ফেসবুক এবং টেলিভিশনে যা দেখছি এবং/অথবা সাভারে নিজে যা দেখেছি

Anha F. Khan

The final embrace: Photo by Taslima Akhter

The final embrace: Photo by Taslima Akhter

ঘটনাটি ঘটেছে ২৪ এপ্রিল বুধবার। স্বাভাবিক প্রশ্ন- আমি এখন কি করতে পারি? নিহতের সংখ্যা যখন ৩ থেকে ২৫ এ দাঁড়ালো- তখন সিদ্ধান্ত নিই সাভার যাবার- উদ্ধার কাজে লেগে যাবার। কিন্তু টেলিভিশনে লাইভ প্রচার শুরু হবার পর মনে হল সাভারে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একটি ভুল সিদ্ধান্ত। সেখানে মানুষের অতিরিক্ত উপস্থিতি উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। টিভিতে উদ্ধার তৎপরতা দেখে আমি আশাবাদী হই- যখন ঘোষণা আসে ‘১টি প্রাণও জীবিত থাকা অবস্থায় উদ্ধারকাজ চলবে’- তখন আশ্বস্ত হই, সেনাবাহিনীসহ উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া সকল বাহিনী, ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হই। উদ্ধারকাজে অনাস্থার টোনে অনেককে লিখতে দেখেছি ফেসবুকে, কিন্তু অপপ্রচার ভেবে খুব একটা পাত্তা দেইনি। উদ্ধারকাজের প্রতি আস্থা রেখে ভিকটিম সাপোর্টের দিকে মনযোগ দিয়েছি(লজিস্টিকস নেই কেন পর্যাপ্ত? এই জলন্ত প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ালে, আপাতত তা মাথায় রেখেও রক্ত, ঔষধ, পানি, স্যালাইন, কাটার, মাস্ক এগুলো পাঠানোর কাজটাকেই ১ম মনযোগের জায়গায় ধরেছি।) কিন্তু ২য় রাতে কল্লোল মুস্তফার স্ট্যাটাস দেখে ভয় পেয়ে যাই। তিনি লিখছেন- “অবশেষে একজন মিডিয়াকর্মীর সহায়তায় কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল ইমরানের কাছে পৌঁছানো গেল। তাকে পেছনের দিকে নিয়ে এসে পরিস্থিতি দেখানোর পর তিনি কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ কয়েকজনকে নিয়োগ করলেন পেছোনের দিকে। তাদের আনা যন্ত্রপাতি নিয়ে মূলত সাধারণ মানুষ- কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রীরাই কাজ করছে। আপাতত টার্গেট ৬ তলার ৩ জন জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা। জানিনা তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা যাবে কিনা, খালি আফসোস দুইদিন পর তাদেরকে ডেকে এনে দেখাতে হয়- এখানে কাজ করেন, ওখানে কাজ করেন… নিজস্ব কোন তাগিদ এ রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর নাই আটকে পড়া জীবিত মানুষগুলোকে উদ্ধার করার।”পরদিন, অর্থ্যাৎ ২৬ তারিখ শুক্রবার সকালে সাভার পৌঁছাই ১০টার দিকে। পুলিশ-র‌্যাব তার দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছে না, কারণ মানুষে এত ভীড়! বাহির থেকে দেখা যাচ্ছে, উদ্ধারকাজ চলছে রানা প্লাজার ঠিক উপরের অংশে এবং বা-দিকের আর এস প্লাজা দিয়ে রানা প্লাজার দিকের অংশে। বাহিরের দিকটায় মূলত ফায়ারসার্ভিসের কর্মীরা, সাথে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী গ্রুপ ও ব্যক্তি এবং অল্প কয়েকজন সেনাসদস্য। ফেসবুক থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া সেই প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেয়- বাকী সেনারা কোথায়? জানার আগ্রহ হয়, কিন্তু জানতে হলে যেতে হবে ভেতরের দিকে। কিন্তু আমজনতা হিসেবে সে অধিকার আমার নেই- অনেস্টলি বলছি, একটি সত্যিকার সর্বাত্মক উদ্ধারকাজে এই অধিকার না দেয়াকেই আমি উচিৎ বলে মনে করি।একটি বেসরকারী টেকিভিশন চ্যানেলের এক বড় ভাইয়ের সহযোগীতায় আমার নিজের ওজনের প্রায় সমান ওজনের একটি ট্রাইপড হাতে নিয়ে একজন ‘মিডিয়াকর্মীর’ ছদ্মবেশে আমি ভেতর দিকটায় যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে যাই।প্রথমেই চল যাই রানা প্লাজা ও আরএস প্লাজার ঠিক পেছনে। কিন্তু সেখানে কোন কাজ চলছে না। একদল কিশোর-তরুণ সেইখানে(রানা প্লাজার ওপরে, পেছনের দিকে) সদ্য কাজ শুরুর চেষ্ঠা করছে। আমি যখন যাই তখন সেইখানে ৫০/৬০ আর্মি, প্রায় অর্ধেক পুলিশ এনং ২০/২২ জন দাঙ্গা পুলিশ। জানলাম কিছুক্ষণ আগে আর এস প্লাজার ৩ আর ৪ তলা থেকে হেফাজতিরা আর্মিকে ঢিল ছুড়েছে। তার রেশ হিসেবে সেনাকর্তারা হেফাজতী ছাড়াও বাকীদের নেমে আসতে বলতেছে। এলাকা ত্যাগ করতে বলতেছে। হেফাজতীগুলা তখন নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হওয়া আরএস প্লাজার ভেতরে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল। আর রানা প্লাজার উপরের কিশোর-তরুণরা আর্মিকে সাফ জানিয়ে দিল তারা নামবে না। তারা কাজ করবে, আর্মি নিজেও কাজ করছে না, তাদেরকেও করতে দিচ্ছেনা। আর্মিরা আসছে চেহারা দেখাইতে- এমন দাবীও করল। তাতে হ্যান্ডমাইক হাতে সেনাকর্মকর্তা, যিনি নিজের পরিচয় পরিচয় দিলেন ‘আমি একজন মেজর জেনারেল’ হিসেবে(যদি ভুল না শুনে থাকি), তিনি হঠাৎ আশপাশের বাড়িঘর থেকে উঁকিঝুঁকি মারা লোকজনের উপর ক্ষেপে গেলেন এবং পুলিশকে নির্দেশ দিলেন তাদেরকে ‘শায়েস্তা করার’। তিনি ঘোষণা দিলেন ‘আমি একজন মেজর জেনারেল। পুলিশ বাহিনীকে বলছি আপনারা দাঁড়িয়ে থাকলে আপনাদের একজনেরও চারকী থাকবে না’ ইত্যাদি। ভয় পেয়ে পুলিশ ছুটে গিয়ে বাড়িঘরের দিকে টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট মেরে আসল। আর ২/৩ তরুণ যারা ভয় পেয়ে নেমে রানাপ্লাজার কাজ থেকে তাদেরকে বলা হল দৌঁড় দিতে, তারা দৌঁড় দিলে পেছনে সেনারা লাঠিপেটা করতে করতে সীমানা পাড় করে দিয়ে আসছে, দোঁড় থামালে বলছে ‘দৌঁড়া’, দৌড়ালে লাঠির বাড়ি!!যারা নামল না, তারা কাজ করতে থাকল। আমি স্তুপের কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম। মাঁছি উড়ছে। উঁকিঝুঁকি মারলে ৬/৭টা লাশের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। খুব নিকটেই একটি। উপুড় হয়ে আছে, ফুলে ফেপে, পঁচে স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুন আকৃতি পেয়েছে। ফুল হাতা জামা গায়ে। হাতের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে পানিভর্তি একটা কাপড়ের থলে। মুখ বা মুখের অভ্যন্তর থেকে গলে গলে কি যেন পড়ছে- ঘি এর মত রঙ। ঠিক ঐ মুহূর্তেই তিনজন লোক এল, হাতে এক তরুনীর ছবি। তারা সনাক্ত করল এই লাশটি তার, যাকে তারা খুঁজছে। অথচ এই লাশটি বিচ্ছিন্নভাবে বের করা সম্ভব নয়। আলাদা করে এইজায়গায় থাকা লাশগুলো বের করতে হেলে পুরো ভবন আবারো ধ্বসে পড়বে। এই জায়গাটা পেছনের সিঁড়ি। এখানের স্ন্যাবগুলো ছোট ছোট। ক্রেন কিংবা হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর থেকে এর স্ন্যাব সরিয়ে নেয়া সেনাবাহিনীর জন্য খুব সোজা কাজ বলেই আমার মনে হয়েছে।তারপর আরএস প্লাজার পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম সবচেয়ে উপরের ফ্লোরে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাধারণ উদ্ধারকারীদের সাথে নিয়ে কাজ করছে। কোথাও কোথাও তাদের সাথে খুব হাতে গোণা ২/১ জন সেনাসদস্য দেখলাম। এই ভবন থেকে দেয়াল খুঁড়ে খুঁড়ে রানা প্লাজায় যাওয়ার পথ কাটা হচ্ছে। খানিক পরপরই হাত, মাথা আর পা দেখা যাচ্ছে, বাকি পুরো শরীর দুইটি ফ্লোরের মাঝে পুরোপুরি পিষে গেছে। উপর থেকে সুড়ঙ্গগুলো দেখতে দেখতে নিচে নামছিলাম। হঠাৎ উত্তেজনা! একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে জীবিত একজনকে বের করা হল, ভেতরে আরো কয়েকজন আছে। উদ্ধারকারীরা স্ট্রেচারে করে প্রথমজনকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে এল। দ্বিতীয়জনকে বের করে সিঁড়ির কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথে সেনাসদস্যরা বুকে ধাক্কা মেরে স্ট্রেচার তুলে এম্বুলেন্সে তুলে দিচ্ছে। প্রথমে বিষয়টা বুঝে ঠতে পারি নাই। এরপর যখন একে একে ১২ জন জীবিত মানুষ উদ্ধার করা হল, একইভাবে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া এবং এরপরই শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর আগমণ তখন বুঝলাম। মানুষের মানবিক বোধ দেখে তাদের পায়ে মাথা ছোঁয়াতে ইচ্ছা করল! আর্মির সাথে তারা ফটোসেশনের কোন প্রতিযোগীতায় নাই। এই সেশনের ফ্লোর তারা সেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে। তারা শুধু জীবনগুলো বাচাতে চাইছে!তারপর আরো একধাপ নামলাম সিড়ি দিয়ে। সেখানে প্রচুর খাকি পোশাক। এতকিছুর পরও আশা চাগান দিয়ে উঠল! ভাবলাম এই ফ্লোরে তারমানে ওরাই কাজ করছে। কিন্তু হায় ঈশ্বর! এটা তো নীচতলা! এখানে ওরা এন্ট্রি-এক্সিট তদারকি করছে।দেখা হল পরিচিত একজন সাংবাদিকের সাথে। নানান আলাপের পর তিনি একটি নীল ফিতার একটি আইডি কার্ড দেখালেন। কার্ড নং ২১১০৯, নাম মরিয়ম। নিজেই বললেন, ‘হয়ত বের হয়ে যাওয়ার সময় ফেলে গেছে’। বলতে চাইলাম, নাও তো হতে পারে, হতে পারে সে লাশ হয়ে যাওয়াদের একজন। কিন্তু বলা হল না। আসলেই তো জানিনা কেউ। হঠাৎ তিনি ‘যাই’ বলে উধাও হয়ে গেলেন। কার্ডটি আমার হাতে রয়ে গেছে। ডানে-বামে তাকিয়ে খুঁছছি তাকে হঠাৎ মনে হল, তিনি ইচ্ছা করেই এটা রেখে গেছেন। একজন রিপোর্টার হিসেবে এই ভুলোমনা কাজটি তার এইখানে করার কথা নয়। ভাবছিলাম তিনি কি ১৯৯০ সালে জন্ম নেয়া মরিয়মকে আমার কাধে চাপিয়ে হালকা হলেন?