হাবিবা নওরোজ
” ‘Mob’ মনে মনে গাড়ির ভিতরকার এই নারীদের বিবস্ত্র করে; তাঁদের স্তন, তাঁদের পা স্পর্শ করে দেখে। অন্নপুষ্ট, টানটান চিক্কণ নগ্ন নারীদেহ কল্পনা করে ‘Mob’ পরম পুলকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে;…’Mob’ একজন নারীকে চায়। তাঁর পাশ দিয়ে এই যে সুন্দরীদের মজবুত, ছিপছিপে শরীরগুলো একের পর এক ঝলক দিয়ে চলে যাচ্ছে তা দেখে তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করে, তাঁর লোভাতুর দৃষ্টি তাঁদের লেহন করে।” ম্যাক্সিম গোর্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমনের পর “পীত দানবের পুরী” তে মবের এমন বর্ণনা দিয়েছেন। ম্যাক্সিম গোর্কি নারীবাদী লেখক নন কিন্তু একজন দক্ষ লেখকের মত তিনি একটি জরুরী বিষয়ে ইংগিত করেছেন। তিনি যদি নারীর অভিজ্ঞতার আলোকে “মব” লিখতেন তবে তাকে হয়তো এই লেখায় মব(এখানে নিম্নবিত্ত, শোষিত পুরুষ) কিভাবে নারীকে(উচ্চবিত্ত) পাবলিক পরিসরে যৌন নির্যাতন করে সেই ব্যাখ্যার প্রবক্তা হিসেবে চিনতাম।
দলবদ্ধ, একাকী পুরুষ কেন নারীর উপরে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ঘটায় তাঁর যথার্থ ব্যাখ্যার জন্য আমাদের ১৯৭০–৮৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় যখন যৌন হয়রানী, ধর্ষণ এই ধারনাগুলোর নারীবাদী আবিষ্কার ঘটে। সেই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী তাত্ত্বিক সুজান ব্রাউন মিলারের মতে গনধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণে পুরুষের ধর্ষণের মতাদর্শ সবচাইতে প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়। তাঁর মতে পুরুষের কাছে একক ধর্ষণ যেখানে একক নারীর উপর বিজয়ের সমার্থক, দলবদ্ধ ধর্ষণ একজন নারীর উপর সমগ্র পুরুষ জাতির বিজয়। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের গন ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন একজন নারীর উপর নৃশংসতার সাথে যৌন নির্যাতন দলের ভেতরে নিজেদের বীরত্ব(/ব্যাটাগিরি) প্রদর্শনের একটি পদ্ধতির মত। দলবদ্ধ ধর্ষণ সহিংস ব্যাটাগিরির মাধ্যমে পুরুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রকাশের একটি উপায়। দলবদ্ধ ধর্ষণে নারী ও পুরুষের সংখ্যাসুচক তফাৎ একজন নারীর বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে পুরুষের নৃশংসতার ইচ্ছার প্রমান। এটা আরও প্রমান করে ধর্ষণের বাইরেও আরো গভীরভাবে নারীকে অপমান করার ইচ্ছা।
পহেলা বৈশাখে ঘটা দলবদ্ধ যৌন নির্যাতন সেই একই উপায়ে নারীর উপর সহিংসতা প্রদর্শনের মাধ্যমে পুরুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করা, সাথে সাথে অধস্তন নারীকে প্রচ্ছন্নভাবে অপমান করে নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করা। অ্যালিসন এম থমাসের গবেষণায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জানায় মেয়েদের দেখে শিস বাজানো “এমন একটা কাজ যা ছেলেরা করে অন্য ছেলেদের মুগ্ধ করার জন্য“। তাঁর মতে “লিঙ্গবাদও পুরুষের (নিজেদের মধ্যে) বন্ধনে আবদ্ধ হবার একটি দিক” ক্যালিফোর্নিয়ার মনোবিজ্ঞানী ডাব্লিউ এইচ ব্লানকার্ড একটি দলবদ্ধ ধর্ষকদের উপর গবেষণা করেন। হ্যারি নামের অভিযুক্ত তাঁর দল নেতা কিথের হয়রানীমুলক আচরন সম্পর্কে বলে “কিথের সাথে থাকলে তোমাকে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে ওর ছোট খাট স্টান্ট গুলো…এটা আমার সাহস তৈরি করতো…” ব্রাউনমিলারও তাঁর বইতে বলেছিলেন তিনি নিউ ইয়র্ক শহরের সাবওয়েতে এমন অনেক অল্পবয়স্ক ছেলেদের দেখেছেন যারা কিথ এর মত ‘নেতা‘। এবং দলের অন্য ছেলেদের চোখে তিনি ‘নেতার‘ সহিংসতার প্রেক্ষিতে সন্মান এবং আতঙ্ক দেখেছেন। ব্রাউনমিলার সহ আরও অনেকের মতেই যৌন হয়রানীর সহ অন্যান্য সহিংসতার চর্চা অল্পবয়েসি ছেলেদের পুরুষ হয়ে ওঠবার একটি প্রক্রিয়া।
দহন সিনেমায় ধর্ষিত স্ত্রীর সন্মান রক্ষায় ব্যর্থ পুরুষ(স্বামী) তাঁর পৌরুষের মর্যাদা ফিরে পাবার জন্য ধর্ষিতা স্ত্রীকে আবার ধর্ষণ করেন। অর্থাৎ সঙ্গমের মধ্যে নারীর শরীরের উপর পুরুষের উথিত লিঙ্গের যে জয়, বীরত্ব তা নারীর ইচ্ছা, অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে পুনপ্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে পুরুষ তাঁর বীরত্ব/পৌরুষ ফিরে পায়। কিন্তু এ তো কেবল মাইক্রো পলিটিকস বা ব্যক্তিগত/সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লৈঙ্গীক রাজনীতি, যাতে দলবদ্ধ ভাবে পুরুষ দুর্বল জাত হিসেবে নারীকে যৌন হয়রানী করে বীরত্ব দেখাতে চায়; অনুগামী পুরুষের কাছে এবং অধস্তন নারীর কাছে।
যখন নারী প্রশ্ন কোন বৃহৎ পরিসরে মূলধারার রাজনীতি বা পুরুষের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত তখন নারী ইস্যুর এক ভিন্ন রাজনীতি আছে। আমাদের দেশে নারীকে এনজিও গবেষণাগুলোতে যেমন একটা প্যারা বা কয়েকটা লাইনে সীমাবদ্ধ করা হত তেমনি জাতীও ইস্যু বা রাজনীতিতে নারীকে একটা আইটেম বা অনেক ইস্যুর একটা হিসেবেই এখনো আনা হয়। কয়েকদিন আগে পহেলা বৈশাখে দলবদ্ধ যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হওয়া পাবলিক সমাবেশে উত্তর ও দক্ষিণের দুজন মেয়র প্রার্থীকে আসতে দেখে এক সাবেক কর্মী কে মন্তব্য করতে শুনি যে এত জমায়েত কেন করছে বুঝতে পারস? এটাকে ব্যবহার করতে চায় নির্বাচনী প্রচারনায়!
নারীকে নিষ্ক্রিয় এজেন্ট এই ভাবনার প্রতিফলন দেখি ঘটনার কিছু পরে যখন অনলাইন বাংলা নামের এক নিউজ পোর্টাল “বস্ত্রহরণ করল ছাত্রলীগ আর পাঞ্জাবি জড়িয়ে ইজ্জত রক্ষা ছাত্র ইউনিয়নের” শিরোনামে খবর দেখা যায়। যেন একদল পুরুষ হোল যৌন নিপীড়ক, ধর্ষক আরেকদল পুরুষ হোল নারীর রক্ষাকর্তা বীর। সহিংসতার শিকার যে নারী সে এখানে ইজ্জতের ভারে ভারাক্রান্ত এক নিস্ক্রিয়, অদৃশ্য বর্গ ছাড়া কিছুই না, যার ইজ্জত যেমন হরন করে ধর্ষক, যৌন নিপীড়ক হওয়া যায় তেমনি ইজ্জত বাঁচিয়ে বীরও হওয়া যায় সহজেই। আর নারীর ইজ্জত এমনি এক বিষয় যা ফুটবলের মত দুই দলের পুরুষের লথির উপর নির্ভর করে নানান দিকে ঘুরতে পারে, যার হরণের ভার আর রক্ষা দুইই পুরুষের হাতে। নারীর এই ইজ্জতের ধারনা পুরানো। একাত্তরে দুইলক্ষ মা–বোন সম্ভ্রমহানী বা ইজ্জত হারিয়েছেন এমন আজো বলা হয়। তাকে যুদ্ধ, ইতিহাসের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে না, দেখা হয় ইজ্জতের ভারে বিড়ম্বিত একটি গোষ্ঠী হিসেবে যার যুদ্ধের সবচাইতে বড় ক্ষতি ছিল ইজ্জত হারানো। যৌন হয়রানী, ধর্ষণ বিষয়ে আলোচনা গণমাধ্যমে আজো নারীর সেই সহজেই লুট যোগ্য শ্লীলতা, ইজ্জত, সম্ভ্রমের ধারনার সাথে জড়িত যা হরণ করে জাতীয় শত্রু আর রক্ষা করে জাতীয় বীরও হয়ে ওঠা যায়। এটা যে সকল নারীর বিরুদ্ধে জাত হিসেবে পুরুষের সংঘবদ্ধ অপরাধ, সকল ধরনের প্রাইভেট, পাবলিক পরিসরে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহনের, ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে পুরুষতান্ত্রিক হুশিয়ারি তার দিক আলো ফেলার কোন লক্ষণই কোন গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায়নি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম একই বিষয়ে এত এত খবরের মধ্যে একজন সাংবাদিকও দ্বায় বোধ করেনি আক্রান্ত নারীর অভিজ্ঞতা জানার। বুঝলাম তাঁদের খুঁজে পাওয়া সম্ভবনা, অনুমান করি আক্রান্ত নারীও এই উগ্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সত্য বলে আরও কয়েক দফা হয়রানীর শিকার হতে চাইবেন্না। কিন্তু রোকেয়া হলের সেই মেয়েগুলো (অথবা অন্য যারাই হোক)? যারা হয়রানীর শিকার নারীকে সাহায্য করেছিলেন বলে লিটন নন্দী দাবি করেছেন? তাঁদের মতামত কি জানা যেত না? নানান বর্গের পুরুষকে ধর্ষক, যৌন নিপীড়ক আখ্যা দেয়া আর কোন কোন বর্গের পুরুষকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়ার হুজুগে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে নারীর কথা যারা পরুষের সংঘবদ্ধ যৌন সহিংসার প্রধান টার্গেট। তাঁর সত্য জানার জন্য কি আমাদের আরও চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে? যেমন মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নারীর কথা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে? বোধয় আমরা অপেক্ষা করতেই থাকবো যতদিন না কোন নারীবাদী গবেষক তাকে পুরুষের ইতিহাসের কবর খুঁড়ে আবিষ্কার করে। তাঁর আগ পর্যন্ত যৌন হয়রানী, ধর্ষণের শিকার নারীকে সক্রিয় সত্ত্বা না ইজ্জত, সম্ভ্রম, শ্লীলতার মোড়কেই অসহায়ত্বের প্রিতিরুপ হিসেবে হাজির হতে দেখবো হয়তো।
মুক্তি যোদ্ধার জাতীয় বীর হিসেবে যে ভাবমূর্তি আজকে জনমানসে তৈরি করা হয়েছে একটি তথ্যের আঘাতে সে ভাবমূর্তি আজ আক্রান্ত হতে পারে। ব্রাউনমিলারের তথ্য মতে “নিয়ম শৃঙ্খলার সাধারণ ভেঙ্গে পড়াতে, মুক্তিবাহিনী নিজেরাই ধর্ষণ করেছে,” মার্কিন গবেষক ইয়াসমিন সায়কিয়ার গবেষণা অনুযায়ী “…মুক্তিবাহিনীর কোন কোন সদস্যও নির্যাতন করে। একটি ঘটনায় এরা ধরা পড়ে যায় এবং গ্রামের মানুষ এদের বিচারের ব্যাবস্থা করে। তবে এই রকম ধর্ষণের উদাহরন খুবি কম… বাঙ্গালী নারীর উপর বাঙ্গালী যোদ্ধা বা রাজনৈতিক কর্মীর (ধর্ষণের)উদাহরন পাওয়া গেছে।” আজকের প্রেক্ষাপটে কিছু মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যায় অল্প হলেও ধর্ষণ করেছে এই তথ্য হাজির করলে জামাতি, শিবির ইত্যাদি নামে সম্ভাষিত হবার সম্ভাবনা শতভাগ। এবং এর মাধ্যমে যে কেউ পরিনত হতে পারে জাতীয় শত্রুতে। কিন্তু আমার মতে ব্রাউন মিলারের মত আমাদের যা বুঝতে হবে তা হোল ধর্ষণ, যৌন সহিংসা বিশেষভাবে নারীর বিরুদ্ধে করা পুরুষের সংগঠিত অপরাধ। এই সত্য বিশেষভাবে নারী যত স্পষ্টভাবে, যত দ্রুত উপলব্ধি করবে তত দ্রুত সে সংগঠিত হতে পারবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
হাবিবা নওরোজ একজন আলোকচিত্রী
তথ্যসুত্রঃ
১) Against Our Will, Men Women And Rape, Susan Brownmiller
২) প্রবল ও প্রান্তিক ২, মুক্তিযুদ্ধের HIS-STORY ইজ্জত ও লজ্জা, সায়েমা খাতুন
৩) পীত দানবের পুরী, গোর্কির চোখে মার্কিন মুলুক, ম্যাক্সিম গোর্কি
৪) SEXUAL HARASSMENT, Contemporary Feminist Perspective, Edited By ALISON M. THOMAS and CELIA KITZINGER
৫) পথে বিপদেঃ মেয়েদের নিরাপত্তা, লেখা ভাস্বতী চক্রবর্তী, ছবি সমীর কুমার দত্ত
৬) “বস্ত্রহরণ করল ছাত্রলীগ আর পাঞ্জাবি জড়িয়ে ইজ্জত রক্ষা ছাত্র ইউনিয়নের”
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
কঠিন ভাষায় লেখা কিন্তু কাদের জন্য ? টাকা এবং পেশীশক্তির কাছে সব তুচ্ছ । হয়তো এ ঘটনায় আক্রান্তরা বাসায় যেয়ে বাবা ,ভাই নামক আরেকজন পুরুষর হাতে মার খেয়ে তঅবা করেছে এরকম দিনে আর বের হবে না ।