আহমেদ শামীম
ঘরে সঙ্ঘটিত নারীর ওপর নির্যাতন তবু মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছে, কিন্তু বাইরে সঙ্ঘটিত নারী ওপর নির্যাতনকে প্রায় সর্বদাই এড়িয়ে যাওয়া হয়- এই সত্য আমরা সবাই জানি, তবু নারীর অধিকার তথা মানবধিকার নিয়ে কাজ করে এমনসব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জরিপে উঠে আসা চিত্রকে জাতিসঙ্ঘ এভাবেই তুলে ধরেছে। বিশ্বজুড়েই এই অবস্থা: রাস্তায়, জনপরিবহনে, বিপণী বিতানে, পার্কে, উৎসবে জনসমাগমে পুরুষ একা কিংবা দলগতভাবে যুগপৎ নারী-বিদ্বেষ আর যৌন-লিপ্সা থেকে নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশে দেখছি এই বিষয়টিকে ঠিকঠাক সনাক্ত করতেও পারিনি আমরা।
নববর্ষের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ২৫-৩০ জন পুরুষের একটি দল একাধিক নারীর ওপর একই কায়দায় যৌন ও শারীরিক আক্রমণ চালালো; আক্রমণের শিকার নারীদের আর্ত চিৎকার যাতে কেউ শুনতে না পায় সে উদ্দেশ্য তাদের ঘিরে ধরে উচ্চস্বরে ভুভুজেলা বাজালো; সেসব জায়গায় পুলিস থাকলেও তারা কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকল; ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মী একটি ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ ছয়জনকে আক্রমণকারীকে ধরে পুলিসে দিলেও, পুলিস তাদের ছেড়ে দিল; ওই ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে এ ব্যাপারে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানালে প্রক্টরের এক পাও আগালেন না। ঘটনাস্থলে গেলেন না, দাবা খেললেন, বললেন, “আমি গিয়েই বা কী করতে পারতাম।”
এ কথাগুলো জনশ্রুতি নয়, ছাত্র ইউনিয়নের লিটন নন্দী, যে ওই আক্রান্ত মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার জবানেই আমরা জানি। লিটন এও ইঙ্গিত করলেন, বহিরাগতরা এই ঘটনা ঘটায়নি। এতো কিছুরপর জাতীয় পত্রিকাগুলো কীভাবে নিউজ করল এই ঘটনার? ২৫-৩০ জন সঙ্ঘবদ্ধ পুরুষ একাধিক নারীকে বিবস্ত্র করল, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করল (লিটনের বয়ান অনুসারে), আর সেই ঘটনাগুলো সম্পর্কে কেউ লিখল “যৌন হয়রানি”, কেউ লিখল “শ্লীলতাহানি”, “যৌন হেনস্থা” আবার কেউ লিখল “নারী লাঞ্ছিত”। তো ভুল কী হল এতে? আমি বলব ভুল নয়, অপরাধের সঙ্গী হওয়া হয় এমন ভাষা ব্যবহার করাতে।
এই হয়রানি, হেনস্তা, লাঞ্ছনা এগুলোর মানে ঘটনার গুরুত্ব, ভয়াবহতা, আর অপরাধের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের খুব ভুল একটা ধারণা দেয়। এই ভাষাগুলো এমনি এমনি আসেনি। এগুলো তৈরি করেছে আমাদের ধারণা আর অভিসন্ধির জগত। আমরা ধারণা করি, বাইরে নারী বেরুলে আর তার ধর্ষণ হলেতো সে ধর্ষিত, আর সে পর্যন্ত না হলে বাকি আর যা কিছু হবে তা তার জন্য “যৌন হয়রানি/হেনস্তা” কিংবা লাঞ্ছনা বা শ্লীলতাহানির ব্যাপার। এর মধ্যে যেন মনোদৈহিক নির্যাতনের বালাই নেই, নিপীড়নের ব্যাপার নেই; এর মধ্যে নারীর প্রতি বিদ্বেষ আর নারী পুরুষের বিবিধ বৈষম্যের প্রশ্রয় যেন নেই। এ যেন কেবল কিছু “কুত্তার বাচ্চা”, “শুয়োরের বাচ্চা”র “মাল মাথায় উঠে যাওয়া”র ফল।
এরচে একটু এগিয়ে কেউ কেউ আবার ধর্মকে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকেও সুযোগমত জড়িয়ে ফেলেন। নারীর বেপর্দা হওয়াকে দায়ী করেন কেউ, কেউ রক্ষণশীল পুরুষদের দিকে আঙ্গুল তোলেন। আবার কেউ তোলেন “অশিক্ষিত” পুরুষদের প্রতি। যার অভিসন্ধি যেদিকে, সে দিকেই আমাদের ধারণা ধাবিত হয়। অথচ যেন যে দেশে ইসলাম নেই সে দেশে ধর্ষণ হয় না, যৌন নির্যাতন হয় না; যেখানে শিক্ষিত পুরুষের অভাব নেই সেখানে যেন এগুলির খুব অভাব; আবার, পর্দাপুশিদার দেশে যেন এগুলো হারাম, নাই বললেই চলে। সর্বোপরি এর সঙ্গে যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণের কোন বিষয় নেই।
কিন্তু বিশ্বের এত বৈচিত্র্যের মধ্যে নারীর প্রতি পুরুষের বিদ্বেষ আর বিকারগ্রস্থ লিপ্সার আকারে সাদৃশ্য দেখা যায়- এ বাবদে বলতে পারি যেগুলোর সংযোগ নেই বলে ধারণা করি, সেইগুলোই সবচে বেশি করে আছে। আমাদের পুরুষ-ধারণা এবং তা থেকে জাত ভাষা বারবার তার সঠিক চিত্র আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমরাও অগভীর ভাব মোক্ষণ করছি গালাগালে; তাৎক্ষনিক ক্ষোভ ঝেড়ে হাল্কা করছি মন। কিন্তু এসবের গোড়া ধনতন্ত্রের কেউ হাত দিচ্ছি না। এই ধনে এসে মিলিত হয়েছে, পুরুষতন্ত্র আর পুঁজি। নারীর প্রতি পুরুষের আধুনিক এই বিদ্বেষ আর বিকার ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের ফল- এ কথা একবার ভেবেও আবার নানা কথায় খেই হারিয়ে ফেলছি বারবার। না রকম যুক্তি তর্কে গিয়ে ওই ধনে হাত দেওয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি যেন সবাই।
তো কার ধনে পোদ্দারি করছে ওই পুলিস, প্রক্টর, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহিরাগত যৌন নিপীড়করা? রাষ্ট্রের? কিন্তু নিন্দুকেরা যে বলে, রাষ্ট্রের ধন নাকি তার সম্মিলিত সামরিক বাহিনী। তারই প্রতীক থাকে ট্যাঙ্কের উত্থিত নলে, এঙ্গেলে খাড়া হয়ে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র সকলে, সৈনিকের রাইফেলে, ন্যূনতম হলেও অফিসারের কোমরের পিস্তলে। কিন্তু তাদেরতো কাম নেই সমতলে। তো, পাহাড়ের মত করে এই ধাক্কাটা আসছে কোত্থেকে? সেই প্রশ্নের উত্তরে ওই নিন্দুকরাই বলে থাকে, এ নাকি শাসকশ্রেণিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শাসক ক্ষমতাকে যতই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবে, তার সব সরকারি আর বেসরকারি বাহিনী ক্ষমতাবান হবে। সেই ক্ষমতার ওপর কেন্দ্রের ক্ষমতাও থাকবে না এক পর্যায়ে। ওই পুলিস, প্রক্টর, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহিরাগত যৌন নিপীড়করা আর রাষ্ট্র- কে কার ধনে পোদ্দারি করছে তা আর আলাদা করে বলা যাবে না। কেবল নির্যাতিত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।
অনেকেই অবশ্য ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলেন; আশার কথা বলেন; ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কাজ করেন। আমি তাদের লাল সালাম জানাই; সংগে জানাই সংহতি। যদিও শাসকশ্রেণির ক্ষমতার অপকর্মরত হাত ভাঙতে গিয়ে তাদেরই হাত আজ ভেঙ্গে গেছে, তবু কফিলের একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া উঠে দাঁড়ানোর গানে বিশ্বাস রাখি। আর একজন সিরিয়াস পাঠক হিসেবে আমাদের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোকে আহ্বান করি: আসুন রাজু ভাস্কর্যের প্রাঙ্গণে, টিএসসিতে নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার সংহতি সমাবেশে- শুনুন আর প্রকাশ করুন আমাদের ভাষ্য। শাসক তোষণ করা গদ্যের গৎ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসুন, বাছবিচার করে করুন ভাষার ব্যবহার।
আহমেদ শামীম, শিক্ষক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বর্তমানে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করছেন।
Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply