নাসরিন সিরাজ
ঢাকায় বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের সময় যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটলো। তবে সেটা বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে খুব স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক লঞ্চ ডুবে-ভবন ধ্বসে-এক্সিডেন্টে মানুষ মারা যাওয়া, হরতালে ব্যস্ত রাজপথে পেট্রোল বোমায় বাসে আগুন লাগা বা ধুম করে খান চারেক ককটেল ফোটা, বড় বড় দলের রাজনৈতিক নেতা সহ সাধারণ পান দোকানদার বা বস্তির উঠতি বয়সের ছোকরা/ছুকরির নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের সব মানুষের জানা যে জীবনের কোন নিশ্চয়তা কারো নেই, মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে স্বস্তা। এরকম নিশ্চিত একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ঢাকা শহরের সবচাইতে বেশি লোক জমায়েত হয় এমন একটা এলাকায় ভীড়ের মধ্যে মেয়েরা যৌন নিপীড়নের স্বীকার হবে এতে অবাক হবার তাই কিছু নেই। ভীড়ের মধ্যে পুরুষেরা সব নরপিশাচ আর হায়েনা- জানা আছে বাংলাদেশের মানুষের। হয়তো সে কারনেই “মেয়েরা কেন ভীড়ের মধ্যে গেল”, “কেন মেয়েটা সেক্সি হয়ে সেজে গুজে রাস্তায় বের হল” এরকম ভিক্টিম ব্লেমিং আর পুরুষাধিপত্যবাদী কথাবার্তাগুলোও স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। এই যে সহিংসতাকে বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে কিন্তু তারপরও সহিংসতায় ডিসটার্বড হচ্ছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, আহাজারি করছে সেটা একটা অবাক করা ঘটনাই বটে।
না, সব মানুষ পহেলা বৈশাখের দিন যৌননিপীড়ন প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি। সেটা হলে নিশ্চয়ই খবরটা ব্রেকিং নিউজ বা টক অব দ্য টাউন হতো না। পত্র-পত্রিকা মাধ্যম জানা যায় যে শুধু বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির অলিখিত ছাত্র সংগঠন- ছাত্র ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কর্মী এই যৌননিপীড়ন/যৌনসন্ত্রাস ঠেকাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা কয়েকজন যৌননিপীড়ককে ধরে পুলিশের কাছেও নিয়ে যায়, যদিও পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। ঘটনাটার জায়গা যেহেতু টিএসসি তাই ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকেও বিষয়টি অবহিত করে। একই রকম ঘটনা একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। পরের দিন থেকেই শাহবাগ মোড় থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত রাজপথটি যৌননিপীড়ন বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়। কারা বিক্ষোভ করছে এ বিষয়ে পরে আসছি। প্রথমে অনুসন্ধান করি চলুন আক্রমনকারী কারা?
আক্রমনকারী অবশ্যই পুরুষ মানুষ। কিন্তু শত্রু চেনা এতো সহজ বলেই আক্রমনকারী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়লো। দৃষ্টি দোষীদের থেকে সরাতে সবচেয়ে বস্তাপচা মুভটি ছিল তথাকথিত মেইনস্ট্রীম মিডিয়ার (যেমন, বিডিনিউজ২৪ডটকম, প্রথমআলো)। ঢাকায় ১৯৯৮ সালে থেকে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়া যৌননিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন এবং তার ফলে অর্জিত আইনী নির্দেশের থোড়াই কেয়ার করলো তারা, বললো ঘটেছে আসলে শ্লীলতাহানী, বস্ত্রহরণ, ঈভটীজ। দিব্যি নারীকে তারা বানিয়ে ফেলল একটা অবলা প্রানী। স্বাভাবিকভাবেই এসব মিডিয়ার পুরুষ পাঠকরা “আহা, মেয়েরা তোমরা খুব শালীনভাবে চলো, না?” –এই যুক্তি প্রকাশে সরব হল। নারীরা আগুন, পুরুষেরা মোম/ নারীরা যৌন উত্তেজক, পুরুষেরা কামের কাছে পরাজিত রক্ত মাংসের সাধারণ/ নারীরা রসালো খাবার, পুরুষেরা লোভী মাছি কিংবা কুকুর, ক্ষুধার্ত- এই নিয়ে পুরুষ পাঠকরা চালালো তাদের সাইবার লেখালেখি। নারী পাঠকদের কাছ থেকে এবার সাইবার জগতে লেখার পাশাপাশি ছিল ভিডিও বক্তব্য। তারা প্রকাশ করেছে যে যৌনআক্রমন নিয়ে ফেলো পুরুষদের সাফাইয়ে তারা যে বেশ বিরক্ত। অনেকে ভাষা ও গল্পে পুরুষদের রীতিমত শাসিয়েছেন। আমার সবচেয়ে প্রিয় ভিডিওটির বক্তব্য ছিল – যৌন আক্রমন করতে আসলে ছেলেদের “পাড়ায়া পিষায়া গালায়া” দেয়া হবে।

যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে টালবাহানা ঠেকাতে রাগে ফেটে পড়া ঢাকাবাসীদের নজরদারি করতে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরা। স্থান মিরপুর ১০। ছবি জাকির কিবরিয়া
সাইবার লেভেলে এ’সব মতাদর্শিক সংঘর্ষ যখন চলছে তখন আসল অপরাধী কে এটা বের করতে মাটির উপরে শুরু হয়েছে আরেক খেলা। গোয়েন্দা পুলিশ প্রেসের মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করলো যে আসলে ঘটনাস্থলে কেউই বিবস্ত্র হয়নি। আগেই বলেছি যে ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকায়, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং বাম ঘারানার ছাত্রী-ছাত্রদের সংগঠনের মধ্যে যৌননিপীড়ন বিরোধী এ্যাকটিভিস্টের সংখ্যা বেশ বেড়েছে। ফলে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষুব্ধ নারী সমাজের বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে বেগ পেতে হয়নি। সাথে ছিল ছাত্র-ইউনিয়ন, শাহবাগের গণজাগরন মঞ্চ নামে ফর্ম হওয়া নতুন একটা ফ্লেক্সিবল সংগঠন। আর অনেকগুলো টিভি চ্যানেলও এই বিক্ষোভ কাভার করছিল। আর নারী আইনজীবিদের আবেদনে মহামাণ্য আদালতও ঘটনার তালাশ করলেন। এতোসব হাঙ্গামার ফলে গোয়েন্দা পুলিশ জানালো তারা বিষয়টিতে পুরোই বিভ্রান্ত। কিন্তু শাহবাগে জমায়েত হওয়া যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার প্রত্যাশীরা তখন এতোই বিক্ষুব্ধ যে নিপীড়কটাকে ধরতে তারা নিজেরাই গোয়েন্দা হয়ে যায়। রুটিনের মত অবিচার নিয়ে রাষ্ট্রের অস্বীকার তারা মানবেনা বলে ঠিক করে।

যৌননিপীড়নকারীদের গ্রেফতারের দাবী নিয়ে সচিবালয়ে স্মারকলিপি পেশ করতে গেলে এ্যঅকটিভিস্টদের বাধা দেয়া হয়। পুলিশ মিছিল নজরদারি করতে ব্যবহার করে এসব ক্যামেরা।
আমরা কিন্তু এখনও অপরাধীই খুঁজছি। আমাদের শুধু এতোটুকু জানা হয়েছে অপরাধী পুরুষ। এর মধ্যে পরিস্থিতির একটু পরিবর্তন হল সিসিটিভি ফুটেজকে ঘিরে। যৌননিপীড়ন বিরোধী বিক্ষুব্ধ সমাজের ক্রমাগত একটি দাবী ছিল পুলিশের কাজকর্মের জবাবদিহিতা। উৎসব প্রাঙ্গনে মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা ফিট্ করা ছিল, তারা সেগুলো নিয়ে তদন্ত করার উপরে জোর দিলেন। পুলিশ সেগুলো নিয়ে কি তদন্ত করছে সেটা বোঝার আগেই হঠাৎ করে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে ও ফেসবুকে শুরু হল সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু ভিডিও বিলি করা। ঝাপসা ছবি থেকে আন্দাজ করে কারো কারো ফেসবুক প্রোফাইল ছবি বের করে অপরাধী হান্টিং চালালেন এ্যাকটিভিস্টরা।
এখানে আমার দুটো প্রশ্ন উত্থাপন করার আছে। ১. পাবলিক পরিসর বা জনগণের শেয়ারড জায়গা-জমি যেমন, রাজপথ, পার্ক-এ সিসিটিভি বসানো নিয়ে কে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলো? কিসের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের অস্ত্রধারী বাহিনীগুলোর গণ জমায়েতকে সর্বক্ষণ নজরদারি করার প্রয়োজন পড়লো? ২. পাবলিক পরিসরে বসানো সিসিটিভির ফুটেজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমানত থেকে কি উপায়ে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের হাতে আসলো? এটা কি তথ্য অধিকারের আইনের আওতায় হয়েছে? না ব্যক্তিগত খায়খাতিরের মাধ্যমে? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ংকর উপলব্ধি পাঠকের সাথে আমি শেয়ার করতে পারি। সেটা হল বাংলাদেশের জনগণের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত অংশটিকে “নিরাপত্তা বিধান” নামক একটি পুরিয়া শাসকগোষ্ঠী বেশ ভালভাবে গিলিয়েছে। এই পুরিয়ার এমনই গুণ যে নব্বইয়ে সরাসরি সামরিক শাসনের পতনের পর নিরাপত্তা বিধানের নাম করে মেটাল ডিটেকটর, সিসিটিভি ক্যামেরা, আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, ভেহিকাল আমদানীর সিদ্ধান্ত, এ খাতে রাষ্ট্রের কোষাগারের অর্থ অপচয় নিয়ে নেই কোন গবেষণা বা বিশ্লেষণ। আমরা ধরেই নিয়েছি আনসার, পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি, আর্মি, সোয়াট এরা সবাই জনগণের নিরাপত্তা বিধানেই কাজ করছে অতএব এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। যদিও বাস্তবতা আমাদের ভিন্ন কথা বলে।

বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা বিষয়ে স্মারকলিপি পেশ করতে গিয়ে পুলিশের হামলার স্বীকার অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। ২০০৯
বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার অস্ত্রধারী বাহিনী দিয়ে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবে- এই বিশ্বাস আবার একই সাথে এই বাহিনীগুলোর ওপর চরম অনাস্থা, অবিশ্বাস- এ নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত সমাজ বেশ দুর্দশার মধ্যে পতিত এখন। ১৪ এপ্রিলের পর ঘটনাগুলো আমাদের সে লক্ষণই দেখাচ্ছে আবার। ভুক্তভোগী জনগণ/এ্যাকটিভিস্টরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী কোন সন্দেহ নেই তাতে। রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে তারা নিজেরাই অপরাধী খুঁজে বের করবে এরকম একটা মরিয়া ভাব-ভঙ্গি তাদের। “যদি আইনের আশ্রয় না পাও তবে অস্ত্রের সাহায্য নাও” – এরকম পোস্টার দেখা গেছে এবারের আন্দোলনে। জনগণের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নিয়ে এতো খোলামেলা প্রচারণা আগে কোন আন্দোলনে দেখা যায়নি বলে অনেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। যদিও অস্ত্র হিসেবে আসলে পোস্টার, নাটক, কবিতা গানই ব্যবহার করছেন এ্যাকটিভিস্টরা। কৌতুক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন চারুশিল্পীরা, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে স্যাটায়ার করতে চুড়ি, ললিপপ নিয়ে শাহবাগ থানা ঘেরাও করেছেন তারা। কিন্তু অপরাধী ধরার ব্যপারে মূল দাযিত্বে যারা আছেন তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। এবং সম্ভবত এ্যাকটিভিস্টদের মরিয়া ও বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের খাতিরের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ইসলামিস্ট মিলিট্যান্ট জুজুবড়িটি হাজির করছে এবং আসল অপরাধীদের চোখের আরও আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে।
এ লেখা চলবে। শেষ করার আগে উপরের আলোচনার সারকথাটা লিখছি। ১৪ এপ্রিল ঢাকায় বর্ষবরণের উৎসবে যৌননিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদ চলছে। অপরাধী পুরুষ শুধু এতোটুকু তথ্য আমাদের জানা থাকলে চলবে না। যদিও এটা সত্য যে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যাণ ধারণা দেশের নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে জারি আছে বলেই যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটছে এবং সেগুলো বন্ধ হচ্ছে না। এখন এ্যাকটিভিস্টদের সময় এসেছে অপরাধী চিহ্নিত করার পরের ধাপে যাওয়া। আর সেটা হল তাদেরকে চেনা যারা অপরাধীদের আড়ালে নিচ্ছে, যেমন রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়। পাল্টা আঘাত আনবো বলছেন এ্যাকটিভিস্টরা কিন্তু আঘাতটা কাকে করবো সেটা চেনার জন্য এই পরের ধাপটায় যাওয়া জরুরী।
Categories: আন্দোলন বার্তা, যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
Leave a Reply