শাড়ি চুড়ি হোক শক্তিমত্তার প্রতীক

shari-churi 2

আনমনা প্রিয়দর্শিনী, অতিথি ব্লগার

আমাদের মাঝে নানা বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আচার–প্রচারে বিভক্তি রয়েছে, কিন্তু একটাবিষয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের অদ্ভুত মিল আছে। আমাদের মধ্যেকার একটা বড় অংশ পিতৃতান্ত্রিকসমাজ আর সংস্কৃতির বেঁধে দেয়া ছকের বাইরে এখনও কিছু ভাবতে, করতে, বা চাইতে পারে না। যা কিছুইআমরা করতে যাই, আর যা কিছুই বলতে চাই তা কেমন করে জানি ভীষণভাবে পুরুষালী হয়ে ওঠে। সবচেবিপদজনক কথা হলো আমাদের প্রতিবাদের ধরণ ও ভাষাও পুরুষালী এবং আগ্রাসী।

পহেলা বৈশাখে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার যে ঘটনা ঘটলো তার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতেঅনেকেই সহিংসতাকারীদের ‘মা–বোনদের‘ পাল্টা ধর্ষণ করে তাদের শিক্ষা দেবার বাসনা প্রকাশ করেছেন।কেউ কেউ আবার নিজেদের সকল ক্ষোভ ঝেড়েছেন আক্রমনকারীদের ‘মা–বাচক‘ গালাগালি করে।

সকলে যে সহিংস আচরণ করছেন তা নয়, অনেকেই আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন । কিন্তু ‘অসহিংস‘প্রতিবাদ মানেই যে তা সমস্যাহীন তা নয়। যেমন ১লা বৈশাখে পুলিশের নিস্ক্রিয় ভূমিকার প্রতিবাদেচারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গত ১৯শে এপ্রিল চুড়ি, শাড়ি, ললিপপ নিয়ে শাহাবাগ থানা ঘেরাওকরেন। যার উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের ‘পৌরুষে‘ আঘাত দেয়া, এবং তাদের ‘দূর্বল‘ প্রমান করা। যদিও অনেকনারী পুলিশ–বাহিনীতে কর্মরত আছেন, চুড়ি–শাড়ির এই প্রতিবাদ নারী পুলিশকে উদ্দেশ্য করে হয় নি, এইপ্রতিবাদের লক্ষ্য বস্তু ছিল পুরুষ পুলিশ।