(আমার অনুমান নিশ্চিত হলাম রাতে তার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে)। পুরোটা সময়জুড়ে সাধারণ উদ্ধারকারীদের সাথে সেনাদের দুর্ব্যহার আর থ্রেট দেখে এসে একজন সাংবাদিকের অসহায় দুঃখবোধ দেখে মনে হল- হায় সেলুকাস!বাইরে যারা উদ্ধারকাজের নানা সহযোগী কাজ করছে তাদের একটা বড় অংশের মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক থাকলেও ভেতরের উদ্ধারকারী জনতার সবাই এত সুসজ্জিত নয়। হাজার হাজার মানুষ আমরা চাঁন্দা তুলে তুলে হেলমেট, গ্লাভস, মাস্ক পাঠালাম অথচ সেগুলো সঠিক জায়গায় পৌঁছে নাই। বাইরে অনবরত মাইক চলছে। উদ্ধারকাজের আপডেট দেয়ার চেয়ে বেশি বেশি তারা ঘোষণা দিচ্ছেন- ‘মাননীয় এমপি মুরাদ জং এর কঠোর ‘তত্বাবধায়নে’, সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ‘প্রচেষ্টায়’ এবং অন্যান্যদের ‘সহযোগীতায়’ উদ্ধারকাজ চলছে। ঘোষণায় ‘এই মুহূর্তে আরো ৪টি জীবিত লাশ উদ্ধার করল সেনাবাহিনী’ জাতীয় অদ্ভুত বাক্যাবলি ঘোষিত হচ্ছিল।সন্ধ্যা আগে আগে ফিরে এলাম। ঠিক সেইমুহূ্তে আরো একটা ওজনদার বোঝা চাপিয়ে দিলেন এক পিতা। এ-ফোর কাগজের একটা কপি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- খোঁজ পাইলে এই নাম্বারে ফোন দিয়েন’। তারপর নিঃশব্দে চলে গেলেন। ছবি, নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ লেখা ‘সন্ধান চাই’। সাথে আরও দুটো শব্দ- ‘জীবিত/মৃত’!বি.দ্র.১: এই অভিজ্ঞতা পুরো সময়ের অভিজ্ঞতা নয়। তাই হতে পারে আমার অভিজ্ঞতা ‘ব্যতিক্রম’- যা উদাহরণ নয়। যদিও এলাকাবাসী ও মিডিয়াকর্মীদের ভাষ্য- ‘৩য় দিনে সেনাবাইনী আগের দুইদিনের চেয়ে বেশি কাজ করছে। বি.দ্র.২: আমি ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে খুশি হতাম যদি ঘটনার পরপরই সকল সাধারণ মানুষ সরিয়ে দিয়ে জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী, ফায়ারসার্ভিসসহ রিলেটেড অভিজ্ঞতা মানুষেরাই এই কা্যক্রম সর্বাত্মকভাবে করত। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ‘ভালবাসা, আবেগ আর মানবিকতার’ সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ‘দক্ষ, সমর্থ এবং আন্তরিকতার’ সমন্বিত বাহিনী।বি.দ্র.৩: সেনাবাহিনীর কোন কোন সদস্য ব্যক্তগতভাবে খুব আন্তরিকতা নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। সেইটা যদি পুরো বাহিনীকে রিপ্রেজেন্ড না করে তাহলে সেটা নিয়ে অলওভার সন্তুষ্টির কোন কারণ আমি দেখিনা। মনে রাখবেন, উদ্ধারকাজ শেষ হয় নাই, চলছে। তাই কি কি হইছে সেইটা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ খুব দায়িত্বহীন কাজ হয়ে যাবে, এই মুহূর্তে ‘হিরো’ খোঁজাখুজি খুব ফালতু  কাজ হয়ে যাবে। এই মুহুর্তে দরকার কি কি হচ্ছে না, কি কি করা আশু উচিত সেইটা নিয়া কথা বলা এবং চাপ সৃষ্টি করা।

Note written on April 27, 2013



Categories: আন্দোলন বার্তা

Tags: , , ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: