Freshly harvested tea leaves are brought to the tea estate manager who measures the quantity of the gathered tea leaves using spring-balance near  Sreemangal (Srimangal), Division of Sylhet, Bangladesh, Indian Sub-Continent, Asia
উদিসা ইসলাম
খুলনা শহরের আশেপাশে চাতালে ভর্তি। এখানকার শ্রমিকদের বেশির ভাগ অংশই নারী। পা দিয়ে ধান শুকাতে গিয়ে তাদের পায়ের তলায় ঘা হয়ে গেছে। কারো পায়ের তলা রক্তে রক্তাত্ব। রক্তে ভেসে যাওয়া পা কয়েক পুরুতের কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে কাজ করেন। কারণ চাতালে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ চুক্তি। সোহেলী চাতালে কাজ করতে এসেছেন দেড়বছরের মেয়ে নিয়ে। কাজ করার পাশাপাশি মেয়েকে দেখাশোনা করা যায়। এই শরীরে কি কওে পারেন জানতে চাইলে বলে: ধরেন মাথায় আর পায়ের তলে সমান চাপ। সয়ে গেছে। মেয়েকে দুধ খাওয়াতে পারেন না। শরীরের সেই অবস্থা নেই। আশেপাশের চাতালগুলোতে সালেহার মতো অনেককেই পাওয়াগেলো: প্রথম সন্তান দুধ পেয়েছে, দ্বিতীয়জন পায়নি। আর মায়ের শরীর এখন কেবল দু-বেলা খাবার জোগাড়ে শ্রম দিচ্ছে। 
 
এই নারীদেও কথা কেউ শুনতে পান না। বলা ভালো এই নারীরা নিজেরাওনিজেদেও কথা শুনতে ভুলে গেছেন। অথচ এদেরকে দেখিয়ে চলছে এনজিওদেও দাদাগিরি, চলছে আমাদেও অদেখা ভুবনে বিশাল অংকের টাকার আদান প্রদানের খেলা। আশেপাশে ঘুরছি আর দেখছি এই নারীদের শরীর মানে বাচ্চা হওয়া বা না হওয়া, কোন চিকিৎসা সেবা নেই, কোন ক্লান্তিও যেন নেই।
 
এবার ঢাকার পোশাক শ্রমিক। সকালে উঠে হেটে অফিসে ঢুকে টানা কাজ করে চলা। এক সেকেন্ডের বিরতিহীন কখনো কখনো। এদের বেশিরভাগের কাজের বয়স ১৪ থেকে ২৫। এরমধ্যেই কাজের জন্য তাদের ডিমা- থাকে, তারপর না। হাত ধীরে চলে, চোখে কম দেখে, বাড়ির কাজে ব্যস্ত নানা অজুহাত। 
 
একই ভাবে পাটগ্রামে কুড়ি থেকে ত্রিশ বছরের মেয়েরা পাথর ভাঙতে গিয়ে পাথরের গুড়া তাদের ফুসফুস ছিদ্র করে সিলিকোসিস রোগ বাধিয়েছে। তারা অল্প বয়সে মারা যাচ্ছে, কিন্তু এই মারা যাওয়ার সংখ্যা অজানা থেকে যায়। এদের বেঁচে থাকা যেমন হিসেবের বাইরে, মরে যাওয়াটাও তাই। নিরাপত্তা সিড়ি, আগুন থেকে বাঁচার কোন সরঞ্জাম, হাতে গ্লাভস বা নাকে নিদেনপক্ষে মাস্ক ব্যবহারের কথা থাকলেও সেখানে সেবব মেনে চলার কোন রীতি নেই।
 
খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে উত্তরবঙ্গের পাটগ্রাম ঘুরে সিলেটের শ্রমিকের দিকে তাকাতে চান? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে সিলেটে গিয়ে চোখে পড়ে না সেই শ্রমিক নারীর সংগ্রাম যে অনবরত কাজ কওে চলেছে চা বাগানে। পুষ্টিহীন, নিরলস, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিচ্ছিন্ন। 
 
এদের কাজের ধরণ দেখতে গিয়ে নজরে পড়লো একেকদিন চা তুলে হাত ফুলে যায়, পা ফুলে যায়, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হাটাচলার জন্য হাত পা কোমর ছিলে যায়। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে পোকামাকড়ের কামড় খেয়ে তারা কাজ করে। এটা জেনেই যুগের পর যুগ কাজ করছে যে তার সন্তানের শিক্ষা মিলবে না, চিকিৎসা মেলে না, সেও শ্রমিক হিসেবেই বেড়ে উঠবে যদি না ভিন্নকিছু করা হয়ে ওঠে। এই নারীরা কেউ জানেন না তারা কি চান? ভাল জীবন? রেড্ডীর সাথে কথা হলো তার ঘরের বারান্দাতে। কেমন থাকতে চান জানতে চাইলে বললেন, আরেকটু বেশি রেশন আর মজুরি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া? ডদনিমণিরা এসে বলে কিন্তু তার বাইওে বাগাওে চা পাতা তুললে বেশি লাভ। কেমন জীবন বলতে কেমনই খেয়ে পরে থাকার কথাই এখন ভাবতে হয় তাদের, এর বাইরে অন্যকোন স্বর তারা শুনতে পাবেন তেমন সম্ভাবনা নজওে আসে না।
 
চা বাগানগুলোর থেকে সবচেয়ে কম দুরত্বের শারিরীক চিকিৎসাকেন্দ্রের দুরত্বও কম না। ছেলেমেয়ে হতে কোন শারিরীক সমস্যা হলে কি করেন জানতে চাইলে নেলি বলেন, একবার এক মায়ের তেমন হলে আমরা কোন গাড়ির ব্যবস্থা পাইনি। পরে এখানে মাল টানার যে ট্রাক তাতে কওে নিয়ে গেছি।  
 
এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই শ্রম আইন সম্পর্কে জানেন না, কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করে বুঝাতে চেয়েছে কিন্তু সেটা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন এরা। তাদের সাথে যে আচরণ করা হয়, যে প্রক্রিয়ায় দেশের ভিতর ভিন্ন দেশ বানিয়ে রাখা হয়েছে বাগানগুলো তা দেখলে বাগানের চরিত্রের সাথে মিলে যায়। বলা হয়ে থাকে, চা গাছ ছেটে ছেটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেটে দেয়া হয়। জীবনকে বেধে দেয়া হয় দৈনিক মজুরী মাত্র ৫৫ টাকায়, সাথে সপ্তাহে তিন কেজি রেশনের চাল ও আটা। 
 
যখন শুনি অনেকে বলেন সময় পাল্টেছে তখন জানতে চাই এই যে যাদের কথা বললাম তাদের স্বর তাহলে আপনার কানে পৌঁছায়? জবাব মেলে না। যখন প্রশ্ন করেছি বলুনতো ওরা কি খায় বলতে পারেনি কেউ ওরা চিনির বদলে লবন দিয়ে চা খেতে বাধ্য হয়। আমরা পারিনি তাদের জীবনটাকে নজরের ভিতরে নিতে। ওদের জীবন আমাদের নজরের আড়ালে। এমনকি বিচ্ছিন্ন হতে হতে, জীবনের সাতে লড়াই করতে করতে ওদের জীবন ওদেরও নজরের আড়ালে। শুভ মে দিবস। দিবসের রাজনীতি এখনও তাদের কাছে পৌছায়নি। 

Leave a comment

Trending