নাসরিন সিরাজ এ্যানী
ঠোঁটকাটার “আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিশেষ সংখ্যা” উপলক্ষ্যে আমার ব্লগটিকে “নারীর পক্ষে যাওয়া যখন বিপদ জনক” এর ধারাবাহিক বলা যেতে পারে। আগের ব্লগটিতে আমার আপত্তি ছিল মানুষের বাচ্চা যারা মারছে বা হত্যকারীদের সালাম দিচ্ছে তাদের প্রথাবিরোধী সাহসী নারী হিসেবে বা বীর হিসেবে মেনে নিতে। আমি চিহ্নিত করেছিলাম যে সাম্প্রতিক বিশ্বে সামরিক বাহিনীতে, যুদ্ধ ও মৃত্যু উৎসবে যুক্ত নারীদের বীর বলে যারা বাহবা দিচ্ছেন তারা সাহস বা বীরত্ব ধারণাগুলোর অর্থ বিকৃত করে বুঝেছেন, ফলে কোন নারীটি আসলে বীর সেটা তারা ভুল জায়গায় খুঁজছেন। এই লেখায় আমি হাজির করবো মানুষের বাচ্চা পৃথিবীতে জন্মানোর কালে যারা সাহস করে নিজেদের হাতকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যাদের আমরা সাধারণভাবে দাই বা দাই মা বলে চিনি, তাদের কথায় ও কাজে কিভাবে সাহস ও বীরত্বের অর্থ ধরা দিয়েছে সেই দিকটি। এখানে আমি আবার দীর্ঘ সময়ের নারীবাদী আন্দোলনের অর্জনকে অপব্যবহার করে সুবিধাবাদী নারীদের জয়গান গাইবার সাম্প্রতিক ট্রেন্ডকে ধিক্কার জানাই। আর যেসব নারী দেখতে গরীব আর অসুন্দর আর বুড়ো বলে পত্রপত্রিকার নারীদিবসের বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদে অদৃশ্য থেকে গেছেন সেই সব সত্যিকারের বীর নারীদের সালাম জানাই।
প্রথমে, বর্ণনা করছি ২০০৩-৪ সালের দিকে বাংলাদেশের গরীব নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কমিশন করা এবং আইসিডিডিআরবি দ্বারা অপারেশনালাইজড একটি গবেষণা কাজের কথা। এ গবেষণা কাজে আমার অংশগ্রহণ খন্ডিত করা ছিল। গবেষণা সংস্থাগুলোতে নৃবিজ্ঞানীদের একটি বিশেষ কদর আছে গুণগত গবেষক হিসেবে অতএব আমাকে সেই পদেই নেয়া হয়। আমার কাজ ছিল প্রজনন স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল পারফর্ম করছে এমন একটি উপজেলার সাথে সবচেয়ে খারাপটির একটি তুলনামূলক স্টাডি করা। আমার কাজটি করার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল তিন মাস। প্রথম মাস বরাদ্দ করা হয় পুরো গবেষণা কাজটির প্রস্তাবনা বুঝতে এবং আমার কাছে কি চাওয়া হচ্ছে প্লাস ‘মাঠকর্ম’ করতে কোথায় যাবো, কাকে কি প্রশ্ন করবো আর উত্তরদাতাদের কাছে কিই বা জানতে চাইবো সে সব পরিষ্কার করতে। দ্বিতীয় মাস বরাদ্দ ছিল দুইটি “মাঠে” গিয়ে লোকজনের সাথে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎকার নেয়া এবং শেষ মাস “মাঠের তথ্য” গবেষণা দলনেতাকে রিপোর্ট করা। হেল্থ ইকোনোমিস্ট, ডেমোগ্রাফার, ডাক্তার, পরিসংখ্যানবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী নিয়ে গড়ে তোলা গবেষণা কাজটি আসলে কত ব্যপক, কত টাকা তার জন্য বরাদ্দ, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারনে গবেষণা কাজটি কি ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আমার সামগ্রিক ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু গবেষণা কাজটি করতে গিয়ে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ খটকা লেগেছিল। যেমন ১. এই গবেষণা কাজ করতে গিয়ে আমি সর্বপ্রথম “ট্র্যাডিশনাল বার্থ এটেনডেন্ট” (টিবিএ) বলে একটি টার্মের সাথে পরিচিত হই; বাংলাদেশে সাধারণভাবে যাদের দাই মা বা দাই ডাকা হয় টিবিএ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত “উন্নয়ন-গবেষণা ফার্ম” আবিষ্কৃত একটি টার্ম বলা যায়। ২. বাংলাদেশের ৯০% শিশু ভুমিষ্ট হয় বাড়ীতে আর বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার বেশ উঁচু এবং টিবিএরা মাতৃমৃত্যুর উচ্চ হারের জন্য দায়ী এরকম একটা তড়িৎ ও অতি সরলরৈখিক অনুমান বা সিদ্ধান্ত থেকে বাংলাদেশের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রায় সকল গবেষণা শুরু হয়।
