শামীমা বিনতে রহমান
[অতিথি ব্লগার]
এই যে এতরকমের লোক দেখা যায়, বেটা লোক বা পুরুষ লোক- রাস্তায়, অফিসে, গলিতে, বাসায়, টেলিভিশনে, মন্ত্রণালয়ে, মেলায়, উৎসবে, সমাবেশে, গণপিটুনিতে, যৌন সন্ত্রাসে-এরা ক্যামন লোক? ক্যামন পুরুষ? ওদের রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়, কারো উঁচু পেট, সমান পেট, নিচু পাছা, বেল্ট থেকে পাছার দিকে উঁকি দেয়া কার্ভ, লম্বা-খাটো, লুঙ্গি পরা, প্যান্ট পরা, বড় চুল, ছোট চুল-কত্ত রকমের পুরুষ রোজ দেখা যায়, পুরুষগুলাও দেখে নারীদের। এইসব দেখাদেখির মধ্যেই ঘটে যায় সহনীয় অসনীয় যৌন সন্ত্রাস।
রাস্তা ঘাটের যৌন হয়রানির ঘটনার অভিজ্ঞতা নাই, আমার ধারণা দেশে এরকম নারীর সংখ্যা হাতে গোনা, আমার বিশ্বাস নাই আসলে। বাসে বা রাস্তায় হাঁটতে বা অটোঅলা অর্থাৎ যত রকমের অলারা রাস্তায় চলাফেরা করেন, তাদের সাথে; অফিসে, কাজ করার স্পটে-সবখানেই যৌন হয়রানি, শরীরের ওপর দিয়া অথবা মনের ওপর দিয়া। আলাপে আড্ডায় এই পুরুষরা খারাপ, জঘন্য পুরুষ হিসাবে পরিচিত অন্য পুরুষ এবং নারীর কাছে।একবার শাহবাগ থেকে বাসায় ফেরার জন্য বাসে উঠা মাত্র বাসের হেল্পারের শরীরে হাত দিয়ে ধরে উঠানোতে চাপ দেয়ার অপরাধে তারে নিয়া বাস থেকে নাইমা চড়াইসিলাম আর গালি দিসিলাম শুয়রের বাচ্চা বইলা। সব ঘটনা থেমে যাবার পর আমার মনে হৈসিল, শুয়োরের বাচ্চা ক্যান বল্লাম? আমি তো শুয়োর খাই। অনেক ভাইবা বুঝছি, সেই ছোটকাল থেকে খারাপ জঘন্য কিছু রাগের সাথে বুঝাইতে শুয়োরের বাচ্চা গালিটা্ যথার্থ বলে শিখসিলাম, যুক্তি ছাড়া। এইটা মনের মধ্যে এইরকমভাবে গাঁথার কারণই হৈল আমার সংস্কৃতি আমাকে রাগ, ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা শিখাইছে, একটা প্রাণীর সঙ্গে তুলনা দিয়া, যেমন: কুত্তার বাচ্চা-হুদাই, অযথাই।
ক্রেইগ স্টিভ নামে একজন অধ্যাপক আছেন নর্থ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের “রেডিও টেলিভিশন এবং ফিল্ম” বিভাগের।তিনি তার “ম্যান, ম্যাসকুলিনিটি অ্যাণ্ড মিডিয়া” বইয়ে লেখেন, “পুরুষালি বা ম্যাসকুলিনিটি হৈল, একটা সংস্কৃতি এর পুরুষদের কাছে যা চায়, তাই”। আ্যামেরিকা, যেই দেশটা এখনকার পাশ্চাত্য সভ্যতার হাই রাইজিংয়ে আছে, সেই সংস্কৃতির পুরুষ এবং পুরুষালি নিয়ে বই ম্যান, ম্যাসকুলিনিটি অ্যাণ্ড দ্য মিডিয়া (১৯৯২) বইতে তিনি বুঝান ম্যাসকুলিনিটি কীভাবে সমাজে আসলে চাহিদা হয়ে ওঠে।
“উত্তর আ্যামেরিকার সংস্কৃতিতে ম্যাসকুলিনিটির প্রচলিত মানে হলো, পিতৃতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া এবং এতে অংশ নেয়া। এতে প্রচলিত ম্যাসকুলিন বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রকাশ করা বা দেখানোর জন্য পুরুষদের শিখিয়ে চাঙ্গা করা হয়, যেন এ সবকিছুই সঠিক এমন মনে হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলা এমনই সঠিক যে “নারীর ওপর কতৃর্ত্ব করা এবং তাকে ব্যবহার করা এবং অন্য পুরুষদের ব্যবহার করার বিষয়টি শুধু সেই সমাজে প্রত্যাশিতই না, এটা আসলে চাহিদা”।
ক্রেইগকে এখানে টেনে আনলাম, কারণ পাশ্চাত্য, প্রাচ্য যাই-ই বলি না কেন, নারীর ওপর কতৃত্ব করা এবং তাকে ব্যবহার করা, এইটা এই সংস্কৃতিরও চাহিদা, এই বাঙ্গালির সংস্কৃতির চাহিদা। এই সংস্কৃতি, এই সমাজ আসলে কি চায় পুরুষদের কাছ থেকে, কীভাবে দেখতে চায় তার পুরুষদের, সেই পুরুষরা কী ভঙ্গীতে নারীকে দেখে- এসব কিছুর কনস্ট্রাকশন বা গঠন তৈরি হয় এই সংস্কৃতির ‘ভালো’ আর ‘খারাপ’, ‘সঠিক’, অনুচিৎ-এসব ধারণা তৈরির মধ্য দিয়ে।
এই পয়লা বৈশাখে বিভিন্ন বয়সী নারীদের ওপর সংঘবদ্ধ যৌনসন্ত্রাসের ঘটনায় এখন এখানে-সেখানে আলাপ চলছে, “সত্যিকারের পুরুষ কখনো এইরকম জঘন্য কাজ করতে পারে না”, “যারা এই কাম করছে, এইগুলা ব্যাডাও না, ব্যাডার জাতও না” এরকম আলাপ চলছে।এই বলাবলি করনেঅলাদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী দুই জেণ্ডারই আছেন। যদিও এই ঘটনায় কিছু ‘হিরো’ পুরুষ চরিত্র ক্যানভাসে উঠে এসেছে, তারা যৌন সন্ত্রাসী পুরুষদের রুখেছেন।এখন এই সত্যিকারের পুরুষ বা আসল পুরুষ কারা এই সমাজে?
জন্মের পর বড় হতে হতে শিশু মেয়েটি আর শিশু ছেলেটি একই ছাদের তলায়, একই মা-বাবার আদরে যত্নে দুই ধরনের “সেন্স অফ অউনারশিপ” নিয়ে বড় হয়। ছেলেটা বড় হয়, সম্পত্তি, বুড়া বাবা-মা এবং একটি স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের বড় করার প্রধান দায়িত্ব তার। এরমধ্যে বউও ছুটে যেতে পারবে না, যদিও তার পরকীয়া প্রেম থেকে থাকে। আর মেয়েটি বড় হয় এইটা আসলে মায়ের সংসার। সে বিয়ে করবে, অন্য একটি সংসারে যাবে, সেখানটাই তার দীর্ঘ যাত্রার যাপন স্থান, যদি স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি নির্যাতনও করে বা স্বামীর পরকীয়া থেকেও থাকে, তবুও আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কারণ আসল নারীর সংসার ভাঙ্গে না।মানে সমাজ এইভাবে অ্যনাটমিক্যাল পুরুষের ভেতরে সামাজের প্রতিষ্ঠানগুলার সাথে চেইন সম্পর্ক তৈরি করে। নারীকে দেখার ভঙ্গি তৈরি করে।
এই কয় বছর আগে প্যান্থার কনডমের একটা টিভিসি বেশ হৈচৈ ফেলে। সেই অ্যাডভার্টে সেক্সে আগ্রহি নারীটি তার পুরুষকে সফলতার (সেক্সুয়াল প্লেজারে সফল নাকি শুক্রাণু-ডিম্বানুর মিলন না ঘটাইতে সফল, সেটা বোঝা যায় না) প্রতীক হিসাবে একটা মেডেল পরিয়ে দেয়, যার মধ্য দিয়া পুরুষটি আসল পুরুষের খেতাব পায়। এইখানে আসল পুরুষের কি মেটাফোর? সেক্সুয়াল প্লেজার দিতে পারা পুরুষ?
এই সেক্সই বাঙ্গালি পুরুষের একমাত্র সমস্যা। সে সারাক্ষণ মাথায় মাল নিয়া ঘুরতে থাকে আর চান্স খুঁজতে থাকে, কোথায়, ক্যামনে কোন মেয়ের যৌন অনুভুতির অঙ্গ গুলাতে হাত দিয়ে মাল নামাবে।এই মাল সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষ সবখানেই। ২০১০ সালে শেরাটন হোটেলে তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসানের এক অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে উনার ফর্মাল স্পিচে নতুন কিছু না পেয়ে আমরা টিভি সাংবাদিকরা তাকে অনুরোধ করলাম আমাদের কিছু প্রশ্নে ক্যামেরার মুখোমুখি হতে। উনাকে এই আসার অনুরোধ করতে গেসিলাম আমি। উনি তখন কেবল স্ন্যাকস খাওয়া শেষ করলেন। উনি আসলেন আমাদের সামনে, তবে তার আগে আমার গালে আঙ্গুল দিয়া এস লেখার মতো একটা বুলানো দিলেন হাসতে হাসতে। বল্লেন, “তুমি বল্লে কী না আসতে পারি!”
উনি তখন মন্ত্রী। ব্যাপক আলোচিত মন্ত্রী। আমি একদম টাসকি খাওয়া যাকে বলে, তাই খাইসিলাম। ঠা হওয়া মুখটা বন্ধ করে, বল্লাম, চলেন যাই। মানে ওই সময়ে আমি ওইটা হজম করসিলাম। আর আমার গালে তিনি এমনভাবে আঙুল বুলাইসিলেন, আমার মনে হৈসিল, উনি প্রায়ই এরকম করেন মেয়েদের সাথে।
সংসদ সদস্য, মন্ত্রী কারা হয়, যাদের লোকে ভোট দেয়, তাইতো?।মন্ত্রী হয়ে গেলে তো উনারা আরো আইকন হয়ে ওঠেন। নাকি ভোটাররা তারে ‘আসল পুরুষ’ বলতে চান না?
ইদানিং একটা বিজ্ঞাপন বেশ প্রশ্নের ঢেউ তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলাতে। ক্রিকেটার রুবেল হোসেন মডেল আর বিজ্ঞাপনটি মোবাইল কোম্পানি রবি যেখানে বলা হচ্ছে রবির বন্ধ সংযোগ চালু করলেই আনলিমিটেড ইন্টারনেট সুবিধা মিলবে, মাত্র ব্লা ব্লা ব্লা টাকায়। কথা হচ্ছে, বিজ্ঞাপনটা আমি অনেকবার দেখার পর আমি বুঝতে পারসিলাম এইটা বন্ধ সংযোগের সাথে সম্পর্কিত একটা বিজ্ঞাপন। এইটা ধরতে না পারার কারণ পেসার রুবেলকে উপস্থাপন করা হয় খুবই লাউডভাবে। ম্যাসল ম্যান আবার মেদ নাই, ভাঙ্গা চোয়াল, লম্বা শরীর আবার ক্ষেপের সাথে বলতেসে “ এরপর আর কেউ বাচাইতে পারবে না, ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দিব”। এই খানে রুবেলের মুখ থেকে “ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দিব” উচ্চারণের যে ভঙ্গীমা সেটা এত উচ্চকিত যে রাগী পুরুষ মনে হবে না, মনে হবে যৌন উত্যক্তকারী স্ট্রিট বয়। গণমাধ্যম তো সমাজ থেকে নেয় এবং সমাজকে শেখায়ও।রবি রুবেলের মধ্য দিয়া সমাজের যে আসল পুরুষটাকে দেখাইসে, তা হৈল: পুরুষের রাগ আছে, প্রত্যয় আছে এবং সেটার জন্য সহিংসতা জায়েজ- “ডাইরেক্ট ভাইঙ্গে দিব”
পুরুষ, মানে পুরুষ একটা অ্যানাটমিক্যিাল আইডেন্টিটি থেকে সামাজিক পুরুষ হয়ে ওঠে এইভাবে যে, সে তার চোখ দিয়ে দেখা, দেখার অর্থ করতে পারে, শোনার মানে তৈরি করতে পারে; সোজা কথা, ভাবতে পারে। এই পারা-পারিটা শেখে তার জন্ম, বড় হয়ে ওঠা সমাজ-সংস্কৃতি থেকে।যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই পুরুষরা একটা আইডেন্টিটি সঙ্কটে তৈরি হয়।তাদের দিক থেকেই বেশি আওয়াজ উঠতে থাকে ‘আসল পুরুষ’, ‘সত্যিকারের পুরুষ’, ‘প্রকৃত’ পুরুষের ডিসকোর্স।ব্যাপরটা এমন যেন আসল পুরুষ হৈল যে শুধু প্রেমকিা বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকাজ করে আর অন্য নারীদের মা-বোন হিসাবে দেখবে। যেহেতু সমাজ শিখিয়েছে, মা-বোনের সাথে সেক্স করা খুবই খারাপ ছেলের কাজ, একেবারেই নিষিদ্ধ। সমাজ কিন্তু এইটা দেখায় না যে জেণ্ডারের এক্সপ্রেশনে নারীকে কিছু সামাজিক নাম-সম্পর্কের কাভার দিয়ে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। এই রকম ধারণা পুরা নারীকে দেখতে না পারায় অভ্যস্ত করে।সিমন দ্য ব্যুভোয় “দ্য সেকেণ্ড সেক্স”(১৯৬৮)য়ে যেমন বলছিলেন পুরুষরা স্বপ্নের ভেতরেও নারীকে উদ্ধারকারী হিসাবে দেখতে পায়। আসল পুরুষের এইগুলাও মেটাফোর।
ভারতের উত্তর প্রদেশের লাক্ষ্ণৌর সমাজে দেখেছিলাম, পরিবারগুলা ছেলেদের বড় করে “আসলি আদমি” চেতনায়। সেখানে এইটা সব পুরুষই ছোট থেকে বড় হতে হতে শুনেছে “ আসলি মরদ হোতা হ্যায়”। এই আসলি মরদরা আবার মাথায় নিয়ে চলেন “আসলি আওরাৎ” বা আসল নারীর মেটাফোর।
২০১৩ সালে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ফর উইম্যান এবং ইউএনএফপিএ’র যৌথতায় “ম্যাসকুলিনিটি, সন প্রেফারেন্স এণ্ড ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স” গবেষণায় বলা হয় আসলি আদমী বা আসলি মর্দ বলতে সাধারণ রাফ অ্যাণ্ড টাফ, রাগী তরুণ বুঝায় বা মারদাঙ্গি ধরনের ছেলেদের। এই গবেষণায় বলা হয়, আসলি মর্দ মানে সবল শারীরিক গঠন, বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম, পেশিবহুল শরীর, হ্যাণ্ডসাম লুক এবং লিঙ্গের আকৃতি, এটা তার আসলি মর্দের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
আসলি মর্দ হলো কাউকে পরোয়া না করা, সাহসী। সে আত্মবিশ্বাসী, সামাজিক নির্দেশকে শ্রদ্ধা করে, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল, এবং তারাই আসল পুরুষ, যারা এইসব পুরুষালি দেখাতে সক্ষম; এমন বলা হয় ওই গবেষণায়, ভারতীয় পুরুষ সম্পর্কে।
২০১২ সালে দিল্লীতে গ্যাং রেইপের ঘটনায় যখন দিল্লীসহ সবখানে প্রতিবাদে একটা প্ল্যাকার্ডে দেখা যায় “রিয়্যাল ম্যান ডোন্ট রেইপ” এইটা নিয়ে ব্লগে লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর: রিয়্যাল ম্যান বা আসলি আদমী কারা।
গণমাধ্যমে আমাদের এইখানে পুরুষের চেহারা, পুরুষালি রুপ যেই রকমে পরিবেশিত হয়, তাতে ছেলের গায়ের রঙ ফর্সা হতে হবে।ইউনিলিভারের ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলি মেন’স ফেয়ার বিজ্ঞাপন সেটা পরিবেশন করছে। মোচ বা গোঁফ এখনও চেহারায় পুরুষালি ভাব আনার আরেক বৈশিষ্ট্য।ভারত- সমাজে তো বলাই হয় ‘মুচ নাহি তো কুচ নাহি’।ফারহান আখতার তার মর্দ সিনেমার প্রচারণায় পুরুষ বুঝাইতে মোচঅলা পুরুষকে রেখেছেন।
সমাজ শেখায় পকেট ভর্তি পয়সা থাকতে হবে-“ভাত দেয়ার মুরোদ নাই তো বিয়্যা করছস ক্যা” এরকম বকা নারীর কাছ থেকে শুনতে হয় রুজি-রোজগার বিহীন জামাইদেরকে। সমাজ শেখায় নারীর মতকে বেশি সমর্থন করা পুরুষের কাজ না, মত যতই যৌক্তিক হৌক না ক্যান-মাইয়া মানুষ হৈল বান্দরের জাত, লাই দিলে মাথায় উঠে। সমাজ শেখায় পুরুষদের- খারাপ মেয়েরা বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি করে, ওরা ওড়না পরে না, জামা পরে টাইট ফিটিং। সমাজ শেখায় পুরুষ হলো নারীর খাবার যোগানদাতা, সম্মান প্রদানকারী যেমন: মিসেস মেজর জামিল। সমাজ শেখায় প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাযে গেলে অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাসিন্দারা ভালো ছেলে বলে। সমাজ শেখায়, নারীকে অনেক কথা বলতে দিবা, তুমি পুরুষ তুমিই দিবা, তবে সিদ্ধান্তটা তুমিই নিবা।সমাজ আরো অনেক কিছু শেখায়, মেয়েদের শরীর একটা বিশেষ বস্তু, এই বস্তুরে টোকা দিলে তাদেরই ইজ্জ্বত যায়।আবার এই বস্তুটার সাথেই পাওয়া যায় সেক্সুয়াল প্লেজার। নারীর শরীরের সাথে যে মনের সম্পর্ক কতটা গভীর, সেইটা সমাজ পুরুষকে শেখায় না, শেখায় শরীররটা একটা বস্তু কেবল।
এই সংস্কৃতি পুরুষের কাছে চায়, ইসলাম, হিন্দু, খ্রস্টিান, বৌদ্ধ যে ধর্মই হৌক, ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকুক, নারীর স্তন-শরীর হাতড়িয়ে, কামড়িয়ে, ধর্ষণ করার যৌন সন্ত্রাস থাকুক। সমাজ থাকুক, সমাজের মতো ঠিকঠাক: মেলায় যায় বাজারী মেয়েরা, ওড়না না পরা মেয়েরা সস্তা/বেশ্যাদের মতো এরকম আরো আরো ধারণা। সমাজ আরো শেখায় যে পুরুষ বউ ধরে রাখতে পারে না, সেই পুরুষ ব্যর্থ পুরুষ।
সমাজের চোখে ব্যর্থ পুরুষরা আবার মেইন স্ট্রিম সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে একটু কোনাতেই থাকে। বিবাহ, ধর্ম, পরিবার, এরকম নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে এর নানা দিককে প্রশ্ন করে। এরা নারীকে বন্ধুর মতো দেখতে পারে, এই জন্য তাদের ‘মাইয়া ঘেঁষা’, ‘হিজড়া’, ‘সোনা নাই’ এরকম টিটকারি শুনতে হয় এবং এসবের মধ্য দিয়া সামাজিক কনস্ট্রাকশন তৈরি হয়: প্রচলিত পুরুষালিকে চর্চা না করা পুরুষদের। এই পুরুষদের মধ্যে অবশ্য আবার এমন পুরুষকেও আমি জানি, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণে বিশাল একজন নেতা হয়ে পড়া নারীর প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধাশীল পুরুষকে, যে তার বউকে পেটায় এবং বউয়ের টাকায় জীবন চালায়, অ্যক্টিভিজম করে।
বৃটিশ দৈনিক ইণ্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড কোহেন। পুরুষ হয়ে ওঠার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখেন “বিয়িং অ্যা ম্যান”(১৯৯০)।ওই বইতে তার পুরুষ হৈয়াও পুরুষালি করতে না পারায় সামাজিক ফ্যাকড়ায় পড়ার গল্প একটু বলি, শেষ টানে । কোহেন লিখে লিখে বলতেসেন, “যখন আমি ছোট শিশু আমাকে প্রায়ই বলা হতো, টু বি অ্যা ম্যান/পুরুষ হও। যখন আমার বিয়ে ভেঙ্গে গ্যাল, আমার মা বল্লো, ‘টু বি অ্যা ম্যান’। এটা বলে সে বুঝাইত, আমার স্ত্রীর কাছে আমার ফেরত যাওয়া উচিৎ হবে না।কঠোর এবং ক্ষমাহীন হওয়াটাই পুরুষের যথার্থ রূপ। আমার মায়ের সেই কৌতুহলি রুক্ষতা আমাকে শৈশবের দিনগুলার কথা মনে করায়ে দিল, যখন আমাকে শুনতে হতো ‘টু বি অ্যা ম্যান’।
Categories: বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply