বেশ্যারা দেখতে কেমন?
ফিরে দেখা শাহবাগ আন্দোলন
সায়দিয়া গুলরুখ
ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।
তখন যে গ্রামে আমার নিবাস, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলীম লীগের প্রভাব ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। গ্রামে তখনও বেশ ঠান্ডা। হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই, আমার গ্রামেরই গরীব মুক্তিযোদ্ধা কাকা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। কোথায় মাটি দেয়া হবে তাই নিয়ে জ্ঞাতগুষ্টির ঝগড়া চলল সারারাত। পরদিন। বাদ জোহর নামাজ-ই-জানাজা হল। বাসার আঙ্গিনার জানাজায় কয়েকশত মানুষ। আঙ্গিনা উপচে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাযায় শরীক হয়েছেন। আমরা মেয়েরা ঘরের জানালা দিয়ে দেখছি। দেখলাম গেটের বাইরে, রাস্তার এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন ইয়াসিন মিঞা, ফুপিয়ে কাঁদছেন। এলাকার কেউ কেউ তাকে আড়ালে রাজাকার হিসেবে চেনে। আমার চোখের বিস্ময় মুক্তিযোদ্ধা কাকীর চোখ এড়ায়নি।
দুদিন পর আবার যখন কাকীর সাথে দেখা করতে গেলাম, রান্না ঘরে লাকড়ীর চুলায় চা বানাচ্ছি। কাকী আমাকে বলল, “তোমার কাকাকে একবার মুক্তির লোক ছুরি দিয়ে মারতে এসেছিলো। স্বাধীনের আড়াই বছর পর হবে সেটা। তোমার কাকার এক জীবনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেল।” আমি চুপচাপ লাকড়ীর চুলায় আগুনের নড়াচড়া দেখি। কাকী বলে যায়, “তোমার কাকা তখন সবে পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরেছে। ওখানে যুদ্ধবন্দী ছিল। এসব গল্পতো তুমি হাজারবার কাকার মুখে শুনেছে। সামরিকবাহিনীতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজের ব্যাবস্থার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু তখনও কোনও পোস্টিং হয়নি। পোস্টিংয়ের চিঠির অপেক্ষায় আছেন। তোমার কাকা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অত হম্বিতম্বি করতেন না। পায়ের ক্ষত সারেনি। তাই ঘরেই থাকতেন। এই এলাকায় একসময় অনেক ঘর হিন্দু ছিল। আমি যখন বউ হয়ে এসেছি, তখনও এই পাড়ার মন্দিরে সন্ধ্যায় ঢাক বাজত। যুদ্ধের পর রোজদিন হিন্দুদের জমি-জমা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ। একদিন একঘর হিন্দুদের জায়গা নিয়ে ভ্যাজাল বাধল। দুই দলের মারামারি। মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো এই ইয়াসিন মিঞা আর তোমার কাকা। তোমার কাকা অবশ্য যুদ্ধের আগে বহুবছর এলাকায় আসেনি। তাই এলাকায় কার কি ভুমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় অত খোঁজখবর রাখেনি। যুদ্ধে এক পা হারিয়ে দেশে ফিরে নামাজ-কালামে মনোযোগী হয়। তাদের মসজিদেই পরিচয়। রিটারমেন্টের পরে তারা রোজ একসাথে মসজিদে আসা-যাওয়া করতেন। তোমার কাকা কখনও বাসায় আসতে বলেননি, গেট থেকেই বিদায় নিতেন।”
কাকী এমনিতে স্বল্পভাষী, কাকা বেঁচে থাকতে কাকীর সাথে আমার কথা প্রায় হতই না। এসেই কাকার সঙ্গে গল্প করতাম। সেদিন চায়ের কাপ হাতে, রান্না ঘরে আগুনের আলো ছায়ার নড়া-চড়া, কাকার হঠাৎ চলে যাওয়ার জমাট বাধা দীর্ঘশ্বাস। ভাবছিলাম, গত বেয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে গ্রামে-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের কত সংঘাত, সমঝোতা, মেলামেশা হয়েছে। আমরা যাকে অজপাড়া গাঁ বলে চিনি, সেখানে রাজাকারদের বিচারের এক সামাজিক প্রক্রিয়া চলমান। রাষ্ট্র সরকারের জন্য তারা অপেক্ষা করেনি। হয়ত। সঠিকতো জানি না। আমার চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সাদা-কালো ইতিহাসটা মলিন হতে থাকে। ইতিহাসের ধুসর মুহূর্তগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। গ্রামে বসে চুপি চুপি স্মৃতি-বিস্মৃতির রাজনীতি নিয়ে ভাবি। কিন্তু, ঢাকায় ফিরে উত্থাপন করার সাহস পাই না।
তিন সপ্তাহ পরে কাকীর সাথে মুক্তিযোদ্ধা কাকার মৃত্যুসনদ নিয়ে গ্রামের কাছের ছোট্ট শহরে গিয়েছি। ব্যাংকে জমা দিতে হবে। যাওয়ার পথে দেখলাম, শহরের মূল চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চ বানানো হয়েছে। ব্যানারে পাশে কাকতাড়–য়াবেশেী রাজাকার, গলায় জুতার মালা। বিশাল মাইক। মাইকে জাগরণের গান বাজছে। ছোট্ট বেদী। রাস্তার খানিকটা জায়গাজুড়ে শতরঞ্চী পাতা। কিন্ত শুন্য জমায়েত। বেদীর কাছে বেশ কিছু মটর সাইকেল রাখা। আর খানিকদূরে চায়ের দোকানে বলে ছেলে-পেলে বিড়ি ফুকে, আর চা খায়। ব্যাংকে পর পর দু’দিন যেতে হল। দুদিনই একই দৃশ্য। প্রায় জমায়েতহীন গনজাগরণ মঞ্চ দেখে নানাকারণে ভীষণ বিচলিত হলাম। জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে রাজাকার প্রসঙ্গ যে ক্ষতর জন্ম দিয়েছে এই গ্রামে বা পাশের ছোট্ট শহরের সেই ক্ষতের স্বরূপটাকি তা আমি বুঝতে পারি না। কখনও স্মৃতির আতিশয্যে, আবার কখনওবা বিস্মৃতির দীনতায়, আমি নিরন্তর দিশেহারা হয়ে থাকি।*
কিন্তু ঢাকায় ফিরে এত কিছু ভাবার সময় সুযোগ নেই।
মার্চ মাস। ২০১৩।
উত্তাল শাহবাগ।
মোড়ে মোড়ে সবুজ-লাল পতাকা, ফুলের আল্পনায় ঝলমল করছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের স্বপ্নে বিভর প্রজন্ম চত্বর। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত ইতিহাসের ধুসর পাতাগুলো, ঢাকার অদূরের জমায়েতহীন গণজাজরণের দৃশ্যটা অস্বস্তির সাথে মনে নিয়ে আমি হাজারো মানুষের ভিড়ে আড়াল খোঁজার চেষ্টা করি। এ জন্য নয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমি চাই না। মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবার অধিকার রাষ্ট্রকে দেয়া উচিত নয় — এই নিয়েও আমার স্পষ্ট অনঢ় রাজনৈতিক অবস্থান নেই। গোলাম আজম, সাইদী, কাদের মোল্লার বিচার আমি চাই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ধর্ষকের ফাঁসি চেয়েছিলাম মনে-প্রাণে। ন্যায্যতার বোধকে রাজনৈতিক সঠিকতার দাড়িপাল্লায় মাপা কত কঠিন গণজাগরণের মাসগুলোতে সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি প্রতিদিন।
ইতিহাসের এই সাদাকালোকরণ আমি প্রত্যাখ্যান করি, তা সত্ত্বেও শাহাবাগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির গণজোয়ারে ফিরে ফিরে যাই। এমনই এক শেষ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক প্রগতিশীল বন্ধুর সাথে দেখা। তড়িঘড়ি করে পাশে ডেকে নিয়ে তিনি বলেন, “জানেন নাতো, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সন্ধ্যা নামলেই চারিদিকে কলগার্লে ভরে যায়। দেখলেই বুঝতে পারবেন।” বুঝলাম জামাত-শিবির-হেফাজত কর্মীরা শাহবাগের পুরুষ আন্দোলকারীদের ‘স্ক্যান্ডালাইজ’ করার জন্য টোপ হিসেবে “শাহবাগে কলগার্ল আছে,”এই প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। সফলও হয়েছে। আন্দোলনকারী পুরুষরা সতীত্ব নিয়ে ব্যতিব্যাস্ত। আমার বন্ধুটি আবারও বলল, “একটু সন্ধ্যা হলেই বুঝবেন।” একই কথা আরও দুতিনবার বলে, তিনি হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন। আমি পিছন থেকে আস্তে আস্তে বললাম কিন্তু, “বেশ্যারা দেখতে কেমন, চেনেন কিভাবে?”

আমার বন্ধু আমার প্রশ্ন হয় শুনতে পায়নি, বা শুনেও কানে নেয়নি। কিন্তু সেই থেকে তসলিমা নাসরিনের বেশ্যা যায় কবিতাটা বারবার মনে পড়ছে, শাহবাগ আন্দোলনের মঞ্চ ভেঙ্গেছে দুইবছর হল, কিন্তু এই কবিতাটা আমার পিছু ছাড়ছে না:
বেশ্যার শরীর অবিকল মানুষের মত,
মানুষের মত নাক, চোখ, ঠোট, মানুষের মত হাত, হাতের আঙুল
মানুষের মত তার হাঁটা, পোশাক আশাক,
মানুষের মত, হাসে, কাঁদে কথা বলে Ñ
তবু মানুষ না বলে তাকে বেশ্যা বলা হয়।
বেশ্যারা সকলে নারী, কখনো পুরুষ নয়।
যে কারণে নারী বেশ্যা হয়, যে সংসর্গে,
একই সংসর্গে অভ্যস্ত হয়ে পুরুষ পুরুষই থাকে।
বেশ্যারা পুরুষ নয়, মানুষের মত অথচ মানুষ নয়
তারা নারী।
ওই দেখ বেশ্যা যায় – বলে নারীকে আঙুল তুলে
মানুষেরা দেখে ও দেখায়।
[নির্বাচিত নারী, তসলিমা নাসরিন, বেশ্যা যায়, পৃ.৪৮]
একটু আগেই ইতিহাসের সাদাকালোকরণ নিয়ে আমার অস্বস্তির কথা লিখলাম, তাই ধর্মান্ধ ছাত্র শিবির কর্মী আর প্রগতিশীল বামপন্থী পুরুষকে এক কাতারে ফেলতে দ্বিধাবোধ করি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দুপক্ষকে একই কাতারে আনার ঝুঁকি ভিন্নতর। কিন্তু সেদিনের শেষ বিকালে, যে আদর্শিক ভিন্নতা তাদেরকে অন্য সকল ক্ষেত্রে মুখোমুখি করে, তা ক্ষনিকের জন্য দ্রবীভূত হতে দেখি। তখন দুপক্ষই (প্রগতিশীল পুরুষ-ধর্মান্ধ পুরুষ) পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শকে বহন করেছে একই নিষ্ঠায়। মুখোমুখি দুপক্ষের চোখেই নারী ভয় দেখানো ও ভয় পাওয়ার বস্তু (object of fear)।
ধর্মান্ধ পুরুষের চোখে “শাহবাগী” নারী যদি হয় বেশ্যা-রূপী টোপ, তবে শাহবাগের আন্দোলনকারী পুরুষেরা এই যৌনবাদী প্রচারণার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে বার্থ হয়েছেন।
কবিতাটা পড়ি আর ভাবি, লিঙ্গীয় সম্পর্কের গণজাগরণ কবে আসবে?
—————————————————————————————————————————————————-*এই লেখার স্মৃতি-বিস্মৃতির রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনা ফরাসী দার্শনিক পল রেক্যুরের একটি প্রায় এ্যানসাইক্লোপেডিক তাত্ত্বিক আলোচনা, Memory, History, Forgetting (২০০৪) দ্বারা প্রভাবিত। রেক্যুরের চিন্তার সাথে বোঝাপড়া এবং সেই চিন্তাকে বাংলায় প্রকাশ করার কাজটি সহজ ছিল না। এই কাজে আমার এক দূর সম্পর্কের প্রেমিকের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। এই পাদটীকায় তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।




Leave a comment