এবারে উপরিল্লিখিত দু’টি খটকা নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমে লক্ষ্য করুন গ্রাম বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রেণীর নারীদের বাচ্চা ধরার কাজটির সাথে ঐতিহ্য ধারণাটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানে অমোঘ সত্য হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে দাইয়েরা কোন আধুনিক ও প্রশিক্ষিত পেশাদার মানুষ নয়। ঐতিহ্য মানে কি সেটা নিয়ে এসব গবেষণা মাঝে মাঝে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এবং সেখানে ঐতিহ্য বলতে দাইদের এমন কিছু আচার আচরনের কথা বলা হয়েছে যেগুলোকে ঐ গবেষকরা নিজেরাই আনহাইজেনিক এবং অনিরাপদ বলে বিচার করে বাতিল করে দিচ্ছে। আবার যেন প্রচ্ছন্নভাবে এসব গবেষণাগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান করতেও চায়। আসলে সম্মান না, গ্রামের “অশিক্ষিত”, “মূর্খ”, “কুসংস্কারাচ্ছন্ন” দাইয়েরা যে বাস্তবেই অনেক বাচ্চা ধরছে সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার নীতি নির্ধারকরা চাইলেও নাকচ করতে পারছে না।পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশের ৯০% শিশু ভুমিষ্ট হয় বাড়ীতে দাই এবং পরিবারের আত্মীয় নারী বা প্রতিবেশী নারীদের তত্ত্বাবধানে। এখন কথা উঠতে পারে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা পাবার মূল অধিকারটির। কিন্তু সেই রাস্তায় যাওয়া রাষ্ট্র ও তার নীতি নির্ধারকেদর উদ্দেশ্য নয়। তাই বাংলাদেশের সকল ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাতৃমৃত্যুর বিষয়টি দেখা এবং “ঐতিহ্যবাহী” বাচ্চা ধরনিদের ঘাড়ে মাতৃমৃত্যুর উচ্চ হারের দোষটি চাপানো এসব ফরমায়েশী গবেষণার একটি হীন উদ্দেশ্য। নৃবিজ্ঞানী তানিয়া মুরে লী এরকমই আভাস দেন। তিনি বলেন “উন্নয়ন গবেষণায়” আগে থেকেই ঠিক করা থাকে উন্নয়নের পরামর্শ আর তাই গবেষণার প্রশ্ন, বিশ্লেষণ ও ফলাফলকেও সাজানো হয় সেই ফ্রেইমে। এভাবেই বেশীরভাগ গবেষণা কাজ চলছে। ফাঁকতালে বাচ্চা ধরনিরা বীরের বদলে হচ্ছে খলনায়ক।
দ্বিতীয় যে গবেষণা অভিজ্ঞতাটির কথা উল্লেখ করবো সেটা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাত্রীবিদ্যায় মাস্টার্স প্রোগ্রামের পরিচালক লরা জেইডেসস্টেইনের দীর্ঘ মেয়াদী একটি এথনোগ্রাফিক গবেষণা কাজ। শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষক নিজেও বাচ্চা ধরার কাজ করে থাকেন। ২০১১ সালে আমি তার কাজের একটি পর্বে সামান্য অনুবাদক হিসেবে সঙ্গী ছিলাম। তার গবেষণার উদ্দেশ্য বিদ্যাজাগতিক। তিনি আমেরিকা বেশী আধুনিক না বাংলাদেশের ধাত্রীরা বেশী ঐতিহ্যবাহী এসব বিচারে না গিয়ে বাংলাদেশের সাভার ও ধামরাই এলাকায় দীর্ঘ (এবং স্বল্প) সময় ধরে দাইয়ের কাজ করছেন এমন নারীদের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার পদ্ধতিতে তার গবেষণা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। আমি এখানে তাঁর গবেষণার সার্বিক মূল্যায়নে যাচ্ছি না। আগ্রহীরা তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে নিতে পারেন। আমি এখানে পাঠকের সাথে আলাপ করতে চাই দাইদের সাথে সাক্ষাৎকারে সাহস ও বীরত্ব ধারণাগুলো নিয়ে আমার একান্ত যে উপলব্ধি অর্জন হল সেটা নিয়ে।
আমাদের আলাপে একটা সাধারণ জিজ্ঞাসা ছিল কিভাবে একজন নারী দাই হলেন সেই শুরুটা জানা। সকল নারীই তো আর দাই এর কাজে এগিয়ে আসে না বা একজন দাইয়ের সকল কণ্যা বা পুত্র বধূও দাই হয় না। তাহলে, দাই হতে কি গুণটি থাকতে হয়- এটা ছিল আমার নিজের একটা জিজ্ঞাসা। কে কিভাবে দাইয়ের কাজ শুরু করলেন এই প্রশ্নের উত্তরে একেক জন একেক রকম গল্প বললেন ঠিকই কিন্তু সাহসিকতা বিষয় নিয়ে তাদের উত্তরে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।
যেমন, ১. একজন বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করতে সাহস করে এগিয়ে যাওয়া। অথবা সাহসী বলে আগে থেকেই প্রতিবেশী বা পরিবারে কদর থাকায় বিপদে দিশাহারা অন্যদের কাছ থেকে ডাক আসা। ২. উপস্থিত বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী বিপদ মোকাবেলায় এগিয়ে যাওয়া। বেশীরভাগ উত্তর দাতাই উল্লেখ করেছেন যে গভীর রাতে অপ্রস্তুতভাবে তাদের প্রথম কাজে ডাক পড়েছিল যেমন, কখনও দেখা গেছে নির্দিষ্ট দাই আসতে দেরী হচ্ছে কিন্তু প্রসূতি মায়ের পানি ভেঙ্গে গেছে বা বাচ্চা বের হতে শুরু করেছে ইত্যাদি জরুরী অবস্থা যখন ভয় না পেয়ে সাহস করে হাত লাগানো ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই ৩. একটা মানুষের বাঁচা-মরা তার হাতে এই মানসিক চাপ সহ্য করে ঠান্ডা মাথায় প্রসবের মত ধীরলয়ের একটি প্রক্রিয়া নজরদারি করে একটি শিশুকে “বাচ্চার ঘর” (জরায়ু) থেকে পৃথিবীতে আসতে নিজের হাতকে এগিয়ে দেয়া ৪. আতংকগ্রস্ত ও প্রসব বেদনায় তড়পানো এক নারীর মনে সাহস যোগানো ও শিশুটি জন্মানোর পর মায়ের ও তার পরিবারের অন্যদের সাথে আনন্দ কিংবা বেদনার ভাগিদার হওয়া ৫. প্রসূতির পেশাব, পায়খানা, রক্ত সব কিছুকে উপেক্ষা করে নিজের কর্তব্য পালন করা।
উপরে যে নারীদের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ উল্লেখ করলাম এরা আমাদের দেশের মেজরিটি। এরা “আমি পেশাদার ধাত্রী” বলে কোন দোকান খুলে বসে নেই কোথাও। রাষ্ট্র এদের জন্য কিছু টেকনিকাল প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয় কিন্তু এদের মূল শক্তি আসলে এদের অন্তরের সাহস। এরা কেউ কৃষক বাড়ির গেরস্থালী সামলায়, গরু পালে, হাঁস পালে। কেউ কেউ নিজেদের গরু-ছাগলের বাচ্চাও হওয়ায়। কেউ নিতান্তই ক্ষেত মজুর বা দিনমজুর বা ছোট ব্যবসায়ী বা দোকানদার বা ফেরিওয়ালার বউ যারা নিজ নিজ সংসার সামলানোয় রাতদিন ছুটোছুটির মধ্যে থাকে কিন্তু কোন বাড়ীতে বাচ্চা ধরতে হবে শুনলেই সব ফেলে ছুটে যায়। কেন? টাকা পয়সা তো বেশী পাওয়া যায় না এ’কাজে। তাছাড়া পয়সা ওয়ালারা তো বাচ্চা হওয়াতে হাসাপাতালেই যায়। দাইদের সেবা নেয় গরীব মানুষ, অভাবী মানুষ যাদের নিজেদেরই টাকা নেই। কিসের টানে তাহলে তারা যান এরকম প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন এটা যেন একটা এ্যাডভেঞ্চারের ডাক বা এসেছে যেন নতুন কোন চ্যালেঞ্জ, যেন বা উপরওয়ালার কোন ইশারা।
পরিশেষে, দুটি প্রসব কেইসে নিজে উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আমার ভেতরে যে আবেগের সঞ্চার হয়েছিল সেটা বলবো। দাই হওয়া যে চাট্টিখানি কথা নয় এটা মেনে নিতে এই আবেগও আমাকে সাহায্য করেছিল। দুটো কেইসই বাড়ীতে প্রসব হবার কেইস। যদিও হাসপাতালের খুব কাছাকাছি ছিল বাড়িগুলো এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাথে যুক্ত দাই এবং অপেক্ষমান এ্যাম্বুলেন্স তৈরী ছিল তারপরও একটিতে আমি প্রসব বেদনায় কাতরানো নারীর চিৎকারে পুরোটা সময় আতংকিত হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছি আর উপর ওয়ালার (যদি তিনি থেকে থাকেন) কাছে প্রার্থনা করেছি যেন কোন খারাপ খবরের ভাগিদার আমার হতে না হয়। অপরটিতে অতি টেনশনে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যখন বাচ্চা হওয়ার আসল ক্লাইমেক্স ঘটছিল। পরে ভেবেছি যে নিজেকে কত এ্যাডভেঞ্চার আর চ্যালেঞ্জের মুখেই না ফেলেছি কিন্তু বাচ্চা ধরার এ্যাডভেঞ্চার আর চ্যালেঞ্জের সাথে তুলনা অন্যগুলোর সাথে চলে না।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply