উমে মারমা
বিস্মৃতির বিরুদ্ধচারণ: খাগড়াছড়ি’৮৬’র গণহত্যা
১মে, ১৯৮৬। আর্ন্তজাতিক শ্রমিক দিবস। চলুন ২৯ বছর আগের এই দিনে আমরা খাগড়াছড়ি জেলায় একবার ঘুরে আসি। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রতক্ষ্য সংগ্রাম চলছে, এ সময় জুম্ম জনগনের উপর যে সামরিক নির্যাতন হয়েছে তা অবর্ণনীয়। আপনারা কি জানেন এই দিনে একই সাথে মাত্র ঘন্টা খানেক ব্যবধানে খাগড়াছড়ি সদর মহাজন পাড়া গ্রাম, দিঘীনালার সদরের বোয়ালখালী, নারিকেল বাগান, পাবলাখালীসহ আরো অনেক গ্রাম, পানছড়ি উপজেলা সদরের করমা পাড়া, শান্তিপুর, লতিবানসহ অনেক গ্রাম এবং মাটিরাংগা উপজেলার তেইন্দং তবলছড়ি এলাকায় জুম্মো অধ্যুষিত গ্রামে সেনাবহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে সেটলার বাঙালীরা মিলে জুম্মোদের উপর লোমহর্ষক গণহত্যা চালিয়েছিল! একদিনে জুম্মোদের শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। জুম্মোদের কাছে এই ঘটনাটি খাগড়াছড়ি’৮৬’র গণহত্যা নামে পরিচিত। এই দিনটিকে স্মরণে রিনিপুদী চাঙমা একটা কবিতা লিখেছেন,
চড়–নীরে তুমি যদি চবোর চ’
হাগারাছড়রি পানছড়তি শান্তপিুরত য’
তারা অলাক তনি ভইে বোন
চড়–নি বড়নি কনিারাম
বাপ্পো নাঙান আনন্দ
নক্কে অল দয়ালচান।।
দুগর সংসারত নত্যি আগে অভাব অনটন,
সত্তিুন বচ্ েদুগ তার তা হয়িার ঘা-আনত।
৮৬ সালর ১লা ম’ের ঘটনার স্বাক্ষী তে জ্বালজ্বল্য প্রমাণ
বাজি আগে হোন রকম জদো মরা চান।।
হদক দুগ পইিয়ে মত্তে মত্তে বাচ্চে
বাঙাল্যার হুবত গত্তানা অদ্ধকে সন্যিে
তোয় পরানান রইয়।ে।
বাঙাল্যা নাঙান সরবত আলী ওমর পুরত ঘরবাড়ী
চনিা চনিি আগন,বড়েে চড়েইে হয়িন
পো-ছাউন রাগে দ-েদি গজ্যন
যক্কেনেে তে জল্লাদ অইয়,ে পরচিয় পুরি ফলেয়েে
আত্জুর গুরি হদক দা, দা, দাগলি
অসুরবো তার ভইে ন’অল ।।
এই গণহত্যায় প্রায় অর্ধশতক জুম্মোকে হত্যা করা হয়। পুরো খাগড়াছড়ি জেলা পরিনত হয়ে যায় জুম্মো বধ্যভূমিতে। পৃথক পৃথক জায়গায় এইসব হামলায় বাঙালীরা যাতে নির্বিঘ্নে জুম্মো নিধন করতে পারে সেজন্য পাহারায় ছিল আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।
খাগড়াছড়ি সদর মহাজন পাড়া গ্রামে দুপুরের দিকে বাঙালী সেনাবাহিনী মিলে হামলা করলে ৩০টিরও বেশী বাড়ী আগুনে ভষ্মীভূত হয় এবং একজন মারা যায়। দিঘীনালাতে শ’তে শ’তে জুম্মোদের ঘর বাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয়। আর মাটিরাংগার ফেনী তেইন্দং এলাকা প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ার কারণে কতজন যে মারা গেছে তার হিসাব আজো মেলেনি।
তবে সকল ঘটনাকে ছাপিয়ে যায় পানছড়িতে সংঘটিত অত্যন্ত পরিকল্পিত গণহত্যাটি। পানছড়িতে ৪/৫ টি জুম্মো গ্রামের মানুষদের জড়ো করে প্রথমে পানছড়ি আর খাগড়াছড়ি সড়কে জড়ো করা হয়। পরে জড়ো হওয়া জুম্মোদেরকে লাইনে মাথা নীচু করে বসানো হয়েছিল যাতে বাঙালীরা পিছন থেকে সহজেই ঘাড়ে কোপ দিতে পারে। একেবারে ফিল্মী ষ্টাইলে ছিল এই হামলা। পাঠক বিশ্বাস হচ্ছেনাতো আপনাদের! হ্যাঁ আমাদেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আর বলতেতো আরো বেশী কষ্ট হয়। কিন্তু এটাই সত্যি আর বাস্তবতা যে পাহাড়ে যেসব গণহত্যা হয়েছে এবং হচ্ছে সবগুলোর প্রত্যক্ষ মদদদাতা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং তার সেনাবাহিনী। আর এইসব গণহত্যার নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয় বাঙালীদের। পাহাড়ের সমস্যাকে জাতিগত সংঘাত হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য। কিন্তু আসলে কি তাই?
চলুন আমরা ২৯ বছর আগের এই দিনে তাদের কাছে ফিরে যায় যেদিন যারা তাদের সবকিছু হারিয়েছেন।
২ প্রত্যক্ষদর্শী ছায়াদেব চাকমা (৪৫)
“করমা গ্রামে আমাদের বাড়ী। আমি তখন কলেজে পড়ি। ঘটনার আগের দিন মানে ১মের আগের সন্ধ্যায় শুনলাম শান্তিবাহিনীরা’ কোন জায়গায় যেন ২/৩ জন বাঙালীকে মেরে ফেলেছে। তাই পানছড়ি বাঙালী পাড়ায় উত্তেজনা চলছে। আমরা তাই একটু সর্তক আর শংকিত ছিলাম। আমরা আসলে তখন একটুও বিশ্বাস করিনি বাঙালীরা আমাদের গ্রামে হামলা করবে। আর আমাদের একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যদি হামলাও করতে আসে তাহলে আমাদের সাথে তারা পেরে উঠবেনা। তো ১মে সকাল বেলায় কিছুই ঘটলোনা, এমনকি দুপুরেও না। তাই ভাবছিলাম আর কিছু হবেনা। কিন্তু না, ঘটলো। দুপুরের একটুর পর খবর আসলো আমাদের গ্রামে, করমা আদামে বাঙালীরা চাকমাদের উপর হামলা করেছে দা বল্লম লাঠি নিয়ে। এরই মধ্যে অনেকে তাদের হামলায় মারা গেছে। আমি তাড়াতাড়ি গ্রামের অন্য জায়গা থেকে বাড়ীতে চলে এলাম মা বোনদের বাচাঁতে। আমাদের উপরে যে গ্রাম আছে মানেক্য কার্বারী পাড়া, সেখান থেকে অনেক মানুষ পালিয়ে এসেছে আমাদের গ্রামে। তো বাড়ীতে এসে দেখি কেউ নেই। আমি একা বাড়ী থেকে বের হয়ে নদী পার হয়ে, আমার সাথে তখন শত শত গ্রামের মানুষ পার হচ্ছিল, পানছড়ি স্কুলে বল খেলার মাঠ ধরে এপারে চলে এলাম। কারণ পশ্চিম কূল আমাদের জন্য নিরাপদ ছিলনা। ঐদিক থেকেই বাঙালীরা আসছিল। গ্রাম ছাড়ার আগে আমার চোখের সামনেই ‘পাক্কোয়া দা’ তার ছেলের হাত ধরে দৌড়াচ্ছিল আর চিৎকার করছিল‘ শেজ গল্লাক শেজ গল্লাক, মারে বাঙালোনে শেজ গল্লাক’(মেরে ফেলল মেরে ফেলল, আমার মাকে বাঙালীরা মেরে ফেলল!)। তার চিৎকার শুনে আমিও দৌড়াতে দৌড়াতে পিছন ফিরে দেখি ‘পাক্কোয়া দা’র মাকে বাঙালীর ধরে বল্লম দিয়ে গুতাচ্ছে। বল্লম দিয়ে অনেক গুতানোর পর তার মা একটা হাত উপরে তুলল পরে মাটিতে পড়ে গেল। ধরে নিলাম সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছে।
চেঙেই নদী পার হবার পর আমরা যুবকরা মিলে ঠিক করলাম বয়স্ক, নারী আর শিশুদের আগে নদী পার করতে হবে। ঠিক ঐসময়ে শ’তে শ’তে বাঙালী নারায়ে তকবির করে চিৎকার করতে করতে হাজির হল। ঐ সময়ে আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম। তারা আমাদের দেখে একটু থামল। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাঙালীদের সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আছে। সেনাবাহিনী দেখে আর আমাদের সাহস কুলাল না। কেননা তাদের হাতে অস্ত্র আছে। আমাদের হাতে আসলে তখন লড়াই করবার জন্য কিছুই ছিলনা। আমার পাশে ছিল আমাদের বৌদ্ধ মন্দিরের শ্রদ্ধেয় ভান্তে। ভান্তে তখন আমায় বলল এইবার পালাতে হবে। আর পালানোর একমাত্র পথ হচ্ছে পূর্ব দিক। আমি পূর্ব দিকে অনেকের সাথে হাটা দিলাম। তখনো আমি জানিনা আমার মা বাবা বোন ওরা কোথায় কেমন আছে। হাটতে হাটতে হঠাৎ দেখি একটু দূরে বাবা সহ আরো কয়েকজনকে সেনাবাহিনী আটকে রেখেছে। নিলোৎপল নামে একজনকে চিনতে পারলাম এবং দেখলাম তাকে ধরে সেনাবাহিনী বেদম পিটাচ্ছে। একদিকে বাবা সেনাবাহিনীর হাতে আটক অন্যদিকে নিজের জীবন বাচাঁনো, কি করবো তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোন দিকে যাবো, কি করবো, কি করা উচিত কিছুতেই বুঝতেই পারছিলামনা। তখন আমার মাথা একটুও কাজ করছিলনা। এদিকে পানছড়ির সরকারী রাস্তায় শ’তে শ’তে মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে আটকা পড়েছে। আমাদের গ্রামের অনেক লোকও ওখানে আছে। আমি দূর থেকে আড়ালে দাড়িয়ে দেখছি একটু পর মেয়েদের সেনাবাহিনীরা ছেড়ে দিল। কিন্তু বাবা সহ সকল পুরুষদের আটকে রেখেছে। দূর থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি পানছড়ি রাস্তায় মানে মির্জাপুরের নালের পাশে এখন এই জায়গার নাম লারমা পাড়া সেখানে পুরুষ ও যুবকদের দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি দূর থেকে দেখে ভয়ে কি করবো বুঝে উঠতে না পেরে চলে গেলাম ওখান থেকে নিজে বাচাঁর জন্য। এরপরের ঘটনা আমি কল্পনা করতে পারি। কারণ এর তিনদিন পর বাবার লাশ থানা থেকে গ্রহণ করেছি। থানায় গিয়ে আমি ১৬ টা লাশ গুণেছি আর দাহ করেছি। বাবাকে হত্যা করার খবর আমি পেয়েছি সীমান্ত পাড়ি দেবার জন্য পুজগাং যখন পৌঁছলাম তখন সেখানে আমাদের গ্রামের অনেকের সাথে দেখা হল। তারা আমাকে দেখে বলল তুমি এখানে? তোমার বাবাকে তো বাঙালীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। মির্জাবিলের কাছে যে দুটো বটগাছ আছে সেখানে তোমার বাবার লাশ পড়ে ছিল। এই কথা জানার পর আমি আর সীমান্ত পাড়ি না দিয়ে সোজা চলে এলাম পানছড়িতে। তখন পানছড়ির উপজেলার চেয়ারম্যান ছিল রাজকুমার বাবু। তার কাছে গিয়ে বাবার লাশের খোঁজ নিয়ে থানায় গিয়ে অনেক লাশের সাথে বাবাকে পেলাম। বাবার মাথার দুদিকে দায়ের কোপে ক্ষত বিক্ষত। সবচেয়ে লোমহর্ষক হচ্ছে বাবাকে যে বাঙালী খুন করেছে সে এতই হিং¯্র যে বাবার মুখের চামড়া তুলে ফেলে দিয়েছে। আজো আমি বাবার ঐ চেহারাটা ভুলতে পারিনা। বারে বারে ফিরে আসে। আমি নিজ চোখে ১৬ টা লাশ গুনেছি থানায়। এর আগে গ্রামে ২ জনকে মেরে ফেলতে দেখেছি। এই ঘটনায় কতজন যে মারা গেছে তার খবর বোধহয় এখনো কেউ জানেনা। পানছড়ির এই গণহত্যার সময় পানছড়ি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের মেজর ছিল ইসহাক। খুব দেখার আর ভাবার বিষয় এই মেজর ইসহাক বিয়ে করেছে একজন চাকমা মেয়েকে রাংগামাটি থেকে। তার নাম কলি। সম্ভবত: সে রাংগামাটির সুদিপ্তা দেওয়ানের মেয়ে এবং এই মেজর ইসহাকের নেতৃত্বে সেসময় এই ঘটনা ঘটে। লে: হিসাবে ছিল তখন আহসান উদ্দীন চৌধুরী। আর টুআইসি ছিল শাহজাহান। ধীরে ধীরে জানা গেল শান্তিপুর গ্রাম থেকে একটা পুরো পরিবার মা, বাবা আর মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। সেই মা’ প্রেগনেন্ট ছিলেন। আরো মারা গেছেন মতিলাল মা। এরকম কতজনকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার ঠিক হিসাব শান্তিবাহিনীরাও বোধহয় করেনি। আরেকটা ঘটনা আমি শুনেছিলাম– এটাকি শান্তিপুর গ্রামে নাকি অন্য গ্রামে সেটা খেয়াল নেই আর। বাঙালীরা মা’কে কুুপিয়ে হত্যা করেছে সেই মৃত মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল একটা ছোট্ট শিশু। যখন ঘটনার পরে সে শিশুটাকে উদ্ধার করা হয় তখনো সে মৃত মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল। এরকম কত ঘটনাযে পাহাড়ে চাপা পড়ে আছে।’
৩ প্রত্যক্ষর্দশী ব্রজবালা চাকমা(৮২)
সেদিনের ৫৩ বছরের মানুষটি আজ বয়সের ভারে ন্যুজ। তবে ২৯ বছর আগের ঘটনা এখনো স্পষ্ট করে স্মরণ করতে পারেন। তার বয়ানে শোনা যাক “আমাদের গ্রামের নাম করমা আদাম। আমার স্বামী ভক্তিকর চাকমা ইউনিয়ন পরিষদে চাকুরী করতেন। সেই বছর আমরা অনেক ধান পেয়েছিলাম। তাই আমাদের মনে কত আনন্দ। কিন্তু তারপরতো আর্মি বাঙালী মিলে আমাদের সে আনন্দ একেবারে শেষ করে দিল। সেদিন ছিল ১মে ১৯৮৬ সাল। অফিস ছুটি তাই আমরা দুজনে মিলে গ্রামে আমার ভাসুরের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, ভাসুরের মেয়ের বেইন বানিয়ে দিতে। বেইন বানিয়ে দেবার সময় হঠাৎ হৈচৈ। আমার ভাসুরের ছেলে বলল পালাও পালাও আমার মাকে বাঙালীরা মেরে ফেলেছে বলে চিৎকার করছে, আর দৌড়াচ্ছে। আমরা দেখতে পাই পশ্চিম দিক থেকে বাঙালীরা আসছে দা বল্লম লাঠি নিয়ে আমাদের দিকে। দিক বিদিক হয়ে আমিও তাদের সাথে পালিয়ে চেঙেই নদী পার হলাম। আমার ছেলে মেয়ে কে কোথায় তখন খোঁজ নেয়ার কোন সময় পাইনি। নদী পার হবার পর আমি আর উপরে উঠতে পারছিলামনা, সব শক্তি শেষ ,তখন তোমার জেঠা, মানে আমার স্বামীকে বললাম আমাকে হাত ধরে একটু উপরে তোল। সে টেনে আমাকে উপরে তোলে। এরপর আমরা পানছড়ি স্কুলের মাঠে পৌছাঁলাম। সেখানে অনেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি সেখানে আমার স্বামীকে হারিয়ে ফেললাম। কোথায় কোনদিকে যে গেল। অনেক লোক তখন সবাই পশ্চিম দিকের গ্রাম গুলো থেকে পূর্ব দিকে পালিয়ে এসেছে। কারণ আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে হচ্ছে বাঙালীদের গ্রাম। রাস্তায় আর্মি ঘোরাফেরা করছে। আমি আমার ছেলে মেয়েদের খুজছি। একটু পরে আমার মেজ মেয়েকে খুজে পেয়ে সরকারী রাস্তা পার হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেলাম। আমরা যখন পূর্ব দিকে পার হচ্ছি তখন সরকারী রাস্তায় অনেক আর্মী ছিল। তারা ছেলে পুরুষদের আটকালেও আমাদের কিছু বলেনি। পূর্ব দিকের একটা গ্রামে আসার পর আমার ছোট মেয়ের সাথে দেখা হল। কিন্তু আমার ছেলে আর স্বামী যে কোথায় হারিয়ে গেল সে চিন্তায় তখন মাথা কাজ করছিলনা। এইভাবে আমরা হাজারে হাজারে মানুষ রাতদিন হেটে হেটে তিনদিন পর ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরনার্থী হলাম তখন গ্রামের লোকদের কাছে শুনতে পেলাম আমার স্বামীকে বাঙালীরা নির্মমভাবে দা দিয়ে কেটে হত্যা করেছে। আমার স্বামীর লাশ আমি দেখিনি। তবে ’শুনেছি খুব নির্মম আর নৃশংস ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেসময় আমি ভারতে একজন শরর্নাথী।”
৪ প্রত্যক্ষদর্শী সন্তোষ চাকমা(৫০)
‘আমাদের গ্রাম শান্তিপুর। সেদিন সকাল থেকে সেনাবাহিনী আমাদের গ্রাম ঘিরে রেখেছিল। প্রথমে আমরা বুঝিনি এর অর্থ কি। দুপুরের পর সেনাবাহিনীরাই ্ আমাদেরকে গ্রাম থেকে হাটিয়ে পানছড়ি সরকারী রাস্তায় তুলে আনে এবং এখালে এসে ছেলে পুরুষদের লাইন ধরে দাঁড় করালো আর বলল মাথা নীচু করে রাখতে। আমরা সেনাবাহিনীর ভয়ে সেভাবেই মাথা নীচু করে দাড়িঁয়ে থাকলাম। বাঙালীরা সেনাবাহিনীর সাথে সাথে দা লাঠি বল্লম নিয়ে ঘুরছে। হঠাৎ দেখি একব্যাক্তি কাঁধে এক ছেলে আর হাতে আরেক ছোট্ট ছেলের হাত ধরে এগিয়ে আসছে এমন সময় এক বাঙালীর দায়ের কোপে হাতে ধরা ছেলেটির মাথা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন আমি চিৎকার করে পিছর ফিরে তাকিয়ে দেখি বাঙালীরা একেবারে পিছন থেকে লাইনে মাথা নীচু করে বসে থাকা জুম্মোদের কেটে ফেলছে। আমি তখন জোরে চিৎকার দিলাম “ ও ভেই লগ, বাঙালোনে আমারে হাবদন, ধেই যঅ, ধেই যঅ। বাজিবাত্তেই চেলে ধেই যঅ। ”(ও ভাইয়েরা, বাঙালীরা আমাদের কেটে ফেলছে। বাচঁতে চাইলে পালাও পালাও) বলে আমিও বাঁিচ আর মরি ভেবে দৌড় দিলাম সেনাবাহিনীকে ধাক্কা দিয়ে। বাচাঁর জন্য এই অদ্ভুত শক্তি কোথা থেকে এসেছে আমি জানিনা। তারপর আমার চিৎকারে সকলেই সেনাবাহিনীর বেষ্টনী ভেঙ্গে দৌড় দিল। এরপর আমি আর জানিনা সেখানে কি হয়েছে, কতজনকে কেটে ফেলা হয়েছে, কতজনইবা মারা গেছে, কতজনের লাশ পাওয়া গেছে কতজনইবা চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমি সেইযে ভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরনার্থী হলাম তার অনেক বছর পর আমি ফিরে আসি। যুদ্ধের ছবি এখনো আমাকে সেই দৃশ্যতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় যে ইহুদি নিধন হয়েছিল, লাইন ধরে গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের ঢুকানো হচ্ছে মারার জন্য। এইসব দৃশ্য আজো বারে বারে মনে করিয়ে দেয় পানছড়ির সেই গণহত্যার কথা।’
ঠোটকাটার জন্য এই মৌখিক ইতিহাসভিত্তিক সাক্ষাতকারগুলো গ্রহণ করেছেন উমে মারমা, এপ্রিল ২০১৫
Categories: আন্দোলন বার্তা, প্রান্তিক জাতি প্রশ্নে, বাংলাদেশে নারীবাদ
Leave a Reply