ফলে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করা যাক কেন নারী পুলিশ একটি প্রতিবাদের লক্ষ্য বস্তু হবার জন্য যথেষ্টপরিমাণের ‘পুলিশ‘ হয়ে উঠতে পারে না এবং কেন দায়িত্বে অবহেলার কারণে পুলিশের পেশাদারিত্বকে নয়বরং ‘পৌরুষত্ব‘কে আক্রমণ করা জরুরী হয়ে ওঠে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ধরেই নেয় নারীর কোনো এজেন্সীনাই। প্রাত্যহিক চর্চা, কৌশলের মধ্যে দিয়ে আমরা পরিচিত–অপরিচিত থাবাগুলোর হাত থেকে নিজেকেএবং অন্যকে বাচানোর যে প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত বহাল রাখি তা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চোখে ধরা পরে না। ফলেঘরে, বাইরে ‘সক্রিয়‘ পুরুষের বিপরীতে আমরা ‘নিস্ক্রিয়‘ নারী হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকি। কিন্তু পুরুষেরপুরো পরিচয় দাড় করানো হয় তার ‘সক্রিয়‘ উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে। সমাজ ধরে নেয় যে একদল পুরুষআমাদের বিবস্ত্র করবে, ধর্ষণ করবে, অন্যদিকে আরেকদল পুরুষ আমাদের আব্রু–ইজ্জত ‘রক্ষা‘ করবে।গুনগত দিক থেকে এই দুই দলের পুরুষের মাঝে বিশাল ফারাক রয়েছে, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুযায়ীদুদলের মিলের জায়গাটা হলো এরা উভয়–ই  ‘সক্রিয়‘, নারীকে ‘অরক্ষিত‘ করা বা ‘রক্ষা‘ করার মধ্যে দিয়েএদের ‘সক্রিয়তা‘ বজায় থাকে। পুলিশকে সমাজ আদর্শগত দিক থেকে শেষের ক্যাটাগরি এর পুরুষের সাথেমেলায়। ‘আদর্শ‘ পুরুষ ‘রক্ষকের‘ ভূমিকা পালন করে,  ঠিক তেমনি ‘আদর্শ‘ পুরুষ পুলিশ–ও ‘রক্ষক‘। রক্ষাকরার মধ্যে কোনো সমস্যা নাই, বরং মানুষ হিসাবে অথবা আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে বিপদেসাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াই কাম্য এবং প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সমস্যা হলো কোনো কিছু তা সে ‘নারী–ই‘ হোক আর আইন–শৃঙ্খলাই হোক তা ‘রক্ষা‘ করতে পারার এজেন্সী, ক্ষমতা, শক্তিকে পুরুষালী মতাদর্শশুধু মাত্র ‘পৌরুষত্বের‘ সাথেই যুক্ত করে দেখে। আর সে কারণেই নারী পুলিশ দায়িত্বে অবহেলা করলেক্ষোভ প্রকাশের কিছু থাকে না, ধরেই নেয়া হয় আইন রক্ষার গুরু দায়িত্ব তার মত ‘অবলা‘ নারী পালনকরতে সক্ষম নয়। কিন্তু পুরুষ পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা মানে ‘রক্ষাকারী‘ হিসাবে তার পুরুষালী পরিচয়প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়া। তাই তাকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শাস্তি দিতে চায় তার ‘পৌরুষত্ব‘ কেড়ে নিয়ে,তাকে অপমান করে। পুলিশের এই ‘পৌরুষে‘ আঘাত করা হয় তাকে এমন কিছু বলে বিদ্রুপ করার মধ্যেদিয়ে যা কিছু তার ‘প্রবল‘, ‘প্রতাপশালী‘, ‘রক্ষাকারী‘ ভাবমূর্তির বিপরীত। চারুকলা অনুষদেরপ্রতিবাদ পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের এই সমীকরণকেই অনুসরণ করেই ঘটেছে, যেখানে পুলিশকে বিদ্রুপ করাহয় তাকে ‘রক্ষাকারী‘র বিপরীতে শাড়ি–চুড়ি পরা ‘দুর্বল‘ সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো ‘দুর্বলতার‘ প্রতীক হিসাবে কেন চুড়ি, শাড়ী, ললিপপ বেছে নেয়া হলো? অনেকেই বলছেনযে এই প্রতীকগুলো রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশে । কিন্তু কোনো ‘রূপক‘ তো আরআসমান থেকে পয়দা হয় না। চুড়ি–শাড়ি ইতিহাসের সকল সময় ‘দুর্বলতার‘ প্রতীক ছিল না। এদের‘দুর্বলতার‘প্রতীক বা রূপক হয়ে ওঠার গল্প, ‘নারী‘ আর ‘পুরুষ‘ বলতে সমাজে যা বোঝানো হয় তার সাথেযুক্ত।  আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর একটি নির্দিষ্ট ‘দূর্বল‘ সত্ত্বা তৈরী করে পুরুষের ‘সবল‘ সত্ত্বার বিপরীতে। আমরা বেড়ে উঠি এই ধরণের একটি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে। আমাদেরপাঠ্যপুস্তক, গল্পের বই, মিডিয়া, প্রাত্যহিক আড্ডা গল্প জুড়ে থাকে নারী–পুরুষের এই বিপরীত চিত্র।পুরুষালী মতাদর্শ ‘আদর্শ‘ নারীত্ব ও পৌরুষত্বকে আদল দেয় ভিন্ন রূপকে। ‘অবলা‘, ‘লাজুক‘, ‘স্বল্পভাষী‘, ‘ভীতু,’ ‘অরক্ষিত‘, ‘মোহনীয়‘, ‘গৃহকর্মে পারদর্শী‘ ‘স্বল্পবুদ্ধিধারী‘ ‘মেয়ে মানুষ‘-এর একটিএসেনসিয়াল পরিচিতি দাড় করানো হয় শাড়ি, চুড়ি, আলতা, বেলি ফুলের মালা, খুন্তি, কড়াই, সুই–সুতোইত্যাদি বস্তুকে কেন্দ্র করে, যেন বা এর বাইরে নারীর কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে ‘শক্তিশালী‘, ‘আগ্রাসী‘, ‘সাহসী‘ ‘রক্ষাকারী‘, ‘বুদ্ধিমান‘ পুরুষের পরিচয় দার করানো হয় প্যান্ট–শার্ট, টাই, সিগারেট,বন্দুক, ক্রিকেট ব্যাট, হোন্ডা,গাড়ি বই–খাতা, মেশিন ইত্যাকার বস্তুকে কেন্দ্র করে। নারী এবং পুরুষের এইপরিচয় ও প্রতীকগুলো শুধু যে বিপরীত তা নয়, বরং অসম।  চুড়ি–শাড়ি আর শার্ট–ঘড়ি  এর মধ্যে এমনিতেকোনো পার্থক্য নাই, সবগুলোই পরিধেয় বস্তু । কিন্তু যখন–ই চুড়ি–শাড়িকে নারী পরিচিতির পূর্ব শর্ত হিসাবেদেখা হয় যেই নারী কিনা পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুযায়ী পুরুষের ‘অধঃস্তন‘  তখন–ই চুড়ি–শাড়ি নেতিবাচকঅর্থ লাভ করে। আর এভাবেই নারীকেন্দ্রিক প্রতীকগুলো পুরুষালী প্রতীকের চেয়ে ‘দূর্বল‘ হয়ে ওঠে। নারীরজন্য তাই পুরুষের প্রতীকগুলো ভংকর বিপদজনক। অন্যদিকে পুরুষের জন্য নারীর এই প্রতীকগুলো ধারণকরার অর্থ অপমানের, ‘দূর্বলতার‘, পুরুষের ‘উচ্চ‘ অবস্থান থেকে অধঃপতনের। আর সে কারণেই ‘দূর্বলের‘প্রতীক বা রূপক অর্থে শাড়ি–চুড়ির ব্যবহারের প্রচলন সমাজে আছে। উল্টো করে বললে বলতে হয়যে সমাজে নারীকে এখনও ‘দূর্বল‘ ভাবে দেখার চর্চা আছে, আর তাই নারীর যা কিছু তাকেও ছোট করেগণ্য করার প্রবণতা আছে। কিন্তু আমরা কি এই পুরুষালী চর্চার অনুশীলন অব্যহত রাখতে চাই নাকি নারীকেখাটো করে দেখার এই প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই? মনে রাখার বিষয় যে পুরুষকে এই প্রতীকগুলোদিয়ে অপমান করতে চাওয়ার অর্থ হলো বিনা দ্বিধায় এটা মেনে নেয়া যে নারীর চুড়ি–শাড়ি ‘দূর্বল‘, নারী‘দুর্বল‘। তাই আন্দোলনে চুড়ি–শাড়ি এর নেতিবাচক প্রতিকী ব্যবহার কোনো রেডিকাল চিন্তার ফলাফল নয়,বরং তা গতানুগতিক পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শেরই প্রতিফলন।

প্রশ্ন হলো আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, ও প্রতীক যদি এরকম পুরুষালী হয়ে ওঠে তাহলে আদতে নারীর প্রতিযৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে আমরা কতটা ভূমিকা রাখতে পারব? প্লিজ বলবেন না যে “এসব নিয়ে কথাবলার  সময় এটা নয়।” সময়  নিজে কোনো বিষয় নিয়ে বাতচিত করার পরিসর তৈরী করে না, বরং নির্দিষ্টবাতচিত, তর্ক–বিতর্ক নির্দিষ্ট সময়কে আদল দেয়। তাই এখন–ই সময় প্রতিবাদ গড়ে তোলার, আমাদেরআনন্দ, ক্ষোভ, প্রতিরোধের নতুন ভাষা, প্রতীক সৃষ্টি করার। আপনার প্রতিবাদী স্পৃহাকে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তুপ্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি আপনার সব কিছু ‘ভাইঙ্গা দিবার‘ মন চায়, সহিংসতাকারীদের যদি আপনার‘অমুক মা এর ….পোলা‘ মনে হয়, তাদের মা–বোনদের আপনার যদি ‘ডাইরেক্ট রেপ‘ করতে ইচ্ছা হয়,অথবা দায়িত্বে অবহেলাকারী পুলিশদের ‘দুর্বল‘ প্রমান করার জন্য আপনি যদি শাড়ি–চুড়ি–ললিপপেরনেতিবাচক ব্যবহার ছাড়া আর কিছু খুঁজে না পান তাহলে প্রতিবাদ করার আগে আপনি আপনার চিন্তা–ভাবনার পরিধিকে পুরুষালী মতাদর্শের বাইরে বিস্তৃত করেন। শাড়ি–চুড়ি যদি ব্যবহার করতেই হয়তবে আরেকটু সৃজনশীল হন। উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। গত ফেব্রুয়ারী মাসে টাকসিম স্কয়ারে বহুটার্কিশ পুরুষ স্কার্ট পরে জড়ো হয়েছিলেন ২০ বছর বয়সী আসিয়ান হত্যার প্রতিবাদে যাকে ধর্ষণ করাহয়েছিল ‘প্রভোকেটিভ‘ স্কার্ট পরার অজুহাত দেখিয়ে। ১লা বৈশাখের ঘটনায় অনেকেই নারীদের দোষদিচ্ছেন এই বলে যে তারা সহিংসতাকারীদের ‘প্রলুব্ধ‘ করেছেন বিশেষ কায়দায় পোশাক পরে। প্রতিবাদতাই শুধু পুলিশ নয়, এই সব মনমানসিকতার মানুষের বিরুদ্ধেও করতে হবে। আর সেই প্রতিবাদের মিছিলেনারীর পোশাক–অলংকারকে ‘দুর্বলতার‘ প্রতীক হিসেবে নয় বরং ‘শক্তি,’ ‘সক্ষমতা‘, ‘সক্রিয়তা‘র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করি চলুন।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী University of Pittsburgh-এর নৃবিজ্ঞান বিভাগের PhD শিক্ষার্থী 



Categories: আন্দোলন বার্তা, বাংলাদেশে নারীবাদ, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ

Tags: ,

Leave a Reply

Please log in using one of these methods to post your comment:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: