাদের কড়া নজরদারীতে দিনে দিনে লাশ দাফনের ব্যাবস্থা করে। আব্দুল্লাহপুর থেকে লাশের গাড়িতে পারুলের মা লাইলী বেগমের সাথে কারখানার এ্যাডমিন শহিদুল্লাহ ও একজন নিরাপত্তাকর্মী রওনা দেন গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। লাশবাহী গাড়ী চলতে শুরু করার সাথে সাথেই, এ্যাডমিন শহিদুল্লাহ লাইলী বেগমের কাছ থেকে হাসপাতাল ও থানা কর্তৃপক্ষের দেয়া সকল কাগজপত্র নিয়ে নেয়। পারুলের দাফন প্রক্রিয়ার পুরোটাই সম্পন্ন হয় কারখানার চরম নজরদারীতে। নিছক আত্মহত্যা হলে, এত কিসের সতর্কতা।

১৩ মে, ২০১৩।
আমি যখন পারুলের বাড়ি পৌছাই তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কুলখানির আয়োজন চলছে। পারুলের কবরের কাছে দাড়িয়ে, ছোটভাই রাজীব বলল, বোইনে ঢাকায় যাওয়ার পরে আমি স্কুলে ভর্তি হইছি। এখন কি হবে?” পারুলের বাবা ঘটনার আকস্মিকতা তখনও সামলে উঠতে পারেনি। বারে বারে বলতে থাকল, এত জায়গা থাকতে কারখানায় কেন আত্মহত্যা করবে? বাড়ির বড় মেয়ে, দায়িত্বশীল হিসেবে সবাই তাকে জানে। হঠাৎ, কথা নাই বার্তা নাই আত্মহত্যা করবে এই কথা কেউ মেনে নিয়ে পারছিল না। বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিটিকে কবরস্থ করে লাইলী বেগম ঢাকায় ফিরছেন, আমিও তাদের সহযাত্রী।

ঢাকায় ফিরে আবার যখন আশুলিয়ায় গেলাম, পারুলের পরিবার আর আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন না। পারুলের মৃত্যুকে ঘিরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। শুনলাম একটা এনজিও পারুলের পরিবারকে এক লক্ষ টাকা দিয়েছে। কিছুদিন পরে আবার জানতে পারলাম কারখানা থেকে নাকি ৭০ হাজার টাকা দিয়েছে। পারুলের ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাইলাম, কিন্ত ফোনে যোগাযোগ করতে পারিনা। কেন পারুল কারখানার বাথরুমে আত্মহত্যা করতে গেল, যদি সে সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকে, সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না। থানায় কোনও মামলা হয়নি।

বেশ কয়েকমাস পরে নিশ্চিন্তপুরে গিয়েছি তাজরীন অগ্নিকা-ে আহত শ্রমিকদের সাথে কথা বলতে। সেখানে হামীম কারখানার ইমামের সাথে দেখা হল। তার কাছে জানতে চাইলাম, কি হয়েছিল বলেনতো? বলল, “কারখানায় শুনছি, মেয়েটা প্রেম করে, বোঝেন না? মানে পেট বানাইছে আর কি?” বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলাম, কে বলছে, এসব কথা? ইমাম সাহেব বলল, “কারখানায় শুনি। মেয়েটা দেখতে ফরসা-সুন্দর ছিল, সবার নজর ওর উপরে। কিছু একটা হইছে আর কি?”

এই আলাপ যখন চলছে, তখন আমার সাথে সহযোদ্ধা বন্ধু সায়দিয়া গুলরুখ ছিলেন। সায়দিয়া মুখ ঝামটা মেরে বলল, “মেয়েদের মরেও শান্তি নাই। লাশেরও চরিত্রহনন করবেন আপনারা?”

কারখানা কর্তৃপক্ষের গুজব ছড়ানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়। হর-হামেশাই হয়। আমি যে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের সাথে কাজ করি, এই সংগঠনের নারী কর্মীদের চরিত্রহননের চেষ্টা কারখানা কর্তৃপক্ষ বহু বছর ধরে করে আসছে। যে কোনও নারী শ্রমিককে কোণঠাসা করার জন্য তার নামে কুৎসা রটানোর কাজ মনেহয় লাইন ম্যানেজার, ফ্লোর ম্যানেজারদের জব ডেসক্রিপশনের অংশ, আমারতো তাই মনে হয়।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো সমাজের পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কারখানা পরিচালনার একটি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে। আমরা যারা গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করছি, আমরা এই কাঠামোকে কারখানা পিতৃতন্ত্র হিসেবে চিনে নিয়েছি। এই কাঠামোর অধীনে শ্রমিক নারী কারখানায় দৈনন্দিন বৈষম্যের শিকার হন, বৈষম্যকে মোকাবিলা করেন। পারুলের জীবন ও আত্মহত্যা — এই প্রাত্যহিক বৈষম্যের ও নির্যাতনের বাস্তবতার স্মারক।

পারুল বোন, যে কারখানা পিতৃতন্ত্রের বিষদাঁতের ছোবলে তোমার গলায় নীল-কালশিটে হার পড়ায়, ক্ষমতায়নের গল্প বলে সেই ছোবলের দাঁত ঢাকব না। আজ আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে আমার এই প্রতিজ্ঞা তোমার স্মৃতির প্রতি আমার একমাত্র শ্রদ্ধার্ঘ্য।



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ

Tags: , , , , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: